থামছে না সীমান্ত হত্যা
২৭ মার্চ ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৪, ১২:০৭ এএম
বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কারণে-অকারণে সরকারের মন্ত্রীরা প্রত্যাশা করেন ভারতের সঙ্গে এই বন্ধুত্ব যেন চিরদিন অটুক থাকে। এমনকি বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক মন্ত্রী প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন ভারত পাশে ছিল বলেই তারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন। দেশের মানুষ যখন ভারতীয় পণ্য বর্জন প্রচারণা চালাচ্ছেন তখন ওই মন্ত্রীরা ভারতীয় পণ্য বর্জনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। ভারতের গুনগানে বর্তমান সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা যখন এত মত্ত তখনই সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বিএসএফের হাতে বাংলাদেশের নাগরিকরা প্রাণ হারাচ্ছেন। এমনকি গতকাল মহান স্বাধীনতা দিবসে সীমান্তে বিজিবির হাতে প্রাণ হারিয়েছেন এক বাংলাদেশি।
দুই দেশের মধ্যে চমৎকার বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যেও কোনোভাবেই থামছে না সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা। বিজিবি ও বিএসএফের ডিজি পর্যায়ের সম্মেলনসহ দু’দেশের সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে নানা সময়ে সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয় বিএসএফ।
এ ছাড়া সীমান্তে নন-লিথ্যাল উইপন (প্রাণঘাতী নয়) অস্ত্র ব্যবহারেরও সিদ্ধান্ত হয় দফায় দফায়। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিই কাজে আসছে না। থামছে না সীমান্তে প্রাণহানি। সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৯০ শতাংশই সংঘটিত হয় গুলিতে। পিটিয়ে বা নির্যাতন করে এবং পানিতে ডুবিয়ে মারার ঘটনাও ঘটছে সীমান্তে। অথচ হত্যাকাণ্ড বন্ধে বিজিবির পক্ষ থেকে জোরালো কোনো উদ্যোগ নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। নওগাঁর পোরশা উপজেলায় বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছে আল আমিন নামে এক বাংলাদেশি যুবককে। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে হাপানিয়া সীমান্তের ওপারে ভারতের অভ্যন্তরে কেদারিপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত আল আমিন উপজেলার নিতপুর ইউনিয়নে চক বিষ্ণুপুর কলনী মোড়ের মৃত সিদ্দিকের ছেলে। নিহতের পরিবারের বরাত দিয়ে নিতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামুল হক জানান, সোমবার বিকেলের দিকে আল আমিন বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। এরপর মঙ্গলবার ভোরে স্থানীয়রা জানান যে, ভারতের অভ্যন্তরে আল আমিনকে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ। তবে কেন তাকে হত্যা করা হয়েছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
নওগাঁ ১৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মুহম্মদ সাদিকুর রহমান জানান, ভোরে ভারতের অভ্যন্তরে ফায়ারিংয়ের শব্দ পায় বিজিবি। ঘটনাটি সীমান্ত এলাকার ২৩১/২৩২ নম্বর পিলারের মাঝামাঝি স্থানে ভারতের কেদারিপাড়ার দিকে ঘটেছে। এরই মধ্যে বিষয়টি জানতে পতাকা বৈঠক আহ্বান করে বিএসএফের কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ে চিঠি দেয়া হয়েছে এবং ফোনে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। অন্যদিকে লালমনিরহাটে বিএসএফের গুলিতে আহত হয়েছেন বাংলাদেশি যুবক লিটন পারভেজ। গত সোমবার মধ্যরাতে আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের দীঘলটারী পশ্চিম সীমান্তের ৯২৩ নম্বর পিলারের কাছে ভারতের অভ্যন্তরে এ ঘটনা ঘটে। আহত লিটন দীঘলটারী সাংকাচওড়া গ্রামের মোকছেদুল হকের ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিনের মতো সোমবার রাতে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গরু আনতে ভারতে প্রবেশ করেন একদল গরুর রাখাল। গরু নিয়ে ফেরার পথে কোচবিহার জেলার দিনহাটা কৈমারী বিএসএফ ক্যাম্পের সদস্যরা তাদের ঘিরে ফেলে। এ সময় গরু পাচারকারীরা এলাকায় ফোন করলে লিটন পারভেজসহ ২০-২৫ জন বাংলাদেশি তাদের উদ্ধার করতে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেন। লিটন পারভেজ লাঠি নিয়ে একজন বিএসএফ সদস্যকে ধাওয়া করলে গুলি ছোড়ে বিএসএফ। বাকিরা পালিয়ে ফিরলেও সেই গুলিতে আহত হয়ে ভারতে পড়ে ছিলেন লিটন। পরে তাকে নিয়ে যায় বিএসএফ। কয়েক বছর আগেও এমনভাবে পাচার করতে গিয়ে বিএসএফের রাবার বুলেটের আঘাতে আহত হয়েছিলেন লিটন পারভেজ। বিজিবি লালমনিরহাট ১৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোফাজ্জল হোসেন বলেন, সীমান্তে লিটন নামে একজন যুবক আহত হয়েছেন। তাকে ভারতের এমজি হাসপাতালে ভর্তি করেছে বিএসএফ। সেখানে তার চিকিৎসা চলছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমান্ত হত্যার ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হয়, সেগুলো চিহ্নিত না করে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিলে হবে না। নীতিগত সিদ্ধান্ত মাঠ পর্যায়ে কার্যকর করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণ ফাঁকফোকর থেকে যায়। যার ফলে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড ঘটছেই। হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মধ্যে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিষয়টি জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক দরবারে আনতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে এর সমাধান খুঁজতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল বিজিবির এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, বিজিবি ও বিএসএফয়ের ডিজি পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলনের প্রত্যেকটি সভায় সীমান্তে হত্যা বন্ধের বিষয়টি নিয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়। কমিটমেন্টটাও ওইভাবেই আসে, আমাদের কাউন্টার (বিএসএফ) যারা আছে তাদের পক্ষ থেকে। আসলে সীমান্ত হত্যার সঙ্গে আমাদের সীমান্তের আর্থসামাজিক অবস্থা, লোকজনের জীবনযাত্রার মানসহ অনেক কিছুই সম্পৃক্ত। আমাদের নাগরিকদের গুলি করে হত্যার বিষয়টি আমাদের জন্য খুবই অনাকাক্সিক্ষত। আমরা সবসময় বলি, তারাও প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এটা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বিভিন্ন কারণে সীমান্ত হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, বিগত দিনে সীমান্ত হত্যা নিয়ে শুধু বিএসএফ-বিজিবির ঊর্ধ্বতনদের মধ্যেই বৈঠক হয়নি, দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হতে দেখেছি। তখনও শুনেছি সীমান্ত হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হবে, সীমান্তে মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। কিন্তু তারপরও দেখছি আগের মতোই হত্যাকাণ্ড-নির্যাতন চলছেই। দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখছি দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সীমান্ত হত্যা নির্যাতন ইস্যুটির সমাধান হচ্ছে না। তাই আমি মনে করি, বিষয়টি জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক দরবারে আনতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে এর সমাধান করতে হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, সীমান্ত হত্যার ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হয়, সেগুলো চিহ্নিত না করে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিলে হবে না। নীতিগত সিদ্ধান্ত মাঠ পর্যায়ে কার্যকর করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণ ফাঁকফোকর থেকে যায়। যার ফলে সীমান্ত হত্যা ঘটতেই থাকে। সীমান্তে হত্যা বন্ধ করতে চাইলে নীতিগতভাবে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়; তা মাঠ পর্যায়ে কার্যকর করতে হবে।
সীমান্তের বাসিন্দারা বলছেন, সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার প্রধান কারণ বিএসএফের অতিরিক্ত বল প্রয়োগ। দুই দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো ঘনবসতিপূর্ণ। উভয় দেশের বহু মানুষ নদীভাঙনের কারণে খেত-খামার ও জীবিকা হারিয়েছে। তারা আন্তঃসীমান্ত গবাদি পশু ও পণ্য পাচারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেক ক্ষেত্রে চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে অনেককে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয় বা হত্যা করা হয়। পণ্য পাচারের জন্য শিশুদেরও ব্যবহার করা হয়। কারণ, তাদের ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তবে তারাও সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নওগাঁর পোরশা উপজেলায় একজন জনপ্রতিনিধি গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, বাস্তব চোরাচালান প্রতিরোধের বদলে চোরাকারবারিদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার অনেক অভিযোগ রয়েছে বিএসএফ সদস্যের বিরুদ্ধে। সীমান্তে বিজিবি সদস্যরা যে পরিমাণ মাদকদ্রব্য জব্দ করে, সে তুলনায় বিএসএফের জব্দ করা মাদকের পরিমাণ খুবই কম। এটাই যখন বাস্তবতা, তখন বিএসএফ সদস্যরা চোরাচালান প্রতিরোধের অজুহাতে হত্যা করছে বাংলাদেশি নাগরিকদের।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
গর্ভে থাকা সন্তান মারা গেলে মা-বাবা প্রতিদান প্রসঙ্গে?
হাজীগঞ্জে বিএনপির ২ গ্রুপের সংঘর্ষে কিশোরসহ ৪ জনের অবস্থা গুরুত্বর : আহত ৫০
উত্তরপ্রদেশে নেকড়ের পর এবার রাজস্থানে চিতাবাঘের হামলা, দুদিনে নিহত ৩
কলকাতায় ৪১ দিনের মাথায় কর্মবিরতি প্রত্যাহার জুনিয়র ডাক্তারদের
দুই রাজ্যে সংঘাত, ২৪ ঘণ্টা বন্ধ থাকল পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খণ্ড সীমানা
ডায়নার সঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল দেহ, এবার ধর্ষণে অভিযুক্ত সেই ডোডির বাবা
ভারতে 'এক দেশ এক ভোট’ আয়োজন কতটা সম্ভব হবে?
বৈরুতে ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত ৯
কুমিল্লায় অনুষ্ঠানে দাওয়াত না দেওয়ায় প্রবাসীর ওপর হামলা
এবার হলিউডের সিনেমায় জ্যাকুলিন
৯ বছর পর ভারতীয় প্রেক্ষাগৃহে পাকিস্তানি সিনেমা!
জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন
স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে
‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের
শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি
মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ
দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের
‘হাসিনা ও তার দোসরদের বিচারের আওতায় আনতে হবে’: বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব এ্যানি
ঢাকাস্থ গণচীনের দূতাবাসের প্রতিনিধিদলের ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত