বিএনপির এক্স নেতারা এখন ‘কুলহারা কলঙ্কিনী’
১১ মে ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১১ মে ২০২৪, ১২:০৪ এএম
‘আমি কুলহারা কলঙ্কিনী/আমারে কেউ ছোইয়ো না গো সজনী’ (শাহ আবদুল করিম)। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হওয়া বিএনপির সাবেক (এক্স) নেতাদের অবস্থা হয়েছে বাউল সম্রাটের এই গানের কলঙ্কিনী বধূর মতোই। লোভাতুর নেতারা একদিকে পরাজয় অন্যদিকে দল থেকে বহিষ্কার হয়ে জাত-কূল হারিয়ে পরিবার, সমাজে ‘কুলহারা কলঙ্কিনী বধূর’ পরিণতিতে পড়ে গেছেন। তারা এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে কলঙ্কিত, সমাজে অচ্ছুত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার মতো ক্ষমতাসীনরা ‘কথা দিয়ে কথা রাখেনি’ দোষারোপ করে নিজেরাই নিজেদের কপাল চাপড়িয়ে হা-হুতাশ-আফসোস করছেন। ‘লোভ পাপ পাপের পরিণতি মরণ’ প্রবাদটিকে নিয়তি ধরে নিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৮ মে নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিএনপির ওই এক্স নেতারা ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।
উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট হয়ে গেছে। এ নির্বাচন নিয়ে মানুষের তেমন আগ্রহ নেই। ফলে স্থানীয় নির্বাচনে ইতিহাসের সবচেয়ে কম ভোটার ভোটকেন্দ্র গেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কারা উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন তা নিয়ে মানুষের আগ্রহ নেই। তবে লোভে পড়ে নির্বাচনে অংশ নেয়া বিএনপির বহিষ্কৃৃত নেতাদের কতজন বিজয়ী হয়েছেন সবার মধ্যেই তা জানার আগ্রহ। গণমাধ্যমগুলোও বিএনপি থেকে বহিস্কৃত হয়ে উপজেলা নির্বাচনে বিজয়ীদের নিয়ে দারুণ দারুণ খবর করছেন। ভাবখানা এমন যে উপজেলা নির্বাচনের সঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির নাম জুড়ে দিয়ে দেশ-বিদেশে জানানোর দায়িত্ব যেন গণমাধ্যমের উপর পড়েছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ২৮টি উপজেলায় বিএনপির (বহিষ্কৃত) নেতারা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছিলেন, তারমধ্যে ৭ জন বাদে সবাই পরাজিত হয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া বহিষ্কৃত নেতারা ভোটে বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের তেমন সহযোগিতা পাননি। ফলে এই প্রার্থীরা আশানুরূপ ফল পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। শুধু তাই নয় ভবিষ্যত রাজনীতি অনিশ্চিত করে তুলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে লাভ কি হলো?
মনীষিরা বলেছেন, ‘ইতিহাসের শিক্ষা যে, কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না’। খুবই সত্য কথা। লোভী মানুষ হলে তো কথাই নেই। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী তৈমূর আলম খন্দকার, শমসের মোবিন চৌধুরী, শাহ মোহাম্মদ আবু জাফরসহ বিএনপির কিছু বহিষ্কৃৃত সুবিধাবাদী কিছু নেতা নির্বাচনে অংশ নিয়ে ‘যে শিক্ষা পেয়েছেন’ তা এখনো সবার চোখে জ্বলজ্বল করছে। তারপরও উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির উপজেলা পর্যায়ের শতাধিক লোভী নেতা ওই ঘটনা থেকে শিক্ষা না নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার লোভে পড়ে যান। পর্দার আড়ালে সরকারের ‘টোপ’ গিলে দলের নির্দেশনা উপেক্ষা করে নির্বাচনে প্রার্থী হন। তাদের ধারণা ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজের স্বার্থে বিএনপির এই নেতাদের উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করবে। বাস্তবে তৈমূর আলম খন্দকারের মতো লোভে পড়ে ‘আম-ছালা’ হারিয়ে এখন রাজনৈতিক ভাবে এতিম হলেন।
মূলত মানুষের খারাপ স্বভাবগুলোর মধ্যে লোভ অন্যতম। আদর্শ-নীতি-নৈতিকতা হীন রাজনীতিকদের এমপি, মন্ত্রী, মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার লোভ আরো বেশি। অতীতেও এই লোভাতুর নেতাদের করুণ পরিণতির ভুঁড়িভুঁড়ি প্রমাণ রয়েছে। লোভের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- প্রবল আকাক্সক্ষা, ঔৎসুক্য, উন্মুখতা, প্রবলভাবে কামনা করা, প্ররোচণা, প্রলোভন, অতিস্পৃহা, লোলুপতা, প্রলুব্ধ লালসা ও ধনসম্পদের পেছনে ছোটা। প্রবাদে রয়েছে, লোভ মানুষকে পাপ কাজে নিয়োজিত করে এবং পাপের পরিণতি হিসেবে আসে মানুষের মরণ। লোভীরা হন ব্যক্তিত্বহীন। হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি, হানাহানি, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, খুনখারাবি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানীসহ সবধরনের অনিষ্টের মূলে রয়েছে নীতিহীন রাজনীতিকদের এই অত্যধিক লোভ-লালসা। উপজেলা নির্বাচনে এই ‘লোভের আগুনে পুড়ে’ ছারখার হয়ে গেলে বিএনপির শতাধিক নেতার রাজনৈতিক ভবিষ্যত।
স্থানীয় সরকার এবং নির্বাচন নিয়ে গবেষণা করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘দেশের নির্বাচন এখন নির্বাসনে’। যথার্থই বলেছেন তিনি। ২০১৪ সাল থেকে নির্বাচনের নামে যে তামাশা হচ্ছে তা কোনো ভাবেই প্রকৃত নির্বাচন নয়। কারণ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনকে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ খেলার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ছোটবেলায় স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের উৎসবে প্রাইমারি স্কুলে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ নামে একটা খেলার প্রচলন দেখেছি। ছেলে-মেয়েরা নিজেদের মতো করে কিম্ভূতকিমাকার সেজে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের আনন্দ দিয়ে পুরস্কার বাগিয়ে নিত। বর্তমান সরকার নিজেদের সুবিধা মতো নির্বাচনী আইন করছে, আইন বাতিল করছে। এর আগে স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহারের আইন করা হলো। এবার নিজেদের সুবিধার জন্য উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাতিল করা হলো। নির্বাচনের আগে মন্ত্রী-এমপিদের স্ত্রী-সন্তান-শ্যালক এবং স্বজনদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর হুংকার দেয়া হলো। কিন্তু দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় রাজনৈতিক ছাত্রছায়ায় স্থানীয় মনস্টার হয়ে উঠাতের ক্ষেপালে বিপদ হবে ভেবে লেজগুটিয়ে আত্মীয়-স্বজনের ‘নতুন থিউরি’ হাজির করলো। এর মধ্যেই বিএনপিকে নানাভাবে নির্বাচনে আনার চেষ্টা করেছে। অনুগত বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যম দিয়ে প্রচারণা চালানো হয়েছে। কিন্তু বিএনপির নেতৃত্ব সরকারের এই ফাঁদে পা দেয়নি; আওয়ামী লীগ দেশের জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে এটা প্রমাণের লক্ষ্যে তারা উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। কিন্তু সরকারের কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তি জেলা-উপজেলা পর্যায়ের বিএনপির নেতাদের নির্বাচনে অংশ নিতে পর্দার আড়ালে সরব হন। বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা এবং উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিলেই উপজেলা চেয়ারম্যান হয়ে যাবেন এমন প্রলোভন দেখায়। এতে লোভাতুর কিছু নেতা ‘শয়তানের প্ররোচণায়’ উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার লোভে নির্বাচনে প্রার্থী হন। দলীয় শৃংখলা ভঙ্গে দায়ে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু শেষ বিকেলে দেখা গেলো তৈমূর-মোবিন-শাহ জাফর ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়ে যেমন লোভের আগুনে পুড়ে রাজনৈতিক ভাবে ছারখার হয়ে গেছেন; তেমন পরিণতিই হলো উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া বিএনপির এক্স নেতাদের। লোভাতুর এই নেতারা একদিকে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হারালেন; অন্যদিকে উপজেলা চেয়ারম্যানও হতে পারলেন না। মাঝখানে বিএনপির স্থানীয় যেসব নেতা তাদের এতোদিন সমীহ করতেন তারা ‘বেঈমান’ ‘মোনাফেক’ হিসেবে অবিহিত করছেন। গ্রামের মানুষের কাছে নীতিহীন সুবিধাবাদী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন, সমাজে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছেন।
গত দেড় দশকে দেশের রাজনীতির গতিধারায় ‘বিবর্তন’ ঘটেছে। নির্বাচনের নামে তামাশা করায় দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগের তৃর্ণমূলের ভিত্তি যেমন আলগা হয়েছে; দুর্নীতি-জুলুম-লুটপাটের কারণে জনগণ থেকে দূরে সরে গেছে। অন্যদিকে বিএনপি এ সময় সাংগঠনিকভাবে সুসংগঠিত হয়েছে এবং জনগণের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছে। একই সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ে দলটির হাজার হাজার নেতার জন্ম হয়েছে। ফলে আগের বিএনপির আর বর্তমান বিএনপির ইমেজ ও মর্যাদা এক নয়। মানুষ বিএনপির নেতাদের বিশেষ সন্মানের দৃষ্টিতে দেখে। শিক্ষিত নতুন প্রজন্ম আওয়ামী লীগকে গণতন্ত্র বিরোধী ও বিএনপিকে গণমানুষের দল হিসেবে দেখছে। বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে যতই মামলা থাকুক আর নেতারা জেল-জুলুমের শিকার হোক সামাজিক ভাবে বিএনপির নেতারা সাধারণ মানুষের সহানুভূতি পাচ্ছেন। রাজনৈতিক ভাবে অন্যরকম মর্যাদা পাচ্ছেন। ব্যক্তি লোভ সংবরণ করতে ব্যর্থ হয়ে যারা উপজেলা চেয়ারম্যান হতে নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হয়েছেন তারা ‘রাজনৈতিক দেউলিয়া’ হওয়ার পথে। এতোদিন যে দল করেছেন সেই বিএনপির নেতারা তাদের প্রত্যাখ্যান করেছেন, সমাজে ‘সুবিধাবাদী লোভী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। এমনকি পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে গেছেন। ‘কলঙ্কিনী বধূ’ নাটক, যাত্রাপালার নাম ভূমিকা অভিয়ন করা কলঙ্কিনী বধূর অবস্থা সমাজে, পরিবারে এবং আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যেমন হয়; তেমন পরিণতি হয়েছে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃৃত উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হওয়া নেতাদের। তারা কার্যত এখন রাজনৈতিক ভাবে বাউল শিল্পী আবদুল করিমের ‘কুলহারা কলঙ্কিনী’।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
৪৩ বছর পর কুয়েতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী
আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করি, হাসিনার ভরসা ভারতে: দুলু
আপনাদের রান্নাঘরের বিষয়ে জিজ্ঞেস করিনা, আমাদের রান্নাঘরে উকি মারবেননা -ডা. শফিকুর রহমান
মন্ত্রিসভায় বড় রদবদল, কানাডায় কি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন ট্রুডো?
পাকিস্তান থেকে যেসব পণ্য নিয়ে এবার এলো জাহাজ
ভারতের সেবাদাসী হাসিনাকে পুনর্বাসনে এবার জঙ্গি মিশনে তারা!
মাহফুজকে উপদেষ্টা থেকে বাদ দেওয়া উচিত? যা বললেন ড. জাহেদ
৬ বছরের মধ্যেই চীনের হাতে হাজার পরমাণু বোমা! উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্রের
বিগত সময়ে দলীয় স্বার্থ উদ্ধারে বড় ধরনের অপরাধ করেছে পুলিশ, এ জন্য আমরা লজ্জিত: আইজিপি
ব্রাহ্মণপাড়ায় পাঁচ দিনেও খোঁজ মিলেনি নিখোঁজ সোহাগের
কসবায় পাহাড় কাটার অপরাধে ২ জনের অর্থদণ্ড
নরসিংদীতে মাকে কুপিয়ে হত্যা, ছেলে গ্রেপ্তার
চট্টগ্রামকে বিদায় করে টিকে রইল খুলনা
পলাতক ১৯ বাংলাদেশি নাবিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
ফ্রিজে রাখা বাসি ভাতে উপকার দ্বিগুণ!
আ.লীগ দেশটাকে গোরস্থানে পরিণত করেছিল : জামায়াত আমির
সেনবাগে মর্মান্তিক মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় ভাগ্নে নিহত : মামা আহত
কুষ্টিয়ায় সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় গৃহবধুকে নির্যাতন
রাজশাহীর বাগমারায় পুকুর থেকে ভ্যান চালকের লাশ উদ্ধার
‘জনশক্তি’ নামে কোনও রাজনৈতিক দল নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি : জাতীয় নাগরিক কমিটি