ঢাকা   মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৯ আশ্বিন ১৪৩১
পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া : কৃষি উৎপাদনে খরচ বৃদ্ধি : বাড়ছে আর্সেনিক দুষণ

উত্তরের নদ-নদী পানিশূন্য

Daily Inqilab মহসিন রাজু

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৭ এএম

শুষ্ক মওশুমের শুরুতেই পানিশূন্য হয়ে পড়েছে উত্তরের নদনদী। একই সাথে এর প্রভাবে উত্তরের ছোটবড় বিল, খাল ও নালাগুলো শুকিয়ে গেছে। পরিবেশে সৃষ্টি হয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কৃষিজাত কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপুর্ণ অংশ সেচকাজে যুক্ত হবে বাড়তি খরচ। সঙ্কুচিত হবে মৎস্যখাতের কার্যক্রম। ক্রমশ কমবে নৌ-পথে যোগাযোগ। শুরু হয়েছে মরুকরণ।
আবহাওয়া পরিবর্তনের বৈশি^ক কারণের পাশাপশি হিমালয় থেকে সৃষ্ট নদনদীসমূহ ভারত হয়ে বাংলাদেশের প্রবেশ মুখে বাঁধ ও স্পার দিয়ে পানি প্রত্যাহারই এর কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মহল। এ মহলের মতে, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৬ সালে ঐতিহিাসিক ফারাক্কা লংমার্চ এবং ফারাক্কা বাঁধের বিষয়টি জাতিসংঘে তোলার পর পানি ইস্যুটি মুলধারার রাজনীতিতে আর তেমন উপজীব্য হয়ে উঠেনি।
বর্তমানে শুষ্ক মওশুমে বামধারার কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও জোট কয়েকবছর ধরে উত্তরের উজানে সীমান্তের ভারতীয় অংশে নদনদীতে বাঁধ সৃষ্টি ও ভিন্ন উপায়ে পানি প্রত্যাহার করে উত্তরাঞ্চল তথা বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলেও সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে তুলে ধরছে। তারা একাধিকবার তিস্তা অভিমুখে লংমার্চ করেছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘বেলা’-র পক্ষ থেকে জিয়াউর রহমান, তাদের সংগঠনের স্টাডি পেপার সূত্রে জানান, শুস্ক মওসুমে (চৈত্র/বৈশাখ মাসে) উত্তরাঞ্চলের নদনদীতে পানি কমবে এটা তো স্বাভাবিক। স্বাভাবিক কারণেই নিজের জমিদারীর আওতাভুক্ত নাগরনদীর রূপ বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’
তিনি বলেন, নাগরনদী এখন এ ফাল্গুনেই হয়ে পড়েছে সম্পূর্ণ পানিশূন্য। খুব জানতে ইচ্ছে করে আজ রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে নাগর নদসহ অপরাপর ছোটবড় মৃত বা মৃতপ্রায় নদনদীর হতশ্রীদশা দেখে কতটা হতাশ/বিমর্ষ হতেন? বেলাসহ কয়েকটি পরিবেশবাদী সংস্থার সূত্রে জানা যায়, উত্তরের তিনটি বড় নদী- পদ্মা, যমুনা ও তিস্তা এবং বম্ভপুত্র নদের শাখা-প্রশাখা মিলিয়ে জালের মতো বিস্তৃত ছিল কমপক্ষে তিন থেকে চারশত ছোটবড় নদনদী বিল ও খাল। নাটোর, সিংড়া ও পাবনার তাড়াশের অংশবিশেষ নিয়ে চলনবিল, বগুড়ার রক্তদহ বিলসহ উত্তরের ১৬ জেলায় ৫০টির বেশি বিল ছিল মৎস্য সম্পদে ভরপুর।
পদ্মা, যমুনা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের মতো বড় ৪টি নদীর চরাঞ্চল ও আশেপাশে মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাসের পরিবেশ এখন ঠিক মরুভূমির মতোই হয়ে ওঠে। দিনের বেলা বয়ে চলে উত্তপ্ত লু হাওয়া। আবার রাতে তীব্র শীত পড়ে বলে জানান চরাঞ্চলের মানুষ। তারা জানান, পরিস্থিতির কারণে এখন চরাঞ্চলের বাথানে গরু-মহিষ, ছাগলের পাশাপাশি ভেড়া, গাধা ও ঘোড়ার প্রতিপালন শুরু হয়েছে। পণ্য পরিবহণ ও মানুষের চরাচলে ব্যবহার বাড়ছে ঘোড়া ও গাধায় টানা যানবাহনও।
পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, ঘাগট, করতোয়া, নাগর, গাংনৈ, মহানন্দা, দুধ কুমার, ছোট যমুনা, বুড়ি তিস্তা, বাঙলী, ফুলজোড়, হুড়াসাগর, ইছামতি, বড়াল ইত্যাদি ঐতিহাসিক নদনদীর নাব্যপথ ব্যবহার করে ব্রিটিশ আমলে ছিল আসাম থেকে উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত নৌপথ। মুঘল ও ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে তৎকালীন বাংলা জনপদের স্বাধীনতাকামীদের রক্ষাকবচ। সম্ভবত সুলভ সেচ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি প্রতিরক্ষাকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা থেকেই জিয়াউর রহমান খালখনন কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। এ খাল খনন কর্মসূচির ধারা অব্যাহত থাকলে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থাপনায় সেচের খরচটা ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা সম্ভব হতো বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই। পরিবশবিদরা বলছেন, উত্তরের নদনদীতে যেভাবে পানিপ্রবাহ কমে যাচ্ছে তাতে ইতোমধ্যেই বহুসংখ্যক ছোটখাট নদনদীই মরে যায়নি বরং শতাধিক প্রজাতির দেশি মাছ, সাপসহ সরিসৃপ প্রজাতির বহু সংখ্যক জলজ প্রাণীও চীরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
ইতিহাস ও প্রকৃতি গবেষকদের অনেকইে বলেছেন, চলতি বছর মাঘ/ফাল্গুনেই উত্তরের সব নদনদীতেই যেভাবে পানির প্রবাহ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে পড়েছে, তা’উদ্বেগজনক বৈকি। এটা যতটা না আবহাওয়ার বৈশি^ক পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ার অংশ তার চেয়েও বাস্তবতা হল এটা মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। সোজা কথায় প্রতিবেশি দেশের প্রভুত্বসুলভ স্বার্থবাদী আচরণ ও কর্মকাণ্ডের প্রভাবেই ভাটিরদেশ বাংলাদেশের উত্তর জনপদ আজ পানি সংকটজনিত কারণে পরিবেশ ভারসাম্যহীনতার শিকার।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফারাক্কা বাঁধ ও তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহারের কারণে গত ৪০ বছরে উত্তর জনপদে ফি-বছর আনুপাতিকহারে বৃষ্টিপাত কমেছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামতে নামতে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছেছে। বেড়েছে আর্সেনিক দূষণ। আর সেচের খরচও বেড়েই চলেছে। কৃষিতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারে প্রতিবছর বাড়ছে সেচের খরচ। বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের চাষিরা জানিয়েছে, পুরো ৮০’র দশক জুড়েই রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে জমি চাষের জন্য শ্যালো বা ডিপটিউবওয়েলের প্রয়োজন পড়েনি। সর্বোচ্চ ৫ হাত পরিমাণ মাটি খুঁেড়ই পাওয়া যেত পানির স্তর। এখন ২০/২৫ হাত নিচেও পাওয়া যায় না। তাদের মতে, সুলভে /সহজে সেচের পানি পাওয়া গেলে বোরো ধানসহ খরিফ ফসলের উৎপাদন খরচ বর্তমানের তুলনায় শতকরা ৪০ ভাগ কমে যেত বলে মনে করেন তারা।
বেশ ক’জন প্রবীণ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, তিনদশক আগেও সিরাজগঞ্জ, বাঘাবাড়ি, জামালপুর, চিলমারি নৌবন্দর থেকে বড়বড় স্টিমার, লঞ্চ, সওদাগরী নৌকায় চলতো গনপরিবহণ ও নৌপথে বাণিজ্য। সেসব আজ কেবলই স্মৃতি।
জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক জরিপের তথ্যে দেখা গেছে, উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়াসহ ভূগর্ভস্থ পানিস্তরের নিম্নগামিতার কারণে আর্সেনিক দূষণ বাড়ছে। পানি সংশিষ্ট এনজিও সংস্থাগুলোর কোন্ োকোনো রিপোর্টে এমনও বলা হয়েছে, আর্সেনিক দূষণযুক্ত পানি সেচকাজে ব্যবহারের কারণে শস্যদানা, সবজি ও ফলের মধ্যে আর্সেনিক দূষণ পওয়া যায়।
এছাড়াও ভারত হয়ে উত্তর জনপদ থেকে দক্ষিণের জেলাগুলোতে বয়ে যাওয়া নদনদীর প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে ভাটি অঞ্চলেও লবণাক্ততার পরিমাণ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক সমঝোতার পাশাপাশি পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সোচ্চার হওয়ার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। বাসদ বগুড়া জেলা শাখার আহ্বায়ক কমরেড সাইফুল ইসলামের মতে, ১৯৭৫ সালে ভারত ছল করে পরীক্ষামূলকভাবে পদ্মানদীর পানি উজানে প্রত্যাহারের নামে এবং ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনার সরকারের সাথে পানি ভাগাভাগির চুক্তি করে যে প্রহসন করে চলেছে এর প্রতিবাদে রাজনৈতিকভাবে জাতীয় ঐক্যমত্য গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। প্রয়োজনে উত্তরজনপদ তথা বাংলাদেশের জীবন মরণ সমস্যা ফারাক্কা বাঁধ ও তিস্তা ব্যারাজের ইস্যুটি ফের আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি তিস্তার বাংলাদেশ অঞ্চলে গৃহিত প্রকল্পের কাজের যাবতীয় জটিলতা পরিহার করে এটি বাস্তবায়নে গড়িমসি বন্ধ করতে হবে বলেও অভিমত তার।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

চোটে পড়ে মৌসুম থেকে ছিটকেই গেলেন টের স্টেগেন

চোটে পড়ে মৌসুম থেকে ছিটকেই গেলেন টের স্টেগেন

ইন্টার মায়ামি ছাড়ছেন মেসি?

ইন্টার মায়ামি ছাড়ছেন মেসি?

ডেভিস কাপ দিয়ে কোর্টে ফিরছেন নাদাল

ডেভিস কাপ দিয়ে কোর্টে ফিরছেন নাদাল

দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে অনুমতি পাচ্ছে না ইউক্রেন

দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে অনুমতি পাচ্ছে না ইউক্রেন

গাজা-লেবাননে নিহত আরো ২২২

গাজা-লেবাননে নিহত আরো ২২২

আসাদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য প্রস্তুত এরদোগান

আসাদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য প্রস্তুত এরদোগান

জাবির সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা মামলায় রায়হানের দোষ স্বীকার

জাবির সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা মামলায় রায়হানের দোষ স্বীকার

গণহত্যাকারী কোন রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করার অধিকার থাকে না: আসাদুজ্জামান রিপন

গণহত্যাকারী কোন রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করার অধিকার থাকে না: আসাদুজ্জামান রিপন

ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা জন্য আমাদের লড়াই চলছে : গয়েশ্বর চন্দ্র রায়

ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা জন্য আমাদের লড়াই চলছে : গয়েশ্বর চন্দ্র রায়

ইনসি ইকো প্লাস সিমেন্ট নিয়ে এলো বাংলাদেশের সমূদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের উপযোগী করে দীর্ঘস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের সমাধান

ইনসি ইকো প্লাস সিমেন্ট নিয়ে এলো বাংলাদেশের সমূদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের উপযোগী করে দীর্ঘস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের সমাধান

হাত-পা ও চোখ বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানো হয় --- আবু বাকের

হাত-পা ও চোখ বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানো হয় --- আবু বাকের

দৈনিক রাজবাড়ী কন্ঠে" প্রকাশকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ফরিদপুর সাংবাদিক জোটের প্রতিবাদ সভা

দৈনিক রাজবাড়ী কন্ঠে" প্রকাশকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ফরিদপুর সাংবাদিক জোটের প্রতিবাদ সভা

ডাটা সেন্টারের সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদ তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার

ডাটা সেন্টারের সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদ তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার

শ্রীলঙ্কার চীনপন্থি প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে কি ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ?

শ্রীলঙ্কার চীনপন্থি প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে কি ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ?

ফুটবলের মাঠে চমক দেখাতে চান তাবিথ আউয়াল

ফুটবলের মাঠে চমক দেখাতে চান তাবিথ আউয়াল

এবার ফাঁস হলো রাবি শিবির সভাপতির পরিচয়

এবার ফাঁস হলো রাবি শিবির সভাপতির পরিচয়

নদী দখলকারীদের উচ্ছেদে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে - পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

নদী দখলকারীদের উচ্ছেদে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে - পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম কারাগারে

সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম কারাগারে

স্বৈরাচারের পতন হলেও দোসররা এখনো রয়ে গেছে : তারেক রহমান

স্বৈরাচারের পতন হলেও দোসররা এখনো রয়ে গেছে : তারেক রহমান

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক গ্রেফতার

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক গ্রেফতার