চট্টগ্রামে রেয়াজুদ্দিন বাজারে ভবনে আগুন দমবন্ধ হয়ে নিহত ৩
২৯ জুন ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২৯ জুন ২০২৪, ১২:০২ এএম

চট্টগ্রাম নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজারে একটি ভবনে আগুন লাগার পর ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে তিনজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ভবনের কয়েকশ দোকান। বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার দিকে বাজারে মোহাম্মদিয়া প্লাজার ব্রাদার্স টেলিকম নামে একটি দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে তা পাশের রেজওয়ান কমপ্লেক্সেও ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, সরু গলির ভেতর ওইদুটি ভবনের অবস্থান হওয়ায় উদ্ধার ও অগ্নিনির্বাপণ কাজে বেগ পেতে হয়েছে। তাছাড়া এসব ভবনে অগ্নি নিরাপত্তা বলে কিছুই নেই।
বন্দরনগরীর বেশির ভাগ মার্কেটের চিত্রই এমন। নগরীতে জনসংখ্যার পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বহুতল ভবনের সংখ্যাও। আর এসব অধিকাংশ বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে নেই পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তার ব্যবস্থা। যদিও ভবনের কাজ শুরুর আগেই ফায়ার সার্ভিস থেকে অনাপত্তিপত্র নেয়ার বিধান আছে, কিন্তু ৯৩ শতাংশ ভবনের সেই অনাপত্তিপত্র নেই।
এ ছাড়া ভবন নির্মাণ শেষে ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে ছাড়পত্র নেয়ার বিধান থাকলেও, ৯৭ শতাংশ ভবনের সেটি নেই। এমনকি অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিতে কোনো ধরণের ব্যবস্থা নেই এমন ভবনের সংখ্যা ৯৭ শতাংশ। আবার বাণিজ্যিক ভবনে আবাসিক এবং আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করায়ও অগ্নিঝুঁকি বাড়ছে। ফলে নগরীর বেশির ভাগ মার্কেট ও ভবনই যেন এক একটি মৃত্যু কূপ। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে রেয়াজুদ্দিন বাজারের তামাকুমন্ডি লেনের একটি ভবনে আগুন লাগার পর তিনজন মানুষের বেঘোরে মৃত্যু নগরীর মার্কেট ও আবাসিক ভবনের অগ্নিঝুুঁকির বিষয়টি আবার সামনে নিয়ে এসেছে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পাঁচতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় আগুন লাগার পর পঞ্চম তলায় থাকা ওই তিনজন বের হতে পারেননি। সেখানেই তারা দমবন্ধ হয়ে মারা যান। তারা হলেন- মো. রেদোয়ান (৪৫), মো. ইকবাল (২৬) ও মো. শাহেদ (১৮)। তিনজনেই চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার বাসিন্দা। চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আবদুর রাজ্জাক জানান, রাত ১টা ৩৫ মিনিটে আগুন লাগার খবর আসে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। খবর পেয়ে আগ্রাবাদ, নন্দনকানন, চন্দনপুরা ও লামারবাজার ফায়ার স্টেশনের আটটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। প্রায় চার ঘণ্টার চেষ্টায় ভোর সাড়ে পাঁচটায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
এর আগে, ঘটনাস্থল তথা ভবনের একটি বাথরুম থেকে প্রথমে শাহেদের লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে দুইজনকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। আগুনের ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। কাতোয়ালী থানার উপ পরিদর্শক মো. মহিউদ্দিন বলেন, আগুন লেগেছে মোহাম্মদিয়া প্লাজা নামে একটি মার্কেটের দোকানে। সেখানে মোবাইলের বিভিন্ন সরঞ্জাম ছিল। আগুনের ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে তিনজন মারা গেছেন। দুইজন আহত হয়ে চমেক হাসপাতালে ভর্তি আছেন। শুক্রবার মার্কেট বন্ধ থাকায় অনেকেই বাড়িতে চলে গেছেন। না হলে হতাহতের সংখ্যা আরো বেশি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক বলেন, রাত দেড়টায় আগুন লাগার খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে আসি। ফায়ার সার্ভিসও সঙ্গে সঙ্গে এসে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। মার্কেটের ওপরে ব্যাচেলর বাসা আছে। সেখানে মার্কেটের বিভিন্ন দোকানের কর্মীরা থাকতেন। আগুন লাগার পর অনেকেই নামতে পারেনি। এখানকার রাস্তা গুলো খুব সরু। ১১০টি মার্কেট আছে। এর মধ্যে দুইটি মোহাম্মদিয়া প্লাজা ও রেজওয়ান কমপ্লেক্স। মোহাম্মদিয়া প্লাজার ব্রাদার্স টেলিকম থেকেই আগুনের সূত্রপাত। আগুনের ধোঁয়ায় ভবনে থাকা কয়েকটি বিড়ালও মারা গেছে।
স্থানীয়রা জানান, ভবনের বিভিন্ন তলায় দোকান কর্মচারীরা থাকেন। তবে বৃহস্পতিবার শেষ কর্মদিবস হওয়ায় প্রায় সবাই বাড়ি চলে গেছেন। ফলে বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। সকালে সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী আহতদের দেখতে চমেক হাসপাতালে যান। তিনি তাদের চিকিৎসার খোঁজ খবর নেন এবং নিহত তিনজনের লাশ বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। নগর জামায়াতের আমির সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরীও হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান।
কালেমা পড়তে পড়তে মৃত্যুর কোলে শাহেদ : মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়লে ধোঁয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মোহাম্মদীয়া মার্কেট। এ সময় কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে দোকান কর্মচারী শাহেদ ফোন করেন দোকানের মালিক সাজ্জাদ মিয়াকে। তখন সময় রাত পৌনে ২টা। ফোন পেয়েই দোকান মালিক শাহেদকে নির্দেশনা দেন- সে যেন সিঁড়ি বেয়ে ছাদের উপরে উঠে যায়। কিন্তু ধোঁয়ায় চোখ-মুখ বন্ধ হয়ে যায় শাহেদের। সবদিকে অন্ধকার। পরে আবারও ফোন দেন শাহেদ। তখন সাজ্জাদ পরামর্শ দেন-চোখে মুখে কাপড় মুড়িয়ে হলেও যেন ছাদে দৌঁড়ে চলে যায়। কিন্তু নিরুপায় শাহেদ। নিজেকে বাঁচাতে হামাগুড়ি দিয়ে খুঁজে নেন বাথরুম। সেখান থেকে মালিককে ফের ফোন দিয়ে জানান- আমি টয়লেটে, আমার জন্য দোয়া করবেন। কালেমা পড়তে পড়তে মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর তখনই শাহেদ বাথরুমে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। শাহেদের সাথে তার বন্ধু ইকবালও মারা যান সেখানে। ছোটবেলা থেকেই একসঙ্গে চলাফেরা তাদের। শাহেদ চলে আসেন শহরে। বন্ধুত্বের টানে ইকবালও চলে আসেন। শাহেদ চাকরি নেন আজওয়ার টেলিকমে। ইকবালের চাকরি শহরের অন্য জায়গায়। রাতেই দুই বন্ধু একত্রিত হন। আগুনে তাদের মৃত্যুও হলো একসঙ্গে।
অগ্নিঝুঁকি বাড়ছে দুর্ঘটনা : নগরীতে প্রতিনিয়তই মার্কেট, বিপণিকেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এর আগে ২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আন্দরকিল্লায় সমবায় মার্কেটে আগুনের ঘটনায় এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ওই বছরের ১২ জানুয়ারি রেয়াজুদ্দিন বাজারের নুপুর মার্কেটে, ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রেয়াজউদ্দিন বাজারের পাশে হোটেল সফিনায়, ২০২০ সালে ৩০ আগস্ট চৌধুরী প্লাজায় এবং ২০১৯ সালে ১৯ অক্টোবর জহুর হকার্স মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
বারবার অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটলেও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই বেশির ভাগ মার্কেটে। ফায়ার সেফটি না থাকাসহ বেশ কিছু অব্যবস্থাপনার জন্য বেশ কয়েকটি মার্কেটকে বিগত সময়ে জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জরিমানাসহ সতর্কও করা হয়। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। মার্কেট কর্তৃপক্ষ নেয়নি কার্যকর পদক্ষেপ।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, রেয়াজউদ্দিন বাজারকে ঘিরে শত শত মার্কেট ভবন গড়ে উঠেছে। এইসব ভবনের বেশির ভাগই গড়ে ওঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। এখানে একটি মার্কেটের সঙ্গে আরেকটি মার্কেটে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। এই বাজারে তিনশ থেকে চারশ মার্কেটই এক ছাদের নিচে। ফলে আগুন লাগলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে। এছাড়া অধিকাংশ মার্কেট ও বাজারের গলি সরু। পানিও পাওয়া যায় না। ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় এসব এলাকায় যন্ত্রপাতি নিয়ে দ্রুত পৌঁছানোও কঠিন। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) হিসেবে, নগরীতে প্রায় ৭ হাজারের মতো বহুতল ভবন আছে। এরমধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ভবন আবাসিক এবং বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। আবাসিক ও বাণিজ্যিক উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ভবনগুলোই সবচেয়ে বেশি আগুনের ঝুঁকিতে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। নগরীর ৭০ শতাংশ মার্কেট, বাজার ও বিপণী বিতান উচ্চমাত্রার অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। অন্যদিকে চার দশকে চট্টগ্রামে বিলীন হয়েছে ২৪ হাজার জলাধার। যে কারণে অগ্নি-নির্বাপণে ফায়ার সার্ভিসকে পানির সংকটে পড়তে হয়।
গাড়িতে আগুন : গতকাল বিকেলে নগরীর জামালখান পিডিবি কলোনীতে রাখা একটি মাইক্রোবাসে হঠাৎ আগুন লেগে যায়। তাৎক্ষণিক আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে আগুন নিভিয়ে ফেলে। ধারণা করা হচ্ছে গাড়িতে থাকা সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। ##
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও






আরও পড়ুন

সুনামগঞ্জে বিজিবি’র অভিযানে ৪১ লাখ টাকার অবৈধ মালামাল জব্দ

ইসরায়েলি গণহত্যায় মার্কিন সমর্থন বন্ধের আহ্বান ইরানের

ভারতকে কোনোক্রমে সভ্য রাষ্ট্র বলা চলে না : শায়খ আহমদুল্লাহ

সরকার পতনের যে নীলনকশা প্রমাণসহ ফাঁস করলেন পিনাকী

ঢাকা উত্তর বিএনপির ৭ নেতা বহিষ্কার, মিরপুরে বিক্ষোভ

নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্তে উত্তাল ইসরায়েল, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধান বরখাস্তের উদ্যোগ

মেসির দুর্দান্ত গোল, মায়ামির হ্যাটট্রিক

আছিয়া হত্যার বিচারের দাবিতে সাতক্ষীরায় মহিলা জামায়াতের মানববন্ধন

অপরাধে জড়িয়ে পড়লে কাউকে ছাড় নয়-মাহবুব আলমগীর আলো

কত হাজার কোটি টাকার মালিক শেখ সেলিম? জানা গেলো চাঞ্চল্যকর তথ্য!

ফরিদপুরে শিশুকে যৌন হয়রানির অভিযোগে ব্যবসায়ীকে গণপিটুনি

ঢাকায় হিজবুত তাহরীরের সক্রিয় সদস্য গ্রেপ্তার

১৯ দেশের মিশন প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে বসছে ইসি

ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের তীব্র নিন্দা

নর্থ মেসিডোনিয়ার নাইটক্লাবে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড: নিহত ৫৯, আটক ১০

ট্রেনে ঈদযাত্রা: ২৭ মার্চের টিকিট বিক্রি শুরু

কর্মবিরতি প্রত্যাহার, মেট্রোরেলে টিকিট ব্যবস্থা চালু

নাটোরে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আটক

ঢাকাসহ ৩ বিভাগে বৃষ্টি ও বজ্রপাতের পূর্বাভাস

ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি নিয়ে পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসছেন ট্রাম্প