একযুগে দাম কমেছে ৩৩ শতাংশ
২২ জুন ২০২৪, ১২:২৩ এএম | আপডেট: ২২ জুন ২০২৪, ১২:২৩ এএম
দেশের চামড়া শিল্পের ব্যবসার আকারে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার। এর প্রায় অর্ধেকই আসে বিদেশের বাজার থেকে। অথচ দেশের রফতানি ঘুরপাক খাচ্ছে এক বিলিয়ন ডলারের ঘরে। কারণ আর্ন্তজাতিক এলডব্লিউজি সনদের অভাবসহ নানা কারণে ধুঁকছে এই শিল্প। তবে এই শিল্পের শ্রমিক নেতা থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, পরিস্থিতির জন্য সরকার ও ট্যানারি মালিকরাই দায়ি।
সূত্র মতে, পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট। পাট ও পাটজাত পণ্যই ছিল পাকিস্তানের প্রধান রফতানি পণ্য। দেশের জাতীয় আয়ের ৬৫ শতাংশই আসত কৃষি খাত থেকে। দেশীয় ব্যবহার ও রফতানিতে চা ও চামড়ার উপস্থিতি এবং অবস্থান ক্রমে বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ মুসলমান জনসংখ্যা অধ্যুষিত হওয়ায় পবিত্র ঈদুল আজহার সময় প্রচুর গরু, ছাগল প্রভৃতি পশু কোরবানি হয়। এছাড়া সারা বছরই এসব পশুর গোশত ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে। ফলে চামড়ার উৎপাদন ও সরবরাহ বাংলাদেশে বহুপূর্ব থেকে ক্রমে বাড়ে। ব্যবসা হিসেবে এ দেশে চামড়া খাতের যাত্রা শুরু হয়েছে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে। ১৯৪০ সালে ব্যবসায়ী রণদা প্রসাদ সাহা (আরপি সাহা) নারায়ণগঞ্জের কাছে সর্বপ্রথম একটি ট্যানারি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫১ সালের অক্টোবরে তৎকালীন সরকার ঘোষিত এক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ঢাকার হাজারীবাগে ট্যানারি শিল্প স্থাপিত হয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এ খাত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এরপর ১৯৮০-এর দশক থেকে বাংলাদেশে রফতানি পণ্য হিসেবে তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্ভব ও প্রসার হতে থাকে। বর্তমানে দেশের রফতানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। ১৯৯০ সাল পরবর্তী সময়ে ওয়েট ব্লু উৎপাদনের সীমিত পরিসর পেরিয়ে ক্রাসড ও ফিনিশড লেদার, জুতা, ব্যাগ ও অন্যান্য চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে চামড়া খাতের রফতানিতে পণ্য বৈচিত্র্য আসে। বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিদেশেও পরিচিতি পায় এবং দ্বিতীয় বৃহৎ রফতানি পণ্য হিসেবে পরিগণিত হয়। ২০১৩-১৪ সালে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় হয় ১ হাজার ২৫৮ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলার। পরবর্তী তিন অর্থবছরও এ খাতের রফতানি আয় ছিল যথাক্রমে ১ হাজার ১৩০ মিলিয়ন ডলার, ১ হাজার ১৬১ মিলিয়ন ডলার ও ১ হাজার ২৩৪ মিলিয়ন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও এ খাতের রফতানি আয় ছিল ১ হাজার ১৯ দশমিক ৭৮ মিলিয়ন ডলার। তবে বাংলাদেশের চামড়া প্রক্রিয়াকরণ ও পণ্য উৎপাদনে পরিবেশসম্মত কমপ্লায়েন্স না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কখনো আশানুরূপ হয়নি। ২০১৭ সালের পর থেকে চামড়া খাতের চলমান অগ্রযাত্রায় ভাটা পড়তে থাকে। রফতানি আয়ের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থান হারিয়ে চামড়া খাত এখন তলানীতে নেমেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২২ কোটি ৩৬ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিশ্ববাজারে রফতানি করেছেন বাংলাদেশের রফতানিকারকরা। ইপিবি’র হিসেবে, চলতি অর্থ-বছরের ১১ মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি ১৪ দশমিক ১৭ শতাংশ কমে আয় হয়েছে ৯৬ কোটি ১৪ লাখ ডলার। যেখানে বৈশ্বিক বাজার এখন ৪৬৮ বিলিয়ন ডলার। এমনকি ট্যানারি খাতের শ্রমিক নেতাও জানান যে, কমপ্লায়েন্সের অভাবেই আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি চামড়াজাত পণ্য এখন দাম পাচ্ছে না। আর চাহিদাও বাড়ছে না।
সাশ্রয়ী দেশীয় চামড়াজাত পণ্য কিনে বাংলাদেশের ক্রেতারা লাভবানই হচ্ছেন বলা যায়। এমনি মেড ইন বাংলাদেশ লেদার সু অ্যান্ড লেদারগুডস কিনে তৃপ্ত হতে পারতেন অনেক বেশি সংখ্যক বিদেশি ক্রেতা। কিন্তু সে সম্ভবানার তুলনায় অর্জন নগন্য। তবে রফতানি আশানুরূপ বাড়ছে না!
হিসেব মতে, গত একযুগে গরুর চামড়ার সরকার নির্ধারিত দাম কমেছে ৩৩ শতাংশের বেশি। এবারও নির্ধারিত দামে বিক্রি হয়নি কাঁচা চামড়া। প্রতিটি গরুর চামড়া আকারভেদে বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে। আড়তদাররা বলছেন, ট্যানারিতে চাহিদা না থাকায় দাম কম। ট্যানারি মালিকদের দাবি, চামড়ার রফতানিমূল্যও কমেছে। ২০১৩ সালে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ৮৫ থেকে ৯০ টাকা নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আর ঢাকার বাইরে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। এরপর কমতে কমতে ২০২০ সালে চামড়ার দাম ঠেকে ৩৫ টাকা বর্গফুটে। এ বছর কোরবানির গরুর চামড়ার দাম নির্ধারিত হয় ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। ঢাকায় একেকটি গরুর লবণজাত চামড়ার সর্বনিম্ন দাম ধরা হয় এক হাজার ২০০ টাকা। প্রতি পিস চামড়ায় লবণ দিতে খরচ হয় ৩০০ টাকার মতো। সে হিসেবে লবণ ছাড়া চামড়ার দামে সন্তুষ্ট নন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট আবুল কালাম আজাদ বলেন, এলডব্লিউজি পাওয়ার জন্য আপনার কারখানা কমপ্লায়েন্ট কি না, আপনি পরিবেশ বান্ধব কি না, আপনি শ্রমিকদের সোস্যাল কমপ্লায়েন্স মিট করেন কি না, কোয়ালিটি মানে কি না- এগুলো কোনোটার মধ্যেই আপনি পড়েন না।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, গত বছর চামড়া ক্রয় হয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার পিস। কোরবানির পশুর এই চামড়া অনেকেই দাতব্য প্রতিষ্ঠান, মাদরাসা কিংবা এতিমখানায় দান করেন। এই চামড়ার টাকা দিয়ে এতিম শিশুদের ভরণ পোষণও চলে। চামড়া সঠিক দামে বিক্রি করতে না পারলে দুশ্চিন্তায় পড়েন বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানও। ঢাকার বনশ্রী নূরানী আদর্শ মাদ্রাসার শিক্ষক আব্দুল ওহাব বলেন, গত কয়েক বছর ধরে চামড়া আসছে বেশি। কিন্তু দাম দিন দিন কম পাচ্ছি। এতে আমাদের তেমন কোন লাভ হচ্ছে না।
চামড়া শিল্প বিশেষজ্ঞ জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ট্যানারি মালিকদের দোষই বেশি। তিনি বলেন, দেশে তামাক বোর্ড, চা বোর্ড আছে। তাদের যে আউটপুট, যে রেভিনিউ অথচ একটি চামড়া বোর্ড করতে পারে না!
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান বলেন, আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক প্রেক্ষাপট যদি বিবেচনায় নিই, বহির্বিশ্বে কিন্তু চামড়ার দাম বাড়েনি। সবকিছুই তো ডিমান্ড-সাপ্লাই চেইনের ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতেও মূল্যস্ফীতি আছে। ফলে পাশ্চাত্যের দেশগুলো, যারা আমাদের চামড়া খাতের মূল ক্রেতা, তাদের ওখানে চাহিদা কমে গেছে। আবার চীনে আর্টিফিশিয়াল লেদার, সিনথেটিক লেদারের ব্যবহার বেড়েছে। কেডসে ফেব্রিকসের ব্যবহার বেড়েছে। ফলে চামড়ার চাহিদাটাই কমে গেছে।
ধারণা করা হয়, এক লাখ টাকার নিচের গরুর চামড়া ২০-২৪ বর্গফুট। দেড় লাখ টাকার গরুর চামড়া ২৬ থেকে ৩০ বর্গফুট, আর ২ লাখ টাকা দামের ওপরে কেনা গরুর চামড়া হতে পারে ৩২ থেকে ৩৮ বর্গফুট। প্রয়িক্রাজাতের কয়েক ধাপে রাসায়নিকসহ বিভিন্ন খরচ বাড়ায় কাঁচা চামড়ার দাম বাড়ানো সম্ভব নয় বলে দাবি ট্যানারি মালিকদের।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরের দূষণ বন্ধ না হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি বাংলাদেশি চামড়া কিনছে না। ফলে বাংলাদেশি চামড়া বড় ক্রেতা বর্তমানে চীনারা। তারা কম দাম দেয়। সেটির প্রভাব কাঁচা চামড়ার দামেও পড়ছে।
লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউট পরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, দূষণ রোধ ও চামড়ার বাজার বৃদ্ধি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়ন নেই। এ জন্য সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে পশ্চিমা দেশগুলোতে চামড়ার চাহিদা কমেছে। সেই সাথে চীনের সিনথেটিক লেদার, বিশ্ববাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মত পর্যবেক্ষকদের।
উল্লেখ্য, সর্বশেষ ২০১৩ সালে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম বেশি ছিল। সেবার গরুর প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ছিল ৮৫-৯০ টাকা। এরপর থেকেই বিভিন্ন কারণে চামড়ার দাম ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। আর ২০১৭ সালের পর থেকে কাঁচা চামড়ার কদর একেবারেই কমেছে। গত বছরও একই দশা ছিল। রাজধানীসহ সারা দেশেই কাঁচা চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েন কোরবানিদাতারা। ২০১৯ সালে কোরবানির পশুর চামড়ার দামে বড় ধরনের ধস নামে। ন্যূনতম দাম না পেয়ে দেশের অনেক অঞ্চলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া সড়কে ফেলে দেয় এবং কেউবা মাটিতে পুঁতে ফেলে।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে, এবারের ঈদুল আজহায় সারাদেশে প্রায় ১ কোটি ৪ লাখের বেশি পশু জবাই হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮ লাখ ৫০ হাজারের মতো গরু-মহিষ এবং বাকিগুলো খাসি, বকরি, ভেড়াসহ অন্যান্য পশু। গত বছর ঈদুল আজহায় ১ কোটি ১০ লাখ পশু কোরবানি হয়েছিল। সরকার লবনযুক্ত চামড়ার দাম বাড়ানোর ফলে কিছুটা লাভবান হবেন পোস্তার ব্যবসায়ীরা। এদিকে বিশ্বজুড়ে চামড়াজাত পণ্যের বাজারের ৩০ শতাংশ চীনের দখলে এরপর আছে ভিয়েতনাম, ভারত, ইতালি ও ফ্রান্স। অন্যদিকে বাংলাদেশের দখল এক শতাংশের সিকিভাগও নয়। যদিও বিশ্বের মোট গবাদিপশুর প্রায় দুই শতাংশ লালন হয় এদেশে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সুপার সিক্সে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ যারা
কুষ্টিয়ার মিরপুরে হত্যা চেষ্টা মামলায় আটক ২
সর্বোচ্চ দায় স্বীকার করতে প্রস্তুত হাসনাত আবদুল্লাহ
ঢাকা প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু বিপর্যয়ে শিশুদের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে: ইউনিসেফ
এবার মেডেল ফর ডিপ্লোম্যাটিক অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছেন সউদী রাষ্ট্রদূত
সারাক্ষণ ভূমিকম্প অনুভব করি: পরীমণি
ঘণকুয়াশায় ৯ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটের ফেরি সার্ভিস চালু হয়েছে
২৬ জানুয়ারি গুলশান-২ এলাকা এড়িয়ে চলার অনুরোধ
চীনে শুল্ক আরোপে ট্রাম্পের দ্বিধা, বিতর্কিত মন্তব্য ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ
ঘোষিত হলো ৯৭ তম অস্কারের মনোনয়ন: দেখে নিন সম্পূর্ণ তালিকা
জুলাই বিপ্লবে আহত সাতজনকে পাঠানো হলো সিঙ্গাপুরে
জন কেনেডি, রবার্ট কেনেডি ও মার্টিন লুথার কিং হত্যার গোপন নথি প্রকাশের নির্দেশ ট্রাম্পের
শুধু হাসিনা না হাসিনার দলও চিরতরে প্যাকেট হয়ে গেছে
নাইজেরিয়ায় বোকো হারামের হামলায় ২০ জেলে নিহত
গাজায় সংঘটিত মানবিক বিপর্যয় দেখতে নিরাপত্তা পরিষদকে আমন্ত্রণ ফিলিস্তিনের
সৈয়দপুরে ঘন কুয়াশায় আলু ও বোরো বীজতলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক
মায়ের জানাজায় গিয়ে ছেলের মৃত্যু, একসঙ্গে দাফন
মিটার সংকটে মোরেলগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ অফিস, ভোগান্তিতে গ্রাহক
গাজীপুরে ট্রেনে কাটা পড়ে ২ বন্ধুর মৃত্যু