বরেন্দ্র অঞ্চলে ১৬০ ফুট নিচে নেমেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর

খরাপ্রবণ অঞ্চলে সেচ নিয়ে উদ্বেগ

Daily Inqilab রফিক মুহাম্মদ

১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৩ এএম

‘কৃত্রিম বৃষ্টিধারা’ পরিকল্পনা
নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে
এবং ভূ-পৃষ্টের উপরে পানি ধরে
রাখার জন্য পর্যাপ্ত পুকুর খাল সৃষ্টি
করতে হবে -ড. আইনুন নিশাত


ঢাকার পর দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে দ্রুত নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। বিশেষ করে খরাপ্রবণ অঞ্চল যেমন রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ এলাকার ভূ-গর্ভের পানির স্তর গত কয়েক বছরে অস্বাভাবিক নিচে নেমে গেছে। এর ফলে কৃষিতে সেচ নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। শুধু তাই নয় ওই এলাকা তীব্র খাবার পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ওই অঞ্চলের কোন কোন এলাকায় পানির স্তর ১৬০ নিচে নেমেছে। ওই সব এলাকাকে পানির উচ্চ সঙ্কটাপন্ন এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গত বছর ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর ভূপৃষ্ঠ এবং ভূগর্ভস্থ পানি পরিস্থিতি নিয়ে হাইড্রোলজিক্যাল অনুসন্ধান ও মডেলিং শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে পরিস্থিতি আগের চেয়ে দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বাড়ছে পানি সংকটাপন্ন এলাকা। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ২৬ ফুট নিচে। সে সময় সর্বোচ্চ তানোরে পানির স্তর নেমেছিল ৬৮ ফুটে। খাবার পানি, সেচ, মাছ চাষের মতো বিভিন্ন কাজে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় ২০১০ সালে পানির গড় ছিল ৫০ ফুট। ২০২১ সালে ভূগর্ভস্থ পানির গড় আরও নিচে নেমে দাঁড়ায় ৬০ ফুটে। একই বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের একটি স্থানে ভূপৃষ্ঠ থেকে মাটির নিচে পানি নামে ১৫৩ ফুট। গত বছর এই পানির স্তর ১৬০ ফুট নিচে নেমেছে। এ অঞ্চলের ২১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮৭টি ইউনিয়ন অতি উচ্চ ও উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা। পানির স্তর সবচেয়ে বেশি নেমেছে পোরশার ছয় ও নাচোলের চার ইউনিয়নে। অতি উচ্চ পানি সংকটে গোদাগাড়ি, তানোর, গোমস্তাপুর, নিয়ামতপুর ও সাপাহারসহ ৯ উপজেলার ৩৭টি ইউনিয়ন। গবেষণায় ৪০টি ইউনিয়নকে ‘উচ্চ পানি সংকটাপন্ন’ও ৬৫টি ইউনিয়নকে ‘মাঝারি পানি সংকটাপন্ন’ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেন গবেষকরা।
এজাতিসংঘের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। আর ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করা পানির ৯০ শতাংশই ব্যবহার করা হয় সেচ কাজে। উত্তরাঞ্চলে গত কয়েক বছর যাবত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হওয়ায় ভ’-গর্ভের পানি রিচার্জ হচ্ছে না। তাই পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে খাবার পানির সঙ্কটের পাশাপাশি সেচেরও তীব্র সঙ্কট দেখা দিচ্ছে।
খাবার পানি এবং সেচ সঙ্কটের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় রোধে উত্তরবঙ্গের ৭৪ হাজার ৮শ হেক্টর জমিতে ঝরনা সেচ পদ্ধতি বা কৃত্রিম বৃষ্টিরধারা চালুর উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এই সেচ পদ্ধতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কার্যকরী একটি মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হলেও বাংলাদেশে ব্যবহার একেবারেই কম। শুধু চা বাগানে এ পদ্ধতিতে আগে থেকেই পানি দেওয়া হয়। ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার করে স্প্রিংকলার নামক যন্ত্র দিয়ে বৃষ্টির মতো করে জমিতে বা বাগানে পানি ছিটানো হয়। বাগান কিংবা ধানক্ষেতে ১৫০ ফুট দূরত্ব পর্যন্ত দুদিকে বৃষ্টি ধারার মতো পানি ছিটানো যায় এটা দিয়ে। বড় বাগান ও ফসলি ক্ষেতে স্প্রিংকলার দিয়ে পানি দেওয়া সহজ। স্প্রিংকলার ব্যবহার করে ৩৬০ ডিগ্রি বলয়ে ১০ থেকে ১৫ ফুট দূরত্বে ঘণ্টায় চার থেকে ১৬শ লিটার পানি ছিটানো যায়।
উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হালনাগাদকরণ এবং দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলায় বিদ্যমান হালকা সেচ প্রকল্পগুলোর পুনর্বাসন কাজের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার মাধ্যমে এভাবে সেচের পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো)। বাপাউবো থেকে ৯ কোটি ৬৫ লাখ ৫৮ হাজার টাকার একটি সমীক্ষা প্রকল্পের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠালে সম্প্রতি পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়। কমিশনে প্রস্তাব করা হয় কৃত্রিম বৃষ্টিধারা সেচ পদ্ধতি চালুর বিষয়ে। এতে একমত প্রকাশ করে কমিশন। বিষয়টি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্ভব কি না সমীক্ষা করবে বাপাউবো।
ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমাতে চায় বাপাউবো। সেচে কৃত্রিম বৃষ্টিরধারা প্রসঙ্গে বাপাউবোর মহাপরিচালক মুহাম্মদ আমিরুল হক ভূঞা বলেন, সেচে কৃত্রিম বৃষ্টিধারা বা ঝরনার মতো সেচ পদ্ধতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে। বিষয়টি আমাদের দেশে সম্ভব কি না সমীক্ষা করে দেখবো। এটাসহ নানা বিষয় মাথায় রেখেই সমীক্ষা প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে।
স্ট্যাডি প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে প্রকল্প গ্রহণ করা হলে গঙ্গা-কপোতাক্ষ, গড়াই ও ইছামতি নদীর পানির পর্যাপ্ততার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে কি না তা নিরূপণ করতে বলেছে কমিশন। পাশাপাশি ভূমি অধিগ্রহণ কমাতে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ক্যানেল থেকে বারিড পাইপ সিস্টেমের মাধ্যমে সেচ সুবিধা দেওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রকল্পটিতে প্রায় ৭৪ হাজার ৮শ হেক্টর জমিতে সরাসরি গ্রাভিয়েশন ফোর্সের মাধ্যমে সেচ দেওয়া সম্ভব হবে কি না এবং সে অনুযায়ী উন্মুক্ত প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি সেচনালা নির্মাণের সংস্থান রাখার কথা বলা হয়েছে।
পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ইনকিলাবকে বলেন, ভূ- গর্ভস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের বিরুদ্ধে আমরা আরও অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। কিন্তু আমাদের কথায় কর্ণপাত করা হয়নি। এখন সঙ্কট যখন তীব্র আকার ধারণ করেছে তখন ভূ-পৃষ্টের উপরিভাগের পানি ব্যবহার করে ঝরনা সেচ পদ্ধতি বা কৃত্রিম বৃষ্টিরধারা চালুর উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এটা খুবই ভাল উদ্যোগ। তবে এটা কার্যকর করতে হলে পদ্মার পানি এবং এর অন্যান্য শাখা বা সংযোগ নদী যেমন কপোতাক্ষ, গড়াই ও ইছামতির পানি প্রাপ্তির বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। মরনবাঁধ ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মা এখন মৃত। পানিশূন্য কপোতাক্ষ, গড়াই, ইছামতিসহ উত্তরাঞ্চলে সব নদী। এ অবস্থায় কৃত্রিম বৃষ্টিধারার সেচ পদ্ধতি চালু করতে হলে এসব নদীর নাভ্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। এছাড়াও পুকুর খাল সৃষ্টি করে পর্যাপ্ত পানির উৎস নিশ্চিত করতে হবে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

জিম্বাবুয়ে সিরিজের ম্যাচ অফিসিয়ালদের তালিকা প্রকাশ

জিম্বাবুয়ে সিরিজের ম্যাচ অফিসিয়ালদের তালিকা প্রকাশ

মে দিবস উপলক্ষে বেনাপোলে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ

মে দিবস উপলক্ষে বেনাপোলে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ

মধুখালি চোপেরঘাট নিহত দুই সহোদরের বাড়ীতে কেন্দ্রীয় বিএনপির ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল,

মধুখালি চোপেরঘাট নিহত দুই সহোদরের বাড়ীতে কেন্দ্রীয় বিএনপির ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল,

কুড়িগ্রামে সড়কে প্রাণ গেল মাদরাসা ছাত্রের

কুড়িগ্রামে সড়কে প্রাণ গেল মাদরাসা ছাত্রের

গাজায় ধ্বংসস্তূপের নিচে পচছে ১০ হাজার মরদেহ

গাজায় ধ্বংসস্তূপের নিচে পচছে ১০ হাজার মরদেহ

বিকেলে নয়াপল্টনে শ্রমিক সমাবেশ করবে বিএনপি

বিকেলে নয়াপল্টনে শ্রমিক সমাবেশ করবে বিএনপি

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে দখলমুক্ত করতে নিউইয়র্ক পুলিশের ব্যাপক অভিযান

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে দখলমুক্ত করতে নিউইয়র্ক পুলিশের ব্যাপক অভিযান

ট্রুডোকে ‘পাগল’ বলে আখ্যা, কানাডার বিরোধী নেতাকে সংসদ থেকে বহিষ্কার

ট্রুডোকে ‘পাগল’ বলে আখ্যা, কানাডার বিরোধী নেতাকে সংসদ থেকে বহিষ্কার

তীব্র রোদেও নয়াপল্টনে জড়ো হচ্ছে শ্রমিক দলের নেতাকর্মীরা

তীব্র রোদেও নয়াপল্টনে জড়ো হচ্ছে শ্রমিক দলের নেতাকর্মীরা

চীনে গভীর রাতে মহাসড়কে ধস, ১৯ জনের মৃত্যু

চীনে গভীর রাতে মহাসড়কে ধস, ১৯ জনের মৃত্যু

থাইল্যান্ড সফর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন কাল

থাইল্যান্ড সফর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন কাল

করোনা টিকায় মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, স্বীকার করল অ্যাস্ট্রাজেনেকা

করোনা টিকায় মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, স্বীকার করল অ্যাস্ট্রাজেনেকা

দিল্লির ১০০ স্কুল বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি

দিল্লির ১০০ স্কুল বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি

গাজীপুরে ট্রাকের ধাক্কায় উড়াল সেতু প্রকল্পের প্রকৌশলী নিহত

গাজীপুরে ট্রাকের ধাক্কায় উড়াল সেতু প্রকল্পের প্রকৌশলী নিহত

সকল ভয়ভীতির উর্ধ্বে থেকে নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করতে হবে-- জেলা প্রশাসক

সকল ভয়ভীতির উর্ধ্বে থেকে নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করতে হবে-- জেলা প্রশাসক

দুই মাসের ব্যবধানে আবারো বাড়লো বিদ্যুৎ কেন্দের গ্যাসের দাম

দুই মাসের ব্যবধানে আবারো বাড়লো বিদ্যুৎ কেন্দের গ্যাসের দাম

বেনাপোলে বাসচাপায় ধান কাটা শ্রমিক নিহত

বেনাপোলে বাসচাপায় ধান কাটা শ্রমিক নিহত

সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেয়া হবে

সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেয়া হবে

বৃহস্পতিবার কাঙ্খিত বৃষ্টি হতে পারে, জানাল আবহাওয়া অধিদপ্তর

বৃহস্পতিবার কাঙ্খিত বৃষ্টি হতে পারে, জানাল আবহাওয়া অধিদপ্তর

শেখ হাসিনার অধীনে কেয়ামত পর্যন্ত সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না : রিজভী

শেখ হাসিনার অধীনে কেয়ামত পর্যন্ত সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না : রিজভী