কমেছে গমের আমদানি
০৩ মার্চ ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২৪, ১২:০৭ এএম
ধানের পর গমই হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে গমের বহুবিধ ব্যবহার দিন দিন বেড়েছে। তবে সে অনুপাতে এর উৎপাদন বাড়েনি। দেশে উৎপাদন কম হওয়ায় চাহিদার প্রায় সিংহভাগই পূরণ করতে হয় আমদানির মাধ্যমে। তবে করোনামহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী গমের দাম বেড়ে যায়। আর দ্রুতই এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের বাজারে। দেশে চলমান ডলার সঙ্কটও আমদানিতে বড় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। এতে গমের আমদানি যেমন অনেকটাই কমেছে তেমনি আটার দামও বাজারে হু হু করে বাড়ছে। আর আটার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে গভীর সঙ্কটে পড়ছে বেকারি ব্যবসা। সেই সাথে রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এক বছরের ব্যবধানে আটার দাম দ্বিগুণ হলেও বেকারি পণ্যের দাম সে অনুপাতে বাড়ানো সম্ভব হয়নি। এতে হুমকির মুখে পড়েছে পুরো খাত। টিকে থাকার লড়াই করলেও আটার দাম না কমলে শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে সারা দেশে হাতের তৈরি বেকারি পণ্যের সাত হাজার কারখানার ২০ লাখের অধিক শ্রমিক কর্ম হারানোর শঙ্কায় রয়েছে।
মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে গত ১ যুগেরও বেশি সময় ধরে ভাতের পরিবর্তে অনেকে রুটি খাচ্ছিলেন। কিন্তু আটার দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে এখন আবার অনেকে রুটির পরিবর্তে ভাতের দিকে ঝুঁকছেন। পরিসংখ্যান বলছে, গত চার বছরে দেশে গমের ব্যবহার কমেছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সাম্প্রতিক প্রায় প্রতি বছরই গম আমদানি কমছে। গত অর্থবছরে গমের আমদানি হয় ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার টন। আগের অর্থবছর হয়েছিল ৪০ লাখ ১২ হাজার টন। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৩ লাখ ৪৩ হাজার ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৪ লাখ ৩৪ হাজার টন গম আমদানি হয়। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এ খাদ্যপণ্যটি আমদানি হয়েছে ২০ লাখ ৬ হাজার টন।
দেশে গত এক দশকে ধানের উৎপাদন অনেক বাড়লেও গম উৎপাদন আটকে আছে আগের জায়গাতেই। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট গম উৎপাদন হয় ১১ লাখ ৭০ হাজার টন। ২০২১-২২ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ১০ লাখ ৮৫ হাজার টন করে। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে হয় ১০ লাখ ২৯ হাজার টন। উৎপাদন ও আমদানি মিলিয়ে দেশে গত অর্থবছরে মোট গম ব্যবহার হয় ৫০ লাখ ৪৫ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৭৪ লাখ ৬৩ হাজার টন। অর্থাৎ চার বছরের ব্যবধানে খাদ্যপণ্যটির ব্যবহার কমেছে ৩২ দশমিক ৪০ শতাংশ। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি নির্ভর হওয়ায় চালের চেয়ে দেশে গমের দাম দেড় বছরের ব্যবধানে অত্যধিক বেড়েছে। ফলে বেশি দাম হওয়ায় অনেকেই গম থেকে উৎপাদিত পণ্য খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক খাদ্য সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল ইনকিলাবকে বলেন, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গম সরবরাহে সংকট তৈরি হয়েছিল। এতে দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেকেই গম ছেড়ে অর্থাৎ আটা ছেড়ে আবার চালে ফিরে আসছে। দুই-তিন বছর আগেও মোটা চাল যখন ৪০ টাকা ছিল তখন আটা বিক্রি হতো ৩০ টাকা কেজি। এখন আটার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকায়। অন্যদিকে মোটা চালের দাম ৪৮-৫০ টাকা কেজি। তাই মানুষ রুটি ছেড়ে ভাত খাচ্ছে। ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন ও গমের মূল্যবৃদ্ধির কারণেই গমের চাহিদা কমেছে। এ কারণে আমদানিও কমেছে।
দেশে গমের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই বেকারি, হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোয় ব্যবহার হয়। বেকারি-জাতীয় পণ্য যেমন পাউরুটি, বিস্কুট, কেকসহ নানা ধরনের পণ্য তৈরি হয় আটা ও ময়দা থেকে। তবে বাংলাদেশ রুটি-বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারী সমিতির তথ্য বলছে, আটা ও ময়দার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়েছে। তবে সেটা আটা-ময়দার দাম যে হারে বেড়েছে সে তুলনায় অনেক কম। গত এক বছরে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হলেও পণ্যের দাম সে অনুপাতে বাড়ানো সম্ভব হয়নি। আগে একটি রুটি তৈরিতে যে খরচ হতো এখন তার দ্বিগুণ খরচ হচ্ছে। কিন্তু দাম বেড়েছে ১০-২০ শতাংশ। আর দাম বাড়ার কারণে বিক্রি কমেছে প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ। এভাবে ব্যবসা টিকানো কঠিন। প্রতিদিন খরচ বাড়ছে কিন্তু আয় বাড়ে না। দেশে ছোট-বড় প্রায় সাত হাজার বেকারি রয়েছে। এর মধ্যে কিছু বেকারি খরচের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে আরো প্রায় ২০ শতাংশ বেকারি।
বাংলাদেশ রুটি-বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল হক রেজা ইনকিলাবকে বলেন, গম ও অন্যান্য উপাদানের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সব ধরনের বেকারিপণ্যের দাম বেড়েছে। এতে প্রায় সব আইটেমেরই বিক্রি কমেছে। অনেক বেকারি বন্ধ হয়ে গেছে। আবার অনেকগুলো বন্ধ হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যেহেতু অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে তাই মানুষ এখন বেকারি আইটেম কিনছে কম।
এদিকে রুটি, পরোটা, পুরি, শিঙাড়া, সমুচাসহ নানা ধরনের খাদ্য তৈরি করতে হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোয়ও উল্লেখযোগ্য হারে গম ব্যবহার হয়। তাদেরও বিক্রি কমে গেছে বলে জানিয়েছেন মালিকরা। বাংলাদেশ হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির হিসাবে, দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ হোটেলের ওপর কোনো না কোনোভাবে প্রতিদিন নির্ভরশীল। তবে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে রেস্তোরাঁয় ৩৫-৪০ শতাংশ বিক্রি কমেছে। আর মূল্যবৃদ্ধির কারণে আটা ও ময়দা থেকে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই মূলত দেশের বাজারে আটা ও ময়দার দাম বাড়তে থাকে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয় দাম। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, ২০২২ সালের মার্চে প্রতি কেজি খোলা আটা ৩৫-৩৬ টাকা, প্যাকেট আটা ৪০-৪৫, খোলা ময়দা ৪৭-৫০ ও প্যাকেট ময়দা ৫২-৫৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। একই সময়ে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৪৬-৪৮ ও মাঝারি আকৃতির চাল ৫২-৫৫ টাকা। অর্থাৎ আটা ও ময়দার দাম তখনো চালের চেয়ে কম ছিল। বর্তমানে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা আটা ৫০, প্যাকেট আটা ৬০-৬৫, খোলা ময়দা ৬৫-৭০ ও প্যাকেট ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকায়। আর প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৮-৫০, মাঝারি চাল ৫৫-৫৮ ও সরু চাল ৬৫-৭৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সরকারি ও বেসরকারি দু’ভাবেই দেশে গম আমদানি হয়। বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সরকার গম আমদানি করে। তাই গত কয়েক বছরে এ খাতে সরকারের আমদানি কমেনি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারিভাবে ৬ লাখ ৭৯ হাজার টন গম আমদানি হয় আর বেসরকারিভাবে আমদানি হয় ৩১ লাখ ৯৫ হাজার টন। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে ছয় লাখ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ লাখ ৫০ হাজার ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ লাখ ৫০ হাজার টন গম আমদানি হয় সরকারিভাবে। সে হিসেবে মোট আমদানির সিংহভাগই হয় বেসরকারি খাতের মাধ্যমে।
খাদ্য অধিদপ্তরের সরবরাহ, বণ্টন ও বিপণন বিভাগের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকারিভাবে গম ও চাল দুটোরই বিতরণ বেড়েছে। প্রতি বছরই আমাদের বাজেট বাড়ছে। সে আলোকে আমাদের বিতরণ কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে গমের উচ্চমূল্য ও দেশে ডলার সংকটে ঋণপত্র জটিলতাসহ নানা কারণে গম আমদানি কমছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রামভিত্তিক বড় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বাশার চৌধুরী বলেন, প্রথমত, ডলারের অপ্রতুলতা থাকায় বেশির ভাগ ব্যাংক এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশীয় কারেন্সিতে যে যে ফ্যাসিলিটি আগে ছিল সেটা এখন নেই। ডলারের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির কারণে টাকায় আমাদের কারেন্সি হিসাবে ৩০ শতাংশ কম আমদানি করতে পারছি। বড় আমদানিকারকরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এতে। আর আমরা ভোগ্যপণ্য এনে তো বিক্রি করে ফেলি। ডলার সেটলমেন্ট করতে যাই আরো পরে। পণ্য কেনার সময় যে টাকা ডলার ধরে ঋণপত্র খুলেছি, সে হিসাবে পণ্য বিক্রিও হয়েছে। কিন্তু ঋণপত্র নিষ্পত্তি করতে গিয়ে যখন ডলারপ্রতি অনেক বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে তখন মূলধন ঘাটতিতে পড়ে যেতে হচ্ছে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
আড়াইহাজার উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান স্বপন গ্রেফতার
চোটে ছিটকে গেলেন রাসেল, নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফিরলেন জোসেফ
তারাকান্দায় অজ্ঞান পার্টির নারী সদস্য গ্রেফতার
টেস্ট দলে শান্তর জায়গায় শাহাদাত
যশোর সেনানিবাসে কোর অব সিগন্যালস এর অধিনায়ক সম্মেলনে সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান
রাশিয়ান ড্রোন হামলার তীব্রতায় ইউক্রেনের সাধারণ পরিবারগুলো বিপর্যস্ত
ছাত্রদলের সহায়তায় রাবিতে ভর্তির স্বপ্ন পূরণ আবু সাইফের
জলবিদ্যুৎ ভাগাভাগিতে দক্ষিণ এশিয়া গ্রিড তৈরির প্রস্তাব ড. ইউনূসের
ঝিকরগাছায় নিখোঁজ শিশুর লাশ মিলল বাঁশ বাগানে
যশোরে ডা. শামা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে মানববন্ধন
ইনু-সাদেক খান ও সলিমুল্লাহ নতুন মামলায় গ্রেফতার
"খুনসুটি" নিয়ে ছোট পর্দার ফিরছেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী তানজিন তিশা এবং খায়রুল বাসার"
কন্যার ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে মুজিবের ছবি সরানো হয়েছে : মাহফুজ আলম
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার বেলগাছীতে সবুজ নামের এক যুবককে মোটরসাইকেলসহ পুড়িয়ে হত্যা
টাঙ্গাইলে নিরাপদ সড়কের দাবীতে রাস্তায় শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী
ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ জাতিকে বিভক্ত করেছে, আমরা বিভক্তি দুর করে এক্যবদ্ধ জাতী চাই- ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপির মহাসচিব
আগ্নেয়গিরির ছাইয়ের কারণে অস্ট্রেলিয়া-বালি ফ্লাইট বন্ধ
১০০০ গোলের স্বপ্ন এখনও দেখছেন রোনালদো?
কুয়াকাটায় রাস উৎসবের শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি, সাজ সাজ রব
কাপ্তাইয়ের ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি সীতাকুণ্ড হতে গ্রেপ্তার