ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধূলায় ঢেকেছে
০৪ মার্চ ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২৪, ১২:০১ এএম
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ধূলার কারণে একদিকে বাড়ছে জনভোগান্তি, অন্যদিকে রোগবালাই। বলতে গেলে সারা বছর ধরেই ধূলার রাজত্ব চলে মহাসড়কটিতে। এ নিয়ে যাত্রীসাধারণের দুর্ভোগের কোনো অন্ত না থাকলেও সমস্যা সমাধানের যেন কেউ নেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক যেন ধূলার রাজত্ব। একটু দূরের যানবাহনও দেখা মুশকিল। পুরো মহাসড়কে বাতাসেই ধূলা আর ধোঁয়ার অত্যাচার। বছরের পর বছর ধরে ঢাকনাবিহীন খোলা ডাম ট্রাকে অবাধে বালু ও মাটি পরিবহন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ধূলা ছড়াচ্ছে চারদিকে। শুষ্ক মৌসুমে কোথাও যেন এতটুকু প্রাণ নেই। নাক-মুখ চেপে রাস্তায় চলাচল করতে হচ্ছে পথচারীদের। অত্যাধিক বায়ুদূষণের ফলে প্রভাব পড়ছে জনজীবনেও। এতে হাসপাতালে বাড়ছে শ্বাসকষ্টজনিত রোগীর সংখ্যা।
পরিবেশবিদরা বলছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের খোলা ড্রামট্রাকে বালু পরিবহনের কারণে মহাসড়কের পাশের বাতাস অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠছে। গত বছর মোট ৯ দিন বায়ুর মান দুর্যোগপূর্ণ ছিল, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। একিউআই স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচনা করা হয়। আর ৩০১-এর বেশি হলে তা দুর্যোগপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। বায়ুদূষণ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। এটা সব বয়সী মানুষের জন্য ক্ষতিকর। তবে শিশু, অসুস্থ ব্যক্তি, প্রবীণ ও অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য বায়ুদূষণ খুবই ক্ষতিকর। নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি ও মার্চ বছরের এই পাঁচ মাস বায়ু বেশি দূষিত থাকে।
মহাসড়ক পথেই চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে দেশের সিংহভাগ আমদানি-রফতানির কাজ হয়। এছাড়া পর্যটন এলাকা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কাপ্তাই, রামগড়, কক্সবাজার, টেকনাফ ও দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ভ্রমণে দেশ-বিদেশের অধিকাংশ দর্শনার্থীদের যাতায়াতের প্রধান ও একমাত্র সড়ক পথের যোগাযোগ এই মহাসড়ক হয়েই। তাছাড়া রাজধানী ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, দিনাজপুরসহ দেশের উত্তর-পশ্চিামাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াত করছে মানুষ এই সড়ক পথে। প্রতিদিন এই মহাসড়ক পথে কমপক্ষে ৩০ হাজার বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, লং ভেহিকেল, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস চলাচল করে। মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের আশপাশে রয়েছে জেলার দাউদকান্দি, চান্দিনা, বুড়িচং, কুমিল্লা আদর্শ সদর, সদর দক্ষিণ, চৌদ্দগ্রাম উপজেলা। এসব উপজেলার বিভিন্নস্থানে থাকা ইটভাটা, হাউজিং প্রকল্প, ব্যক্তিগত বাসাবাড়ি নির্মাণ বা নিচু জমি ভরাটের কাজে শুষ্ক মৌসুমে প্রতিদিনই এই মহাসড়ক হয়ে উল্লেখিত উপজেলা ছাড়াও আশপাশের বিভিন্নস্থানের ফসলী জমি, গোমতী নদীর ভিতরসহ বিভিন্নস্থানের খাল, পুকুর থেকে মাটি এবং গোমতী ও মেঘনা নদী থেকে বালু সংগ্রহ করা হচ্ছে। এসব মাটি, বালু প্রতিদিনই ড্রাম ট্রাকে করে মহাসড়ক হয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে। ঢাকনা বিহীন ড্রাম ট্রাকে অতিরিক্ত মাটি বা বালু নিয়ে বেপরোয়া গতিতে চালানোর ফলে এসব বালু, মাটি বাতাসে উড়ছে। এতে চলন্ত যানবাহনের চালক, যাত্রীসহ পথচারীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচলকারী একাধিক পরিবহনের বাস চালক ও যাত্রীরা দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, চলন্ত ট্রাক থেকে উড়ে আসা বালুর কারণে বাসের জানালা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। অতিরিক্ত মাটি ট্রাক থেকে পড়ে মহাসড়কের বিভিন্নস্থানে মাটির স্তপ জমছে প্রতিদিন। মহাসড়কে চলাচলকারী রয়েল কোচ পরিবহনের যাত্রী আমির হোসেন বলেন, প্রতি সপ্তাহে আমি এই পথে চলাচল করি। খোলা ট্রাকে বালু মাটি পরিবহনে তীব্র বায়ু দুষনের কবলে পড়তে হয় যাত্রী ও চালকদের। তিনি আরও বলেন, প্রায়ই বাসের জানালা বন্ধ রাখতে হয়। এভাবে কুমিল্লা অংশে মাটি ও বালু পরিবহনে মহাসড়কের ফোরলেনের দু’পাশ জুড়ে বালু’র স্তুপের পাশাপাশি সড়কের উপরেও অনেকস্থানে মাটির চিহ্নে বিবর্ণ হয়ে গেছে মহাসড়ক। কালে ভদ্রে মহাসড়কের ফোরলেনের রোড ডিভাইডারের পাশ থেকে ময়লা-আবর্জনাসহ বালু সরালেও দু’পাশের মাইলের পর মাইলজুড়ে শুধু বালি আর ময়লা আবর্জনা। এতে বায়ু দুষনের কবলে পড়ে এই অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা সহজেই আমাদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে ভেতরে প্রবেশ করে মানবদেহের ক্ষতি করে। ক্ষতিকর এই উপাদান শ্বাস-প্রশ্বাসের সাহায্য ছাড়াও চোখ দিয়েও ঢুকে যেতে পারে। এটি এখন বিশ্বের বৃহত্তম পরিবেশগত স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বায়ুদূষণের তালিকায় ২০২০ ও ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে ছিল। সেই বছর বাতাসে পিএম ২ দশমিক ৫-এর ঘনত্ব ছিল ৭৭ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে এর মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৮৩ দশমিক ৩ ও ৯৭ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২১ সালে বাংলাদেশের বাতাসে অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণার পরিমাণ কম দেখে অনেকেই মনে করতে পারেন, উন্নতি হয়েছে। কিন্তু উন্নতি নয়, বরং আগের চেয়ে অবনতি হয়েছে। কেন না বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা শেষে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাতাসে ২ দশমিক ৫-এর ঘনত্বের পরিমাণে বা মানদন্ডে পরিবর্তন এনেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাটি।
পরিবেশ দিবস পালন ছাড়া সারা বছর কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। বছরজুড়ে ঢাকা-চট্রগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় সেবাদানকারী সরকারি সংস্থা তাদের প্রয়োজনে সড়ক খুঁড়ে থাকে। এসব সংস্থার মধ্যে নেই কোনো সমন্বয়, ফলে একই মহাসড়ক বার বার খুঁড়তেও দেখা যায়। এমনকি ভালো সড়কগুলোও মাঝে-মধ্যে খুঁড়তে দেখা যায় রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোতে। এই যেমন ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাড়কের দাউদকান্দি ট্রোল প্লাজা এলাকায় খুঁড়ে কাজ করা হয়েছে সপ্তাহ খানেক আগে। কিন্তু সেখানে কার্পেটিং করা হয়নি। মহাসড়ক সংস্কার না করায় এলাকা ধুলার রাজ্য। সকাল থেকে রাত সবসময় ধুলায় ধুসর হয়ে থাকে চারপাশ।
সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে জানিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, একিউআই গড়ে ১৮০ থেকে ২০০ এর মধ্যে ওঠানামা করলেও সামনের সপ্তাহগুলোতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চে বায়ুমানটা বেশি খারাপ থাকে। তিনি জানান, শীতে বায়ুদূষণের উৎসগুলো কার্যকর থাকে। বাতাসের গতিবেগ কম থাকে বলে দূষিত বায়ুর স্তর সরতে সময় নেয়। বৃষ্টি হয় না বলে বাতাস পরিষ্কার হয় না। বাতাসে অনেক ধুলাবালি থাকলে সেটা ফুসফুসের ক্ষতি করে। তখন যেকোন ক্ষতিকর ভাইরাস বিস্তৃতি লাভ করতে সুবিধা হয়। আর এক্ষেত্রে নিদান বলতে সেই মাস্ক। মহাসড়কে যে ধুলাবালি উড়ছে তাতে মাস্ক পরা উচিত।
দূষণের কারণে নভেম্বর থেকে ফুসফুসের রোগগুলোতে মানুষ বেশি আক্রান্ত হয় বলে জানান জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মির্জা মোহাম্মদ হিরন। তিনি বলেন, ফুসফুসের জন্য বায়ুদূষণ অনেক বেশি ক্ষতিকর। নিঃশ্বাসের সাথে দূষিত কণা আমাদের ফুসফুসে প্রবেশ করে। সেগুলো অনেক জটিলতা তৈরি করতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের সঠিক উদ্যোগের কারণে ধুলার সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। নগর পরিকল্পনাবিদ কামরুল হাসান খান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ধুলাসহ অনিয়ন্ত্রিত অবকাঠামো উন্নয়ন ও যানবাহনের কারণে বায়ুদূষণ বাড়ছে। নির্মাণকাজ ঢেকে রাখা, নির্মাণ এলাকায় নিয়মিত পানি দেওয়া গেলে ধুলা কমানো সম্ভব। শুনেছি বায়ুদূষণ বিধিমালা কার্যকর হয়েছে। এ বিষয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও করা হয়েছে। দ্রুত এই কমিটির মাধ্যমে বায়ুদূষণ প্রতিরোধে নির্দেশনা ও করণীয় বিষয়ে ঠিক করে দেওয়া উচিত।
এ বিষয়ে বায়ু দূষণ বিষয়ক গবেষক আব্দুল মতিন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, উন্নয়নকাজের ধুলায় নগরবাসী কষ্ট পাবে সেটি কাম্য নয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার সময় এসব বিষয় শর্ত দিলেও তারা তা মানতে চায় না।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
কুড়িগ্রামের উলিপুরে থেতরাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদ শূন্য ঘোষণা
সাবেক শ্রীমঙ্গল উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা ভানু লাল রায় কারাগারে
ভারতে ইলিশ রপ্তানি করা হচ্ছে, উপহার নয় : রিজওয়ানা হাসান
কোনো উন্নয়ন কাজ বন্ধ করেনি বর্তমান সরকার: উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন
মাগুরায় মাজলিসুল মুফাসসীরিনের জেলা সম্মেলনে ১১সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন
সাকিবের চোট নিয়ে যা বললেন হান্নান
গুমের ঘটনায় শেখ হাসিনা-কামালসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ
অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে ভোলার বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারীরা। ভোগান্তিতে গ্রাহকরা।
ছুটির দিনসহ সপ্তাহে ৭ দিনই শিক্ষার্থীদের জন্য বাসে ‘হাফ ভাড়া’
রাজবাড়ীতে সাবেক রেলমন্ত্রীর ভাই কারাগারে
শিবগঞ্জে যুব-স্বেচ্ছাসেবকদলের ২ নেতা জখমের ঘটনায় গ্রেপ্তার ১
চৌগাছায় প্রতিমা তৈরীতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগরেরা
মজিব সভাপতি, সাইফুল সম্পাদক নাঙ্গলকোট প্রেসক্লাবের কমিটি গঠন
রাজধানীতে ট্রাফিক আইনে একদিনে ৮৭০ মামলা, জরিমানা ৩৫ লাখ ৮০ হাজার
তারাকান্দায় বিদ্যুৎপৃষ্টে কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যু
দর্শনায় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল মহাসড়ক অবরোধ
কেপিএম নতুন এমডি মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহ যোগদন
কালীগঞ্জে রাস্তার পাশে পড়ে ছিল অজ্ঞাত লাশ
চীনের মধ্যাঞ্চলের সেতুতে দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত, আহত ৭
শপথ নিলেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে