ফসলি জমি চরাঞ্চল প্লাবিত
২৩ জুন ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪, ১২:০৩ এএম
দেশের উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। কোথাও কোথাও পানি স্থিতিশীল বা অপরিবর্তিত। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধিতে তলিয়ে যাচ্ছে নদী সংলগ্ন উত্তর জনপদের বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল ফল-ফসলি জমি, বীজতলা, সবজি খেত-খামার, গবাদি পশুর চারণভূমি, গ্রামীণ ফল-ফলাদির বাগ-বাগিচাসহ নিচু চরাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। গতকাল শনিবারও তিস্তা নদী টানা ৪ দিন বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। যমুনা নদে অব্যাহতভাবে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিস্তা-ধরলা-দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র-যমুনাসহ উত্তরাঞ্চলের সর্বত্রই মানুষের মাঝে নদী ভাঙনের ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। তিস্তা কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ভারত নিজেদের ঢল-বন্যামুক্ত রাখতে উজানে গজলডোবা বাঁধ খুলে পানি ছেড়ে দেয়ায় তিস্তা নদী টানা বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। সেই ঢলের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে উত্তরের বিশেষত ফসলি জমি, খেত-খামারসহ চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলসমূহ। আকস্মিক বন্যার কবলিত হয়েছে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর জেলা। গতকাল পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাসে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীগুলোর পানি আগামী ২৪ ঘণ্টায় সাময়িক হ্রাস পেয়ে, পরবর্তী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টায় বৃদ্ধি পেতে পারে।
উজানে উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল, আসামে টানা ভারী বৃষ্টির কারণে নেমে আসা ঢলে দেশের অন্যতম প্রধান অববাহিকায় যমুনা নদের পানি প্রতিদিনই বৃদ্ধির দিকে এবং সতর্কসীমার কাছাকাছি ধাবিত হচ্ছে। এতে করে প্লাবিত হচ্ছে সিরাজগঞ্জসহ যমুনা পাড়ের চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল।
অন্যদিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট বিভাগের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার এবং ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোনা জেলায় নদ-নদীর পানি ও বৃষ্টিপাত হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে চলমান বন্যা পরিস্থিতি সার্বিক উন্নতি হচ্ছে। তবে অনেক জায়গায় বন্যার পানি এখনো পুরোপুরি নামেনি। তিস্তা, সুরমা, কুশিয়ারা, পুরাতন-সুরমা ও সোমেশ^রীসহ দেশের উত্তর-পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলের ৫টি নদ-নদী ৭টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
যমুনা নদের পানি সবক’টি পয়েন্টে বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে যমুনাপাড়ের বিশেষত নিম্নাঞ্চলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বন্যার।
সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বাড়ছেই। এর ফলে প্লাবিত হচ্ছে যমুনার অভ্যন্তরীণ চরাঞ্চলের ফসলি জমি, খেত-খামার। গত ৫ দিন ধরে টানা পানি বাড়ছে যমুনায়। পাশাপাশি শাখা নদ-নদীগুলোরর পানিও বেড়ে চলেছে। পাউবো’র পূর্বাভাসে জানা গেছে, যমুনা নদে আরও তিনদিন পানি বাড়তে পারে। বিপদসীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা রয়েছে। গতকাল সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে যমুনার পানি বেড়ে বিপদসীমার ৮২ সে.মি. নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। যমুনার পানি বৃদ্ধিতে সিরাজগঞ্জ জেলার ৫টি উপজেলার চরাঞ্চলের গ্রামগুলোর ফসলি জমি, সবজি খেত-খামার প্লাবিত হতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তলিয়ে গেছে চরাঞ্চলের নিম্নাঞ্চল। চরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে বন্যার আতঙ্ক বিরাজ করছে। তিস্তা ছাড়াও ভারতের ঢলে উত্তরাঞ্চলের অন্যতম নদী ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি বৃদ্ধিতে নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
দেশের অন্যতম প্রধান অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফের ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। তবে যমুনা নদের সবক’টি পয়েন্টে পানি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সতর্কসীমার কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত যমুনা নদের পানি বেড়ে সাঘাটায় ৫১ সে.মি., বাহাদুরাবাদে ৭০ সে.মি., ফুলছড়িতে ৭৮ সে.মি. নিচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গতকাল পানি উন্নয়ন রোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র দেশের নদ-নদীর প্রবাহ পরিস্থিতি ও পূর্বাভাস বুলেটিনে কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। অন্যদিকে যমুনা নদের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় স্থিতিশীল থাকতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাবিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকতে পারে।
আবহাওয়া সংস্থাসূহের তথ্যানুযায়ী, দেশের উত্তরাঞ্চল ও এর সংলগ্ন উজানে আগামী ২৪ ঘণ্টায় হালকা থেকে মাঝারি এবং ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টায় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। এর ফলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার নদীসমূহের পানি সাময়িক হ্রাস পেতে পারে। তবে পরবর্তী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টায় এসব নদীর পানি আবারও বৃদ্ধি পেতে পারে।
নদ-নদীর প্রবাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে পাউবো জানায়, পর্যবেক্ষণাধীন ১১০টি স্টেশনের মধ্যে গতকাল ৫৯টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পায়, ৪৮টিতে হ্রাস পায় এবং দু’টিতে পানি অপরিবর্তিত ছিল। এখন পর্যন্ত তিস্তা, সুরমা, কুশিয়ারা, পুরাতন-সুরমা ও সোমেশ^রী নদীগুলো বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাউবো সূত্রে পূর্বাভাসে জানা গেছে, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও রংপুরের নিম্নাঞ্চল এবং চরাঞ্চলসমূহ একের পর এক প্লাবিত হচ্ছে। রংপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।
ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ তিস্তা নদীর অববাহিকার উজানের অংশে ভারী বর্ষণের সরাসরি প্রভাব পড়েছে তিস্তা নদীতে। ভারতে বাঁধ খুলে দেয়ায় হু হু করে ভাটিতে উত্তরাঞ্চলকে প্লাবিত করছে ঢল-বানের পানি। তিস্তার তলদেশ অনেকাংশে পলি-বালুতে ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে তিস্তায় পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে। উজানের ঢল এলেই ‘উত্তরের পাগলা নদী’ তিস্তার দুই কুল উপচিয়ে নিম্নাঞ্চল দ্রুত প্লাবিত হয়। সৃষ্টি হয় বন্যা পরিস্থিতির।
সিলেট ব্যুরো জানায়, ভারী বর্ষনের পূর্বাভাস রয়েছে সিলেটের জমিনে। অথচ এই ভারী বর্ষন ও ভারতের পাহাড়ী ঢলে-ই বন্যা কবলিত নগর সহ সিলেটের প্রত্যন্ত জনপদ। কিন্তু গত তিন দিন ধরে পূর্বাভাসের উল্টো চিত্র দেখা মিলছে সিলেটে। রোদ্দুর আকাশের তেজ ছড়িয়ে পড়ে ঝরঝরে ভাব বিরাজ করছে সর্বত্র।
বৃষ্টি কমায় উন্নতির পথে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি। যদিও এখনো পাঁচ পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে এই অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও এসব এলাকার মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট।
সিলেট শহরে সুরমা নদীর পানি কমে বর্তমানে বিপদসীমার তিন সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে ১০.৭৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন বাসা বাড়ি থেকে নামতে শুরু করেছে পানি। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি কম হওয়ায় উন্নতি হয়েছে সিলেটের নদীর পানিপ্রবাহের। তবে এখনো সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে। কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশীদ পয়েন্টে কিছুটা কমে বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে। সারি, ডাউকি, গুয়াইন ধলাইসহ গোয়াইনঘাটের সব নদীর পানিও বিপদসীমার নিচে চলে এসেছে। তবে ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ সাধারণ মানুষের। মিলছে না শিশুদের জন্য খাদ্য। সিলেটে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ মানুষ এখনো দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। অপরদিকে সুনামগঞ্জে সাড়ে আট লাখের বেশি মানুষ বন্যাকবলিত।
এদিকে, সিলেট নগরীর পানিবদ্ধতা নিরসনে একসাথে মাঠে নেমেছেন সিসিকের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও বর্তমান মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। বন্যা ও পানিবদ্ধতায় নগরবাসীর উপর্যুপুরী দুর্ভোগের প্রেক্ষিতে গতকাল শনিবার বেলা ৩টায় তারা দুজন নগরের স্টেডিয়াম এলাকার সংলগ্ন মাদার কেয়ার হাসপাতালের পাশের বৈটাখাল ছড়া পরিদর্শন করেন। এসময় ছড়ায় পানি প্রবাহে বিভিন্ন প্রতিবন্ধতা তদারকি করেন এবং সমস্য সমাধানে একে অপরকে আশ্বাস দেন সহযোগিতার।
সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, সিলেট সিটির মাস্টার প্ল্যান অনুয়ায়ী কাজ করলে মূল উৎপত্তি স্থল থেকে নগরীর ছড়া সরকারি ভাবে খননসহ শহর রক্ষা বেড়ি বাঁধ করা যায় তাহলে এর লাঘব হবে। কালক্ষেপণ না করে একটা একটা করে সমস্যার সমাধান করতে হবে। আমরা আশা করি আগামী ৪ বছরের মধ্যে সিলেটে অনেক বেশি উন্নয়ন হবে। নগরীর স্বার্থে শুধু আমি কেন, অন্যান্য যারা আরও দায়িত্ববান ও রাজনীতিবিদরা আছেন সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান আরিফুল হক চৌধুরী।
কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের দ্বীপ চর বালা ডোবা গ্রাম। বন্যায় ডুবে আছে চরটি। ঘরবাড়ি গবাদিপশু নিয়ে মানুষের দুর্ভোগের চরমে। নিম্নাঞ্চল হওয়ায় গত সাতদিন ধরে পানির মধ্যে বসবাস করছে এ এলাকার মানুষজন। এখন পর্যন্ত কোন সরকারি বেসরকারি ভাবে চর বালা ডোবার মানুষের পাশে দাড়ায়নি বলে অভিযোগ করছেন এলাকাবাসী।
বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ৪ কি. মি. দূরে চর বালা ডোবার অবস্থান। চারপাশে ব্রহ্মপুত্র নদ বেষ্টিত এই চরটিতে নৌকা ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই। পানিতে ভাসা এই চরটির মানুষজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত সাতদিন ধরে পানির মধ্যে বসবাস করছেন তারা। অনেকেই ঘরবাড়ি তালা দিয়ে লোকালয়ের বাঁধ আশ্রয়কেন্দ্র স্কুল ও স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। যারা আছেন তাদের কষ্টের সীমা নেই। ঘরে বাইরে পানি থাকায় খাটের মধ্যে একদিকে চুলা আর একদিকে কোন রকম থাকার ব্যবস্থা করে দিন কাটাচ্ছেন তারা। এছাড়া গবাদিপশু নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে। নেই উচু জায়গা, বন্যার আগে কোন রকম ছোট ভিটা উচু করে সেখানে গরু ছাগল নিয়ে দিন কাটছে তাদের। করে বিশুদ্ধ পানি, শুকনো খাবারের অভাব দেখা দিয়েছে চর বালা ডোবা গ্রামের শতাধিক পরিবারের মাঝে। এমন দুর্ভোগে দেখার কেউ না থাকায় সরকারি বেসরকারি সহযোগিতা আশা করছেন তারা। বিশেষ কথা হয় চর বালা ডোবা গ্রামের জিন্নাত আলী-রঙমালা দম্পতির সাথে তারা বলেন, হামরা গত সাতদিন ধরে ঘরে পানি। খাওয়ার কষ্ট, একবেলা রান্না করে দুবেলা খাওয়া ছাড়া উপায় নাই। কোথাও যাওয়ার উপায় নাই। গরু বাচুর নিয়ে খুব বিপদে আছি। নুরনাহার বেগম বলেন, এ চরে সবাই খ্বু কষ্টে আছি। চেয়ারম্যান মেম্বার এখন পর্যন্ত হামারগুলার কোন খোঁজ নেয় নাই। পানি তো বাড়তেছে এমন পানি বাড়লে বাচ্চা কাচ্ছা নিয়ে কই যামো।
বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. বাবলু মিয়া বলেন, চর বালা ডোবা গ্রামের চারদিকে পানি। ওখানকার পরিবারগুলো খুব কষ্টে আছে। আমরা নদী ভাঙন ও বন্যায় ক্ষতি গ্রস্থদের তালিকা উপজেলা প্রশাসনের নিকট জমা দিয়েছি। আশা করছি দ্রুত চর বালা ডোবা গ্রামের মানুষজন সহযোগিতা পাবে।
সুনামগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, সুনামগঞ্জে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। নদীর পানি কমছে। তবে পানি ধীরে কমায় মানুষের ভোগান্তি দীর্ঘ হচ্ছে। সুনামগঞ্জে চার দিন পর ষোলঘর পয়েন্টে সুরমার পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে এখনো জেলা নিম্ন অঞ্চলের কিছু বাড়িঘর, রাস্তাঘাটে পানি আছে। জেলার প্রায় ২৭ হাজার পরিবার আছেন বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, গত দুদিন সুনামগঞ্জে ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি কম হয়েছে। এতে পাহাড়ি ঢল কম নামছে। মূলত এ কারণেই নদীর পানি কমছে। ফলে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আপাতত পরিস্থিতি অবনতির কোনো আশঙ্কা নেই বলে জানান তিনি।
পাউবোর তথ্যমতে, গত রোববার দুপুর ১২টায় সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নবীনগর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে। সোমবার একই সময়ে পানি বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। চার দিন পর গতকাল শনিবার সুরমা নদীর পানি এখানে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকাল ৬টায় পানির উচ্চতা ছিল ৭ দশমিক ৭১ মিটার যা বিপদসীমার ১১ সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে। সুনামগঞ্জে গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়নি। জেলার উঁচু এলাকায় পানি কমলেও নিচু এলাকায় পানি এখনো স্থির হয়ে আছে। ছাতক, সদর, দোয়ারাবাজার উপজেলায় কিছু বাড়িঘরে এখনো পানি রয়েছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলায় ১ হাজার ১৯টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি প্রায় ৮ লাখ ২৫ হাজার মানুষ। আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে প্রায় ২৭ হাজার পরিবার।
অসংখ্য ঘরবাড়ি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ। প্রথম দিকে সদর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা আক্রান্ত হলেও পরে জেলার সব উপজেলা বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। ছয় দিন ধরে মানুষ দুর্ভোগে আছেন। দিন যত যাচ্ছে পানিবন্দী মানুষের ভোগান্তি তত বাড়ছে। অনেকের ঘরে খাবারের সঙ্কট আছে।
জেলার সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক-দোয়ারাবাজার উপজেলায় মানুষ দুর্ভোগে আছেন বেশি। পাহাড়ি ঢল নেমে প্রথমেই আঘাত হানে এই তিন উপজেলায়। ছাতক এক সপ্তাহ ধরে বন্যা কবলিত। এখনো জেলার সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়ক, সুনামগঞ্জ-দোয়ারাবাজার সড়ক, সুনামগঞ্জ-বিশ্বম্ভরপুর সড়ক দিয়ে সরাসরি যান চলাচল করতে পারছে না। সুনামগঞ্জ শহরে অনেক মানুষের বসতঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি কমলেও ঘরে ভিতরে কাঁদা-ময়লার স্তুপ জমে, এতে অনেক মানুষ দুর্ভোগে পড়ছেন। শহরের উকিলপাড়ার পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সৈয়দ ইয়াসিনুর রশিদ বলেন, গত দুই দিনে পানি কমেছে। তবে পানি ধীরে কমছে। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় মানুষের মনে স্বস্তি ফিরেছে।
বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতির কথা জানিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী ইনকিলাবে জানান, পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী আছে। ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনো খাবার, রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ত্রাণের কোনো সঙ্কট নেই।
সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। নদী ভাঙনে ১২২ পরিবার বিলিন। চরাঞ্চলের ৪ সহ¯্রাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। এদিকে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত কয়েক দিনের নদী ভাঙনে উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের পাড়াসাদুয়া ও মাদারীপাড়ায় ১২২টি পরিবার বিলিন হয়েছে। ভাঙন কবলিত পরিবারগুলো পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। পানিবন্দী পরিবারগুলোর দুর্ভোগ বেড়েছে। উপজেলার তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, কঞ্চিবাড়ী, চন্ডিপুর, কাপাসিয়া ও শ্রীপুর ইউনিয়নের ২০টি চরের মানুষ দীর্ঘ মেয়াদি বন্যার আতঙ্কে রয়েছেন। এসব এলাকার বিভিন্ন ফসলাদি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। পানিবন্দী মানুষরা গৃহপালিত পশু-পাখি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। সরকারিভাবে বরাদ্দ একেবারে অপ্রতুল।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রাশিদুল কবির বলেন, আউস ১১০ হেক্টর, বাদাম ৭৩ হেক্টর, আমন বীজতলা ১৭ হেক্টর, শাক সবজি ২৩ হেক্টর ও পাট প্রায় ১৫৫ হেক্টর নিমজ্জিত হয়েছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ওয়ালিফ মন্ডল বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি সহযোগিতা প্রদান করা হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, চরাঞ্চলের প্রায় ৪ সহ¯্রাধিক মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। পানিবন্দী লোকজনের জন্য দুইটি নৌকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নদী ভাঙনে ১২২ পরিবার নদীগর্ভে বিলিন হয়েছে। নদী ভাঙন ও বন্যা কবলিত লোকজনের জন্য ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এটাকা ক্ষতিগ্রস্ত ৬০০ লোকের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, গো-খাদ্যের জন্য দুই লাখ ও শিশু খাদ্যের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। আরও বরাদ্দের জন্য আবেদন করা হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া মাত্রই ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
রাজনগর (মৌলভীবাজার) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, টানা বৃষ্টি উজানের ঢলে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলাজুড়ে বন্যা পরিস্তিতি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌছেছে। ইতোমধ্যেই প্রায় লাখো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তাছাড়া আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন কয়েক হাজারের বেশি মানুষ। শনিবার সকাল ১০ পর্যন্ত কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বিপদসীমার উপর দিয়ে পানিপ্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন সূত্র মতে, গতকাল শনিবার দুপুর ১২ টার হিসেব মতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। ১১টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৭ হাজারের অধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
বন্যার পানিতে ভেসে গেছে ছোটবড় প্রায় চার শতাধিক পুকুর ও ফিসারীর কোটি কোটি টাকার মাছ, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পোল্ট্রি ফার্ম। এতে মুনাফা লাভ করাতো দূরের কথা, বিভিন্ন ব্যাংক, মহাজনদের ঋণ পরিশোধের অনিশ্চয়তায় হতাশায় ভুগছেন খামারিরা। বিনষ্ট হয়েছে সদ্য বপনকৃত শতাধিক হেক্টর আমনের বীজতলা ও উৎপাদিত শাক সবজির মাঠ। কুশিয়ারা তীরবর্তী কাউয়াদিঘী হাওর রক্ষার বাঁধ (ওয়াপদার বাঁধ) নিয়েও রয়েছে সংসয়, যে কোন সময় অতিতের মতো বাঁধ ভেঙে হাওর পাড়ের মানুষকে ফেলতে পারে বিপর্যয়ের মূখে, এ নিয়ে আতঙ্কে দিন রাত কাটাচ্ছেন কাউয়া দিঘী হাওর পাড়ের মানুষ।
গতকাল শনিবার সকাল ১১টা থেকে দিনব্যাপি বন্যায় অধিক আক্রান্ত এলাকায় ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ, ওয়াপদার বাঁধ ও কুশিয়ারা নদীর ভাঙন পরিদর্শন করেছেন, রাজনগর-মৌলভীবাজার সদর উপজেলার সংসদ সদস্য মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান, উপস্থিত ছিলেন রাজনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, মো. শাহজাহান খাঁন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সুপ্রভাত চাকমা, ১ নম্বর ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, নকূল চন্দ্র দাশ প্রমূখ। বানবাসী মানুষদের মধ্যে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধপানিসহ ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়। এবং দূর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া ৪৯ মেট্রিক টন চাল রাজনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। শীঘ্রই রাজনগর উপজেলাকে দূর্গত এলাকা ঘোষণা করে, খাবার, পানি বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট ও পানিবাহিত রোগের ওষুধপত্রসহ পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন বানভাসি লোকজন।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ডেনমার্ক সরকারের আইএফইউ কর্তৃক একেএস খান ফার্মাসিউটিক্যালসে ১২.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ
রাশিয়ার জনগণকে ভালোবাসেন ট্রাম্প!
বিমানবন্দরে রাতভর তল্লাশিতে মেলেনি কিছুই : শাহজালালে ফের বোমা হামলার হুমকি বার্তা
বিপুল কর্মী ছাঁটাই করতে যাচ্ছে সংবাদমাধ্যমগুলো
ইএফডি মেশিনের আগে সব ব্যবসায়ীদের ভ্যাটের আওতায় আনুন
বিএনপিতে চাঁদাবাজ অত্যাচারী ও দখলবাজের কোনো জায়গা নেই : আমান উল্লাহ আমান
নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ইসলাম-ই কার্যকর পন্থা শীর্ষক জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত
বিশ্বনাথে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সুইট গ্রেফতার
সোনারগাঁওয়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রধান কার্যালয় উদ্বোধন
রূপগঞ্জে শীতার্তদের ঘরে ঘরে কম্বল পৌঁছে দিলেন এসিল্যান্ড
চরনিখলা উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত
ধামরাইয়ে ভাড়ারিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ঝুলছে তালা
মাদক চাঁই রুবেল দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেফতার
দুর্নীতির মামলায় খুলনার সাবেক এমপি মিজানুর রহমান কারাগারে
সাধন চন্দ্র মজুমদারের আয়কর নথি জব্দ
জুলাই বিপ্লবে প্রত্যেকটি খুনের বিচার হতে হবে
এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ৫ম ওয়ার্ল্ড ফেয়ার অ্যান্ড ফেস্ট ট্যাম্পা বে-২০২৫
নারায়ণগঞ্জে কিউলেক্স মশার উপদ্রবে নাজেহাল নগরবাসী
স্বতন্ত্র বিধিমালা ও নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করার আহ্বান
নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করুন : নবীন পুলিশদের আইজিপি