এ যেন টাইম বোমা!
০৩ মার্চ ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২৪, ১২:০২ এএম
রাজধানীর অধিকাংশ এলাকাজুড়েই রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ অসংখ্য রেস্টুরেন্ট। বাইরে চাকচিক্য হলেও ভেতরে মৃত্যুফাঁদ। আবাসিক ভবনে রেস্তোরাঁ ব্যবসার অনুমোদন না থাকলেও নিয়ম ভেঙে গাদাগাদি করে চলছে নামিদামি এ সব রেস্টুরেন্ট। জরাজীর্ণ ভবনে ছোট্ট সিঁড়িই আসা যাওয়ার একমাত্র পথ, কোনো কোনো জায়গায় সেটিও বন্ধ থাকে। কাচঘেরা এসব রেস্টুরেন্ট যেন এক একটি মৃত্যুপুরী। প্রতিটি রেস্টুরেন্টে ঝুঁকিপূর্ণভাবে একাধিক সিলিন্ডার পাশাপাশি রেখে ডজনখানেক চুলায় দিনভর চলে রান্না। রাজধানীর অসংখ্য রেস্টুরেন্টের একটি বেইলি রোডে আগুন লাগা গ্রিন কজি কটেজ লাগোয়া আরেকটি ভবন গোল্ডেন প্যালেসে বড় বড় সব নামিদামি রেস্টুরেন্ট। আবাসিক ভবনটির পঞ্চম তলা জুড়েই রয়েছে রেস্টুরেন্টসহ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, একটির সঙ্গে আরেকটি লাগোয়া। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেল, নিচ থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত ওঠার সিঁড়ি একেবারেই সরু। সিঁড়ির পাশেই রাখা আছে নানা সামগ্রী। নগরীর বিভিন্ন্ এলাকায় শত শত ভবনে হাজার হাজার রেস্টুরেন্ট মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে এভাবেই চলছে।
সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বারবার সতর্কতার কথা বলা হলেও কেন মানা হচ্ছে না প্রয়োজনীয় নির্দেশনা? ‘কারা কিসের বলে সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করছে’, ‘তদারককারী সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কী করে’, ‘ঘটনার পরই কেন তারা নড়েচড়ে বসে’, ‘মুনাফালোভী অপরাধীরা মানুষের জীবনের পরোয়া না করেই কীভাবে নিজেদের বাণিজ্য চালিয়ে যায়’, এমন অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খায় প্রতিটি মৃত্যু মিছিলের পর। এই মৃত্যুর দায় কার? কেউ নিতে চায় না। কেন নিতে চায় না তার কোনো উত্তর নেই। অথচ রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও বিস্ফোরক পরিদপ্তরের দায় রয়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবীব বলেন, ৬টি সংস্থা এসব অবৈধ রেস্টুরেন্ট ও ভবনের দায় নিতে বাধ্য, কোনোভাবেই তারা এমৃত্যুর দায় এড়াতে পারে না। ঢাকা শহরে সবগুলো রেস্টুরেন্টেরই একই অবস্থা। যে কার্যক্রম চালানো হবে, সে অনুযায়ী ভবনের নির্মাণ-কাঠামো ও নকশা করতে হয়। ইচ্ছা করলেই বাণিজ্যিক বা আবাসিক ভবনে রেস্তোরাঁ করার কোনো সুযোগ নেই। রেস্তোরাঁর জন্য যে ধরনের রান্নাঘর দরকার হয়, তা সাধারণ বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য তৈরি করা ভবনে থাকে না। রেস্তোরাঁর রান্নাঘরের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার দরকার হয়।
তিনি বলেন, খিলগাঁও, বনানী ও ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকায় অনেক বহুতল ভবনে রেস্তোরাঁ তৈরি করা হয়েছে। সেসব ভবনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কতটুকু মেনে চলা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অগ্নিনিরাপত্তার প্রথম শর্ত অনুযায়ী উন্মুক্ত স্থানে সিলিন্ডার রাখার সুযোগ নেই। আর ভবনের জরুরি নির্গমন (ফায়ার এসকেপ) পথেও এ ধরনের সিলিন্ডার রাখা যাবে না। অথচ গ্রিন কোটি কটেজ ভবনটির জরুরি নির্গমন পথে রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার সজ্জিত করে রাখা ছিল। তবে সেগুলো ব্লাস্ট (সিলিন্ডার বিস্ফোরণ) করেনি। যদি কোনো কারণে ওই সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলে আগুন পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ত বলে জানান এ স্থপতি।
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলালউদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, শাস্তি পেতে আপত্তি নেই, তবে যারা দেখভালের দায়িত্বে তাদেরও জবাবদিহির আওতার আনা উচিত। যেসব রেগুলেটরি বোর্ডে এ ভবনে ব্যবসার অনুমতি দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিক।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও সাধারণ মানুষ বলছেন, পুরান ঢাকার নিমতলী, চকবাজারের চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ার, কড়াইল বস্তি, পল্লবী বস্তি, বঙ্গবাজার, নিউমার্কেট, গুলশান সিটি কর্পোরেশন মার্কেট, অতি সম্প্রতি কারওয়ান বাজার বস্তি থেকে সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের গ্রিণ কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এই শহরের বিপর্যয়ের এক একটি উপাখ্যান। যেন এক একটি মৃত্যুর মিছিল। প্রতিটি ঘটনার পর মিডিয়া-টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকায় উঠে আসে নানা বিশ্লেষণ। উঠে আসে অনিয়মের শত ফিরিস্তি। কিছুদিন পর সবাই ভুলে যায়। একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনাকে ভুলিয়ে দেয়। এভাবে ট্রাজেডির পর ট্রাজেডি হলেও মানুষের হাতে গড়ে ওঠা শহরটা মানুষের জন্যই দিন দিন আরও বেশি অনিরাপদ হয়ে হয়ে উঠছে। শত শত মায়ের বুক খালি হলেও এর দায় নিতে চায় না কেউ। ক্ষোভ, আক্ষেপ, হতাশা, নিরাশার মাঝে ব্যবস্থা, শাস্তি, ক্ষতিপূরণ আর আশার বাণীর মধ্য দিয়ে হারিয়ে যায় প্রাণের অস্তিত্ব। আবার ব্যস্ত হয়ে যায় যে যার মতো। অনিয়মগুলোও চলতে থাকে অবলীলায়, দেদারসে। অথচ অনিয়মের ফলে একের পর এক দুর্ঘটনায় বলি হয় খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। পরিবারের উপার্জনের সম্বল কিংবা স্বজন হারিয়ে নিভৃতে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না কারো। এভাবে অনিরাপদÑঅস্বাভাবিক মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়েই প্রতিটি ভোরে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও চষে বেড়ায় রাজধানী ঢাকার অলিগলি। ব্যস্ততার শেষ হয় না রাতের গভীর অবধি। কখনো কখনো আলো ঝলমলে রাতেই নেমে আসে নির্মম ঘুটঘুটে অন্ধকার। গত বৃহস্পতিবার এমনি একটি নির্মম কালো রাত দেখল রাজধানীবাসী।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাঈন উদ্দিন জানান, আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন নির্মিত এই ভবনটিতে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। প্রতিষ্ঠানটিকে নোটিশও দেয়া হয়েছিল। এ ভবনের একটি মাত্র সিঁড়ি এবং ভবনটিতে কোনো ফায়ার সেফটি প্ল্যান্ট ছিল না। যে কারণে ক্ষয়ক্ষতিসহ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ঢাদসিক) মেয়র ব্যরিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, রাজধানীতে ভবন নির্মাণে ইমারত বিধিমালাগুলো ন্যক্কারজনকভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তদারকি হচ্ছে না। বিভিন্নভাবে নকশা অনুমোদন করা হচ্ছে। কিন্তু সেসব নকশায় ইমারত বিধিমালা মানা হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, অনেক ক্ষেত্রে নকশা ঠিক থাকলেও যখন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, তখন অনিয়ম করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের শুধুমাত্র অফিসিয়াল স্পেস হিসেবে ব্যবহারে রাজউকের অনুমোদন ছিল। কিন্তু নিয়ম ভঙ্গ করে এখানে আটটি রেস্টুরেন্ট, একটি জুস বার, কফি শপ ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রীর দোকান ভাড়া দেয়া হয়েছিল। ভবন নির্মাণ বিধিমালা ও নগর পরিকল্পনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে এটা করা হয়েছে। ভবনটিতে কার্যকর কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ও পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ভবনমালিক ও ভবনের ব্যবহারকারীদেরকে বারবার নোটিশ দিয়েই দায় সেরেছে।
এ ঘটনায় রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও বিস্ফোরক পরিদপ্তরের দায় থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগের আগুনের ঘটনায় কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে দায়িত্বে অবহেলার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। একের পর এক এ ধরনের ঘটনার পেছনে এটি আরেকটি বড় কারণ।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ছাত্র শ্রমিক জনতার গণঅভ্যুত্থানে নিহত ও আহত পরিবারসমূহের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করুন : সাইফুল হক
দুর্গাপূজায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা থাকবে : আইজিপি
নব-নির্বাচিত শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট অনুরা কুমারা-কে বাংলাদেশ ন্যাপ'র অভিনন্দন
ছাত্র - জনতার গনবিপ্লবে সংগঠিত সকল গনহত্যায় জড়িত শেখ হাসিনার বিচার চাই [ সৈয়দ ফজলুল করিম ]
লেবাননে ইসরাইলের হামলা যুদ্ধবিস্তারের প্রচেষ্টা : এরদোগান
সীতাকুণ্ডে সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত জামায়াত নেতার জানাজা সম্পন্ন
সিংগাইরে মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে নিখোঁজের ৩ দিনপর এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার
রপ্তানিতে বাংলাদেশকে বড় সুখবর দিলো চীন
পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটিতে আলেম ও ইসলামী স্কলার অন্তর্ভুক্ত করুন
প্রবাসী কর্মী ও রাষ্ট্রকে জিম্মি করে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করছে রুহুল আমিন স্বপন
বগুড়ায় এক পশলা বৃষ্টি, জনমনে স্বস্তি...
পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত করার চক্রান্ত সম্মিলিত ভাবে রুখে দিতে হবে
নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে চীনের ব্যাপক সাফল্য
যৌথবাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার ‘ছাত্র হত্যাকারী চেয়ারম্যান’কে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা
মির্জাপুরে বন্ধুদের সঙ্গে নদীতে গোসলে নেমে স্কুল ছাত্রের মৃত্যু
কক্সবাজারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার মিছিলে গুলি বর্ষণকারী চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ গ্রেপ্তার -ছড়িয়ে নিতে সন্ত্রাসীদের থানায় হামলা
ভ্রমণে সঙ্গী সাপ! হুলুস্থুল কাণ্ড চলন্ত ট্রেনে
এপিসি থেকে ফেলা ইয়ামিনকে হত্যায় হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ
যবিপ্রবির ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ড. জাকিরের মতবিনিময়
ফ্যাসিবাদের দোসর গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি উপদেষ্টা নাহিদের কড়া বার্তা