পদ্মার ভাঙনে দ্বিখণ্ডিত হরিরামপুরের মূল ভূখণ্ড
২৬ মে ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ২৬ মে ২০২৪, ১২:০৭ এএম
অনবদ্য পদ্মার ভাঙনে ভৌগলিকভাবে দ্বি-খণ্ডিত হয়ে গেছে মানিকগঞ্জের পদ্মা অধ্যুষিত অন্যতম উপজেলা হরিরামপুরের মূল ভূ-খণ্ড। জেলার ৭টি উপজেলার মধ্য সর্ববৃহৎ উপজেলা হরিরামপুর। ২৪৫ দশমিক ৪২ বর্গকিলোমিটার আয়তনে পদ্মা নদী বেষ্টিত ১৩টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ উপজেলা। যার ৯টি ইউনিয়নই পদ্মা ভাঙনকবলিত হয়ে হাজার হাজার মানুষ জমিজমাসহ ভিটেবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে।
নদী ভাঙনের ফলে এ উপজেলার অনেক পরিবার জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ ঢাকার সাভার, ধামরাই ও গাজীপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করছেন। এছাড়াও গত কয়েক বছরে নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনেক স্থাপনাসহ হাজার বিঘা কৃষি জমিও। পদ্মার ভাঙন আতঙ্ক এখনও দুশ্চিন্তায় পদ্মার পাড়ের শতশত পরিবার।
জানা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকেই এ উপজেলায় প্রথম নদী ভাঙনের সূচনা হয়। ধারাবাহিক ভাঙনের ফলে উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টি ইউনিয়নই নদী ভাঙনের কবলে পড়ে। এতে করে ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে সুতালড়ী, আজিমনগর ও লেছড়াগঞ্জ তিনটি ইউনিয়নই সত্তর দশকের মধ্যেই পুরোপুরি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। আশির দশকের শুরুর দিকে উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে বিলীন হয়ে যাওয়া তিনটি ইউনিয়নে চর জেগে ওঠে। পরবর্তীতে ১৯ ৮৩/ ৮৪ সালের দিকে জেগে ওঠা চরে মানুষজন নতুন করে বসবাস করতে শুরু করে। এরপর ৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় আবার ডুবে যায় জেগে ওঠা তিনটি ইউনিয়নের চর। মানুষজন চরাঞ্চল ছেড়ে আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পুনরায় ৯৮ সালের বন্যায় পরে আবারও চর জেগে ওঠে এবং মানুষজন স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। বর্তমান তিনটি ইউনিয়নের চরাঞ্চলে প্রায় ৫০ হাজারের অধিক মানুষের বসবাস। একই উপজেলায় বসবাস করলেও প্রায় ১০ কিলোমিটার নদী পথ দ্বিখণ্ডিত করে উপজেলার ভৌগলিক মূল ভূ-খণ্ড। বর্তমান চরাঞ্চলের জনগণ নদী পাড়ি দিয়েই উপজেলা সদরসহ জেলা সদরের সাথে যোগাযোগ করতে হয়। এক্ষেত্রে তাদের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ইঞ্জিনচালিত ট্রলার। তবে দুর্গম এই চরাঞ্চলের উৎপাদিত কৃষিপণ্য উপজেলার খাদ্য চাহিদা মেটাতে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলেও স্থানীয়রা জানান।
ভাঙনকবলিত বাকি ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের প্রায় ৭০ ভাগ, গোপীনাথপুর ইউনিয়নের প্রায় ৬০ ভাগ, রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের প্রায় ৬০ ভাগ, বয়ড়া ইউনিয়নের প্রায় ৭০ ভাগ, হারুকান্দি ইউনিয়নের প্রায় ৬০ ভাগ ও ধুলশুড়া ইউনিয়নের প্রায় ৭০ ভাগ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা এখনও পদ্মার আগ্রাসনের শঙ্কায় ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়েই বসবাস করছেন বলে জানান নদী তীরবর্তী এলাকায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।
উপজেলার কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের কোটকান্দি গ্রামের আশি বছর বয়স্ক শেখ সোহরাব জামান, আমার বাপ দাদার বাড়ি ছিল বড় বাহাদুরপুর। ১৯৪৯ সালের দুর্ভিক্ষের সময় নদী ভাঙন শুরু হয়। এক বছরের মধ্যে আমাদের বসতবাড়িসহ জমিজমা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। ওই সময় আমাদের বসতভিটাসহ প্রায় ১৩ বিঘা জমি নদীতে চলে যায়। পরে আমার মামার বাড়ির ওয়ারিশসূত্রে এই গ্রামে বসবাস শুরু করি।
একই গ্রামের পচাত্তর বছর বয়স্ক মহিউদ্দিন সরদার জানান, আমাগো বাড়ি আছিল এই ইউনিয়নেরই কুমারকান্দি। আমার দাদার আমলে আমাগো বাড়ি পদ্মায় গেছে। বাবার কাছ থেকে হুনছি, ওই সময় আমাগো প্রায় ৭০ বিঘা জমি নদীতে নিয়া গেছে। পরে নানার বাড়ির ওয়ারিশ ওপর এই খানে আছি। তারপরেও তো আমাগো নদীতে ছাড়তেছে না। এই ইউনিয়নেরই তো তিনভাগের দুইভাগ নদীর মাঝখানে।
একই ইউনিয়নের গৌরবিরদিয়া গ্রামের মৃত হোসেন আলীর স্ত্রী সত্তরোর্ধ বয়স্ক ছাহেলা বেগম জানান, আমাগো বাড়ি আছিল শুদ্রাকান্দি। ৩০ বছর আগে প্রায় ২০ বিঘা জমিজমাসহ বসতভিটা নদীতে ভাইঙ্গা নিয়ে যায়। পরে এই গৌরবিরদিয়া বাড়ি করি। এ বাড়িটিও নদীর কিনারে। কবে জানি এ বাড়িও চইলা যায়।
রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. কামাল হোসেন ইনকিলাবকে জানান, ৭১’র পর থেকেই আমার ইউনিয়নে ভাঙন দেখা দেয়। বর্তমান প্রায় ৬০ ভাগ এলাকা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পূর্বের কোনো সরকার নদী ভাঙনরোধে কাজ করেনি। আওয়ামী লীগ সরকার আসার পরেই এ উপজেলায় নদী ভাঙন রোধে কাজ শুরু হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণ জিও ব্যাগ ফেলে নদী তীর রক্ষা কাজ করা হয়। তারপরেও প্রতি বছরই কিছু না কিছু ভাঙতেই থাকে। এ স্থায়ী বেরিবাঁধটা জরুরি হয়ে পড়েছে।
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলার ভাঙনকবলিত এলাকায় রক্ষায় ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত উপজেলার ধুলশুড়া থেকে কাঞ্চনপুরের কুশিয়ারচর পর্যন্ত নদীর তীর রক্ষায় অস্থায়ী বেরি বাঁধ নির্মাণে ধাপে ধাপে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। এছাড়াও চরাঞ্চলে আজিমনগর, সুতালড়ী ও লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের চরাঞ্চল রক্ষায়ও প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে।
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাঈন উদ্দীন ইনকিলাবকে জানান, হরিরামপুরের বেশিরভাগ এলাকায় জিওব্যাগ ফেলে নদী শাসনের কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অবশিষ্ট কাজের জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী বরাবর বাজেটের জন্য প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হয়েছে। বাজেট অনুমোদন পেলেই আমরা বাকি এলাকায় কাজ শুরু করতে পারব। এছাড়াও বর্ষা মৌসুমে যখন যেখানে ভাঙন শুরু হয়, আমরা জানার সাথে সাথে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
তিনি আরো জানান, আসলে আমাদের যে পরিমাণ চাহিদা দেখা দেয়, সে অনুযায়ী বাজেট নাই। তাই আমাদের ইচ্ছা থাকা সত্বেও অনেক সময় অনেক কিছু করতে পারি না বলেও তিনি জানান।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
‘অধ্যাপক’ হিসেবে পদোন্নতি পেলেন শিক্ষা ক্যাডারের ৯২২ জন
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক গ্রেফতার
স্বৈরাচারের পতন হলেও দোসররা এখনো রয়ে গেছে : তারেক রহমান
সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম কারাগারে
নদী দখলকারীদের উচ্ছেদে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে - পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
এবার ফাঁস হলো রাবি শিবির সভাপতির পরিচয়
ফুটবলের মাঠে চমক দেখাতে চান তাবিথ আউয়াল
শ্রীলঙ্কার চীনপন্থি প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে কি ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ?
ডাটা সেন্টারের সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদ তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার
দৈনিক রাজবাড়ী কন্ঠে" প্রকাশকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ফরিদপুর সাংবাদিক জোটের প্রতিবাদ সভা
হাত-পা ও চোখ বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানো হয় --- আবু বাকের
ইনসি ইকো প্লাস সিমেন্ট নিয়ে এলো বাংলাদেশের সমূদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের উপযোগী করে দীর্ঘস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের সমাধান
ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা জন্য আমাদের লড়াই চলছে : গয়েশ্বর চন্দ্র রায়
বাগমারার সাবেক এমপি এনামুল কারাগারে
কুড়িগ্রামে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
রাঙ্গামাটিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছে রাজনৈতিক দল এলডিপি
পরিস্থিতির আলোকে ছোট ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা হতে পারে- গভর্নর
পোশাক শিল্পের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতির কাক্সিক্ষত উন্নতি হয়নি: বিজিএমইএ
অমিত শাহ’র বক্তব্যের কড়া প্রতিবাদ বাংলাদেশের
ছাত্র সংসদ নির্বাচন ও নতুন বাংলাদেশ