নিউ ইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধ

ক্র্যাকডাউনের পর গর্জে উঠেছে বাংলাদেশ

Daily Inqilab স্টাফ রিপোর্টার

০৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:১২ এএম | আপডেট: ০৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:১২ এএম

একটি মারাত্মক সরকারি দমন-পীড়নের মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর গত শনিবার থেকে নতুন করে বিক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে।
বিক্ষোভকারীরা আবারো রাস্তায় নেমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে গলা চড়িয়েছেন। গত মাসে শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করার প্রচেষ্টায় বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী হামলা চালালে তা সহিংস রূপ নেয়। সরকার ছাত্র সংগঠকদের আটক করে, প্রায় ১০,০০০ লোককে গ্রেপ্তার করে। সেইসঙ্গে আরো কয়েক হাজার ছাত্রের বিরুদ্ধে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের অভিযোগ তোলা হয়। কারফিউ এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে পরিস্থিতিকে তখন শান্ত করে সরকার । সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির অবসানের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আদালত থেকে উল্লেখযোগ্য জয় পেয়েছে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনীর ক্র্যাকডাউন - যার ফলে ২০০ জনেরও বেশি লোকের মৃত্যু হয়েছে-তা অনেক বাংলাদেশিকে আরো ক্ষুব্ধ করে তুলেছে এবং আন্দোলনের পরিধিকে প্রসারিত করেছে।

সাইফ হাসনাত ও মুজিব মাশালের লেখা নিবন্ধে বলা হয়, কারফিউ উঠে যাবার কয়েকদিন পরেই রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের পুনঃউত্থান, ১৭০ মিলিয়নের দেশের নেত্রী হিসাবে শেখ হাসিনাকে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। নিজের ১৫ বছরের শাসনামলে এতো কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাননি ‘আয়রন লেডি’। এর আগে ছাত্ররা শেখ হাসিনাকে ক্ষমা চাওয়ার এবং কিছু কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করার আহ্বান জানিয়েছিল। এখন, তারা শত শত বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর জন্য জবাবদিহি হিসাবে তার এবং তার সরকারের পদত্যাগ দাবি করছে। শেখ হাসিনা পদত্যাগ না করা পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা ‘সম্পূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন’ চালিয়ে যাবার আহ্বান জানিয়েছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে হেফাজতে নির্যাতনের শিকার ছাত্রনেতাদের একজন নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘তার ( শেখ হাসিনা ) যাওয়ার সময় এসেছে। শুধু শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করাই যথেষ্ট নয়। এদেশে যে খুন, লুটপাট ও দুর্নীতি হয়েছে তার বিচার প্রয়োজন।’ সামনের দিনগুলিতে সহিংসতা বাড়তে পারে, এই আশঙ্কায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রবিবার এবং সোমবার সারা দেশে দলীয় সমাবেশের আহ্বান জানিয়েছে।
স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা এবং দলের নেতাদের মতে, শনিবার সন্ধ্যার মধ্যে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার দলের বেশ কয়েকজন নেতার বাসায় হামলা হয়েছে।

প্রতিশোধ নিতে এর কয়েক ঘন্টা পরে, শহরে বেশ কয়েকটি বিরোধী নেতার বাড়িতেও হামলা করা হয়। ঢাকার একটি আদালত সব ধরনের সরকারি চাকরিতে অর্ধেকেরও বেশি কোটা পুনর্বহাল করার পর জুলাইয়ের শুরুতে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ শুরু হয়। ২০১৮ সালে বিক্ষোভের চাপে, মুক্তিযুদ্ধের বংশধরদের জন্য চলে আসা কয়েক দশকের পুরোনো ব্যবস্থার অবসান করেন শেখ হাসিনা। কোটাকে বৈষম্যমূলক বলে অভিহিত করেছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইস্যুটির উপর ক্ষোভ সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেশের স্থবির অর্থনীতি এবং একটি ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসক দলের প্রতি বৃহত্তর অসন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশ। প্রথমদিকে এই ছাত্র বিক্ষোভকে সেভাবে গুরুত্ব দেননি শেখ হাসিনা ।

যখন বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে এবং সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন সমঝোতার জন্য এগিয়ে আসেন প্রধানমন্ত্রী। তারপরে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে কোটা-সংরক্ষিত চাকরির অনুপাত ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে ক্র্যাকডাউনের ফলে একের পর এক ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার শেখ হাসিনা আবারও সমঝোতার কথা বলে জানিয়েছেন ‘আলোচনার জন্য গণভবনের দরজা খোলা। আমি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে তাদের কথা শুনতে চাই। আমি কোনো সংঘর্ষ চাই না।’ হাসিনার সরকার গত মাসের সহিংসতার জন্য তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামিকে দায়ী করেছে। তাদের নেতাদের গ্রেপ্তার করেছে। তিনি জামায়াতে ইসলামী এবং এর ছাত্র সংগঠনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার একটি ডিক্রিও জারি করেছেন। গোয়েন্দারা কয়েকজন আটক ছাত্র নেতাকে ক্যামেরার সামনে উপস্থিত করেন, যেখানে তারা তাদের আন্দোলনের সমাপ্তি ঘোষণা করে একটি বিবৃতি দেন। কিন্তু যে মুহুর্তে সরকার নিষেধাজ্ঞাগুলি শিথিল করেছে, বিক্ষোভকারীরা তাদের সহকর্মী যারা নিহত, আহত বা আটক রয়েছে তাদের ন্যায় বিচারের দাবি জানাতে শুরু করেছে। ছাত্রনেতারা মুক্ত হয়ে যাবার পর বলেছিল যে তাদের বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। তারা গণসমাবেশের আহ্বানের পুনরাবৃত্তি করে। নাহিদ ইসলাম, যে ছাত্রনেতা শনিবার শেখ হাসিনার পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাকে ১৬ জুলাইয়ের ক্র্যাকডাউন শুরু হওয়ার পরপরই নিরাপত্তা বাহিনী তুলে নিয়ে গিয়েছিলো। কয়েকদিন পরে যখন ছাত্রনেতা ইসলামকে মুক্তি দেওয়া হয়, তখন তার বোন ফাতেমা তাসনিম বলেছিলেন যে ভাইকে নির্যাতন করা হয়েছিল। তার হাতে ক্ষত ছিল এবং মারধরের কারণে তার উরু কালো হয়ে গিয়েছিল। কয়েকদিন পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাকে আবার তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাসনিম বলেন, ‘জনগণ বাংলাদেশে চলমান কর্তৃত্ববাদকে ভেঙে ফেলার জন্য তার ভাইয়ের মতো ছাত্র নেতাদের দিকে তাকিয়ে আছে।’ তিনি একজন বাঙালি কবির উদ্ধৃতি তুলে বলেন : ‘আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে ?’

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে সহিংস। কিন্তু বর্তমান ক্র্যাকডাউনের পর অনেকেই শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক ছাত্র এবং অন্যান্য তরুণদের টার্গেট করাকে সব সীমা অতিক্রম করা হিসেবে দেখছেন। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে ২০০ জনের বেশি মৃত্যুর মধ্যে ১৭৫টি পরীক্ষা করে দেখেছে । তারা দেখেছে ১৩৭ জনের শরীরে বুলেটের ক্ষত রয়েছে এবং মৃতদের মধ্যে ১০০ জনেরও বেশি লোক ৩০ বছরের কম বয়সী। ইউনিসেফ জানিয়েছে যে এই ক্র্যাকডাউনে কমপক্ষে ৩২ টি শিশু নিহত হয়েছে। শুক্রবার দুপুরের নামাজের পর বিক্ষোভকারীরা আবারো রাস্তায় নেমে আসে। শুক্রবার বিকেলের দিকে সারাদেশে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। এতে এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্তত দুইজন নিহত হয়েছেন।

শনিবার সেই সংখ্যা আরো বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ঢাকার পাশাপাশি দেশের অন্যান্য কয়েকটি জেলা জুড়েও বড় সমাবেশের খবর পাওয়া গেছে। শনিবার ঢাকায় নিরাপত্তা বাহিনীকে আরও সংযত দেখা গেলেও অন্যান্য জেলায় কয়েক ডজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ঢাকা কলেজের কাছে জড়ো হওয়া একদল বিক্ষোভকারীকে সেøাগান দিতে দেখা যায় , ‘আমার বুকের ভেতর ঝড় উঠেছে। আমি আমার বুক পেতে দিয়েছি। এগিয়ে আসুন এবং গুলি করুন।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, যিনি বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন তিনি বলছেন ‘যে কর্তৃপক্ষ এই ক্র্যাকডাউন পরিচালনা করেছিল সেই কর্তৃপক্ষই ন্যায়বিচার করবে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। আপনি কীভাবে একজন খুনিকে একটি হত্যার বিচার করতে বলবেন?এই হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়েছিল রাষ্ট্রের সহযোগিতায়।’


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

এবার সাদপন্থিদের ১০ দফা দাবি
সিকদার গ্রুপের ১৫ প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ
বিডিআর বিদ্রোহ : ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের কমিশন গঠন
বছরখানেক সময় পেলে সংস্কার কাজগুলো করে যাব : উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী সরকারের পুনরাবৃত্তি করবে না আশাবাদ রিজভীর
আরও

আরও পড়ুন

গাছ আর জিও ব্যাগ পেয়ে খুশি খুলনার ছাদবাগানীরা

গাছ আর জিও ব্যাগ পেয়ে খুশি খুলনার ছাদবাগানীরা

খুলনায় একাধিক মামলার আসামী সন্ত্রাসী রকি গ্রেপ্তার

খুলনায় একাধিক মামলার আসামী সন্ত্রাসী রকি গ্রেপ্তার

টাঙ্গাইলে সুবিধা বঞ্চিত গরীব অসহায়দের শীতবস্ত্র বিতরণ

টাঙ্গাইলে সুবিধা বঞ্চিত গরীব অসহায়দের শীতবস্ত্র বিতরণ

রাজবাড়ীতে পদ্মা নদীর এক বোয়াল ৫২ হাজারে বিক্রি

রাজবাড়ীতে পদ্মা নদীর এক বোয়াল ৫২ হাজারে বিক্রি

অচিরেই বিলুপ্ত হবে নেতানিয়াহু শাসন, হুমকি হুতি প্রধানের

অচিরেই বিলুপ্ত হবে নেতানিয়াহু শাসন, হুমকি হুতি প্রধানের

এলন মাস্ক কি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন? ট্রাম্প বললেন ‘অসম্ভব’

এলন মাস্ক কি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন? ট্রাম্প বললেন ‘অসম্ভব’

নাটোরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় চালকসহ এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নিহত

নাটোরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় চালকসহ এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নিহত

এবার সাদপন্থিদের ১০ দফা দাবি

এবার সাদপন্থিদের ১০ দফা দাবি

সা'দ পন্থীদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও আশুলিয়া থানায় স্মারক লিপি প্রদান

সা'দ পন্থীদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও আশুলিয়া থানায় স্মারক লিপি প্রদান

লক্ষ্মীপুরে পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু

লক্ষ্মীপুরে পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু

বাংলাদেশ নিয়ে কটুক্তি করা বিজেপি নেতা শুভেন্দুকে জুতাপেটা

বাংলাদেশ নিয়ে কটুক্তি করা বিজেপি নেতা শুভেন্দুকে জুতাপেটা

সিকদার গ্রুপের ১৫ প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ

সিকদার গ্রুপের ১৫ প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ

শীতের তীব্রতায় বাড়ছে ডায়রিয়ার প্রকোপ,বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা

শীতের তীব্রতায় বাড়ছে ডায়রিয়ার প্রকোপ,বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা

চিরিরবন্দরে আগাম জাতের আলুর ভালো ফলন ও দাম পেয়ে কৃষকেরা খুশি

চিরিরবন্দরে আগাম জাতের আলুর ভালো ফলন ও দাম পেয়ে কৃষকেরা খুশি

‘রেমিট্যান্স এ্যাওয়ার্ড-২০২৪’ পেল হংকংয়ে বসবাসরত ১০ বাংলাদেশি নারী

‘রেমিট্যান্স এ্যাওয়ার্ড-২০২৪’ পেল হংকংয়ে বসবাসরত ১০ বাংলাদেশি নারী

বিডিআর বিদ্রোহ : ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের কমিশন গঠন

বিডিআর বিদ্রোহ : ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের কমিশন গঠন

মার্কিন সিইও হত্যাকাণ্ড, সামাজিক মাধ্যমে ভুল তথ্যের বিপজ্জনক প্রভাব

মার্কিন সিইও হত্যাকাণ্ড, সামাজিক মাধ্যমে ভুল তথ্যের বিপজ্জনক প্রভাব

গাজীপুরে কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ

গাজীপুরে কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ

ঝিনাইদহে বেসিক জার্নালিজম বিষয়ক প্রশিক্ষণ শেষে সনদ বিতরণ

ঝিনাইদহে বেসিক জার্নালিজম বিষয়ক প্রশিক্ষণ শেষে সনদ বিতরণ

বছরখানেক সময় পেলে সংস্কার কাজগুলো করে যাব : উপদেষ্টা আসিফ নজরুল

বছরখানেক সময় পেলে সংস্কার কাজগুলো করে যাব : উপদেষ্টা আসিফ নজরুল