সে এক অভূতপুর্ব দৃশ্য! যা কাগজ-কলমের ভাষায় বর্ণনা করার সাধ্য নেই কারও! নেই আমারও! উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমÑ চারিদিকে শিশু-বুড়ো-যুবা-মহিলা, ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিক-মজদুর সর্বস্তরের জনতার আকাশছোঁয়া উল্লাসের এমন বাঁধভাঙা জনজোয়ার আগে কখনও দেখেনি কেউ! রাজপথে লাখো গণমানুষের কণ্ঠে গর্জে উঠে গগনবিদারি সেøাগান। আর তাতে যেন কেঁপে উঠছে আকাশ-বাতাস। “ডাউন, ডাউন! কে? কে? শেখ হাসিনা ডাউন! শেখের গোষ্ঠি ডাউন! নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর। বাংলাদেশ-বাংলাদেশ জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। স্বাধীনতা-স্বাধীনতা, জিন্দাবাদ-জিন্দাবাদ। এইমাত্র খবর এলোÑ খুনী হাসিনা পালিয়ে গেল। এইমাত্র খবর এলো শেখের বংশ নিপাত গেলো! স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তিপাক”।

বারো আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রাম। হাজারো বীর প্রসবিনী বীর চট্টলা। ইসলামের প্রবেশদ্বারÑ ‘বা’বুল ইসলাম’ খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের লাখো মানুষ গতকাল সোমবার দুপুরের পর থেকেই ঢল-বানের তোড়ের মতোই রাজপথে, সড়কে, রাস্তাঘাট, অলিগলিতে নেমে আসে। মিছিলের পর মিছিলের স্রোতে উত্তাল হয়ে উঠে চট্টগ্রাম মহানগরী। পিঁপড়ার সারির মতো সয়লাব হয় চারিদিক। কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। মিছিলকারী জনতা বন্দরনগরীর বিভিন্ন সড়কের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে কর্তব্যরত সেনাবাহিনীর জওয়ানদের হাতে ফুল, চকলেট তুলে দিতে, আবেগপ্রবণ হয়ে হ্যান্ডশেক ও কোলাকুলি করতে দেখা গেছে। সেনা সদস্যরাও সহাস্যে আনন্দ ভাগাভাগি করতে দেখা যায়। শুধুই চট্টগ্রাম মহানগরী নয়; বৃহত্তর চট্টগ্রামের মফস্বলের আনাচে-কানাচে দল-মত, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ রাস্তাঘাটে নেমে আসে।

তবে এ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ব্যতিক্রম ছিল হাসিনার আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ গং। রাস্তাঘাটে কোথাও তাদের টিকিটিও চোখে পড়েনি। অনেকেই গত দুয়েকদিনেই গা ঢাকা দিয়েছে। অনেকেই পালিয়ে গেছে অজানা গন্তব্যে। অন্যদিকে বিজয়-উল্লাসে গণমানুষের সেøাগানে সেøাগানে প্রকম্পিত হচ্ছে শহর-গ্রাম-জনপদ। সবারই কণ্ঠে উচ্চকিত হয় গণতন্ত্রের আলখেল্লাধারী স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ সরকারের শোচনীয় পতনের আনন্দবার্তা। হিজাব ও বোরখা পরিহিত গৃহবধুরা পর্যন্ত স্মরণীয় আনন্দের ঘটনায় ভাসতে ও নিজেকে স্মরণীয় রাখতে রাস্তাঘাট সড়কে নেমে আসেন।

ওই দৃশ্যপট ছিল বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের উত্তর প্রান্তে অক্সিজেন-ফতেয়াবাদ থেকে দক্ষিণে পতেঙ্গা-কাটগড়, পূর্বে মোহরা-কালুরঘাট থেকে পশ্চিমে হালিশহর-কাট্টলী-ফৌজদারহাট পর্যন্ত। অন্যদিকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের উত্তরে মীরসরাই থেকে সর্ব-দক্ষিণে টেকনাফ-বান্দরবান অবধি একই দৃশ্য চোখে পড়ে। স্রোতের মতো একেকটি মিছিলে ধনী-গরীব, জেলে-দিনমজুর, রিকশা-ভ্যান-ঠেলাচালক, কৃষক সর্বস্তরের মানুষের জোয়ারে প্লাবিত হয় সমগ্র চট্টগ্রাম। সেই সঙ্গে সড়কে রাস্তাঘাটে ঘন ঘন হর্ণ বাজিয়ে ছুটে চলে নানা ধরনের গাড়ি। জনতার ঢলে ভেসে যায় কারফিউ। গতকাল সকালের দিকে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-র‌্যাব তৎপর ছিল। তবে দুপুর গড়াতেই সবখানে তারা নির্বিকার ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। পাল্টে যায় দৃশ্যপট।

তারা যা যা বললেনÑ
চট্টগ্রাম মহানগরীর কাজীর দেউড়ী মোড়ে কথা বলি কিশোর সাইফ মাহমুদের (১৬) সাথে। সে বললো, “দেশের ছাত্রসমাজের দাবি আদায়ের জন্য আমাদের শত শত বন্ধু সহপাঠী গত কয়েকদিনে খুনী শেখ হাসিনার পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি’র গুলিতে প্রাণ দিলো। হাজার হাজার ছাত্র পঙ্গু ও আহত হলো। এবার আমরা শেখ হাসিনাকে দেশছাড়া করেছি। ’৭১-এর পর আজ আমরা নতুন করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। খুনীদের বিচার চাই”। কথা হলো বেসরকারি চাকুরিজীবী জমিরউদ্দিনের সঙ্গে। বললেন, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের আস্থা ও ভরসার স্থল। তাদের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে দেশে একটি নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার গঠিত হোক। আগামীতে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য একটি জাতীয় নির্বাচন হোক। যে নির্বাচনে ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন। চাই সত্যিকারের বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা”।

কলেজ শিক্ষক শামীম আহমেদ বললেন, “সেই মঈন ইউ আহমেদের মতো কুচক্রী সরকার যেন আর এ দেশে না আসে। তাহলেই জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সাহেবকে ও সেনাবাহিনীকে সমগ্র দেশবাসী আজীবন স্মরণ রাখবে। তার সদিচ্ছা আছে আশা করি তিনি পারবেন”। দোকানি আবুল হাশেম বলেন, “শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, ওবায়দুল কাদের, মহিউদ্দিন চৌধুরীর ব্যর্থ-অযোগ্য পুত্র পতিত শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, বাবুপুত্র সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদসহ তার দল ও সরকারের সাঙ্গপাঙ্গদের বিচার হতে হবে এই বাংলার মাটিতে। বিদেশে তাদের পাচার করা হাজার হাজার কোটি টাকা ও অর্থ-সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে”।

রিকশাচালক বাবুল বলেন, “শেখ হাসিনা চোরের মতো পালিয়ে গেছে। আমার দেশকে এবং আওয়ামী লীগকেও সে ধ্বংস করে চলে গেছে। তার বিচার হতে হবে”। পথচারী আবুল কাসেমের কথা, “অহঙ্কার পতনের মূল। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। তার হাজারো অন্যায় অপরাধের ক্ষমা নেই। যদিও শেখ হাসিনা বিদেশে পালিয়ে গিয়ে জান বাঁচিয়েছে”।

তারাও পালিয়ে গেছেনÑ
বিনাভোটে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা স্বৈরশাসক প্রায় ১৬ বছর পর ক্ষমতার মসনদ থেকে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চোরের মতো বিদেশে পলায়নের আগেই তার বশংবদ, চামচা, স্তাবক বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পতিত মন্ত্রী-এমপি, মেয়র, সাবেক মন্ত্রী-এমপি, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতারা এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও সুবিধাভোগী আমলা ও ব্যবসায়ীরা আগেভাগেই যে যার মতো করে পালিয়ে গেছেন। এ বিষয়টি বৃহত্তর চট্টগ্রামের রাজনীতি সচেতন সাধারণ সর্বস্তরের মানুষের মুখে মুখে এখন ঘুরেফিরে উচ্চারিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা, পতিত মন্ত্রী-এমপি, মেয়র, সাবেক মন্ত্রী, সাবেক এমপি’রা এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা এখন চট্টগ্রামে নেই। দেশের বর্তমান টালমাটাল পরিস্থিতিতে অবস্থা বেগতিক দেখে তারা প্রায়ই লাপাত্তা।

আওয়ামী লীগের টিকেটি এমপি হয়েছিলেন এমন ভিন্ন দলের কোন কোন নেতাও উধাও। অনেকেই চট্টগ্রামের বাসাবাড়িতেও নেই। বেশিরভাগই বেশ আগেভাগেই পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে এবং আত্মগোপনে বিভিন্ন জেলায়। অনেকেই সপরিবারে চলে গেছেন। অনেকেরই পকেটে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের টিকেট রয়েছে। অনেকেই ইতোমধ্যে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। অথচ তারা এই সেদিনও ‘প্রধানমন্ত্রীর পাশে আছি’ এ ধরনের আশ^াস ও আস্ফালন দেখিয়ে গেছেন।

চট্টগ্রামবাসীই সর্বপ্রথম শেখ হাসিনা সরকারের বিতর্কিত মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলেন। গত শনিবার সন্ধ্যায় ছাত্র-জনতার বিশাল সমাবেশ শেষে নগরীর ষোলশহর অতিক্রমকালে চশমা হিলে মেয়র গলিতে বহুল সমালোচিত-বিতর্কিত, ব্যর্থ সদ্যপতিত শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বাড়িতে বিক্ষোভকারীরা হামলা-আক্রমণ ও ভাঙচুর চালায়। তাছাড়া নগরীর লালখানবাজারে সদ্যপতিত আওয়ামী লীগের এমপি মহিউদ্দিন বাচ্চুর ব্যবসায়িক কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। হামলা হয় চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বহদ্দারহাটের বাড়িতেও।