রউফের বিচার দাবি
১১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ১১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৩ এএম
দীর্ঘদিন থেকে অনিয়ম-দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ, রিজার্ভ সঙ্কট, অর্থ পাচার ও ডলার-সঙ্কটসহ নানামুখী চাপে ব্যাংক খাত। সদ্য পদত্যাগ করা গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ, সদ্য পদত্যাগ করা ডেপুটি গভর্নর কাজী সাইদুর রহমান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি চক্র এর মূলে কাজ করেছেন। গত ৫ আগস্ট সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পলায়ন করেন। এরপর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল মঙ্গল, বুধ ও বৃহষ্পতিবার। কিন্তু এই তিন দিনই অফিস করেননি বর্তমান আর্থিকখাতের দৈন্যদশা বা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির জন্য দায়ী গভর্নর। অবশ্য এ সময়ে নানাবিধ বিতর্কিত কর্মকান্ড ও আর্থিক কেলেঙ্কারীর হোতা গভর্নরের পদত্যাগের দাবীতে উত্তাল ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গত বুধ এবং বৃহষ্পতিবার গভর্নরের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন। এ সময়ে অফিস করেননি গভর্নর। এদিকে অফিস না করে গত শুক্রবার পদত্যাগ করেছেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। গর্ভনরের পদত্যাগে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিকখাতে খুশির আমেজ বিরাজ করছে। এছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির হোতা গভর্নরের অন্যতম সহযোগী ডেপুটি গভর্নর কাজী সাইদুর রহমানও পদত্যাগ করেন। এছাড়া তিন ডেপুটি গভর্নর, বিএফআইইউ প্রধান ও নীতি উপদেষ্টাকে বের করে দেওয়া হয়। তারা কেউ আর অফিসে আসেননি। যদিও শোনা যাচ্ছে, দীর্ঘদিন থেকে ব্যাংকখাতে আধিপত্য বিস্তাকারী ও অনিয়মের হোতা হিসেবে পরিচিত সাইদুর রহমান পদত্যাগ পত্র তুলে নিতে বর্তমান অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আজ রোববার দেখা করবেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা কোনভাবেই দীর্ঘদিনের আর্থিকখাতের নানা কেলেংঙ্কারীর এই নায়ককে ব্যাংকে ফিরতে দিবেন না। অবশ্য গতকাল সচিবালয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, আর্থিকখাতের অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত সকলের বিচার করা হবে।
সূত্র মতে, ২০২২ সালের ১১ জুন গভর্নর হিসেবে চার বছর মেয়াদে নিয়োগ পান আব্দুর রউফ তালুকদার। ওই বছরের ১২ জুলাই তিনি গভর্নর হিসেবে যোগ দেন। এর আগে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সচিব ছিলেন। করোনার সময়ে বিতর্কিত প্রণোদনা প্যাকেজকে যুগান্তকারী ও এ জন্য বাহবা কুড়িয়ে সম্প্রতি ভারতে পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্তাভাজন হন। পুরষ্কার সরুপ গভর্নর বনে যান। যদিও এই প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা এখনও ব্যাংকগুলো ফেরত পায়নি। কখনো পাবে কিনা এ নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। এ কারনে তারল্য সঙ্কটে ধুকছে ব্যাংকগুলো।
এদিকে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ব্যাপকভাবে সমালোচনার মুখে পড়েন রউফ তালুকদার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞার জেরে সাংবাদিকেরা গভর্নরের সব ধরনের অনুষ্ঠান বর্জন করে আসছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান হয়েও গত দু’বছরের বেশি সময় ধরে তিনি ব্যাংকখাতের নানা কেলেঙ্কারি ও অনিয়মের মদদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। এমনকি তার সময়ে এসব অনিয়ম নিয়ে গণমাধ্যমে লেখা বন্ধে আদালতের নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়। মূলত তার দুই বছরে আর্থিকখাতের বড় বড় অনিয়ম-কেলেঙ্কারি আড়াল করতেই সাংবাদিকদের ব্যাংকে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন গভর্নর। এদিকে আর্থিকখাতে অনিয়মের স্বর্গরাজ্য বানিয়ে ফেলতে গভর্নরের অন্যতম সহযোগী ছিলেন গত ১৯ মে অবসরে যাওয়া আর্থিক বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ। দু’জনে আতাত করে আর্থিকখাতে অনিয়মের স্বর্গরাজ্য বানিয়ে ফেলেন। এই সময়ে দু’জনে মিলে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক, মহাব্যবস্থাপক, পদোন্নতি-বদলী এবং নিয়োগ বাণিজ্য পরিচালনা করেছেন। সম্প্রতি উত্তরায় আব্দুর রউফ তালুকদারের সদ্য নির্মিত বিশাল অট্রালিকার সন্ধান মিলেছে। অনিয়ম-দুর্নীতির টাকায় এই বাড়ি তৈরি করেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিকখাত সংশ্লিষ্টরা গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, সাবেক সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ এবং ডেপুটি গভর্নর কাজী সাইদুর রহমানের সকল ব্যাংক হিসাব ও সম্পত্তি জব্দের দাবি জানিয়েছেন। তাদের মতে, চলমান আর্থিকখাতের বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী এই ত্রয়ী। তাদেরকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
অর্থনীতি বিষয়ক রিপোর্টারদের সংগঠন ইআরএফ’র সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম ইনকিলাবকে বলেন, ভুল নীতি ও অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে পুরো আর্থিকখাতকে খাদের কিনারে নিয়ে গেছেন আব্দুর রউফ তালুকদার। তার এই লুটপাট ঢাকতেই তিনি পদত্যাগ করেছেন। গ্রেফতারের ভয়ে এতোদিন অফিস করেননি। তিনি বলেন, এই গভর্নরের সময়ে নেয়া ভুল নীতির কারনে দেশের আর্থিককাতে দৈন্যতা বিরাজ করছে। অর্থপাচারসহ দেশে বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি সংগঠিত হয়েছে। যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে তিনি জড়িত। তাই অবিলম্বে তাকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান আবুল কাশেম। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, চলতি বছর গভর্নর নিজস্ব ইচ্ছে অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি ব্যাংককে একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন। যা শেষ পর্যন্ত প্রশ্নের মুখে পড়ে। অনেক ব্যাংকই সেই সিদ্ধান্ত এখনও মানতে নারাজ। এক্ষেত্রেও বড় অঙ্কের অর্থের লেনদেন হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন থেকেই গভর্নর, আর্থিক বিভাগের সাবেক সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ ও ডেপুটি গভর্নর সাইদুর রহমান সিন্ডিকেট ব্যাংকখাতকে অস্থিতিশীল করে রেখেছেন। আর আর্থিকখাতের এই দৈন্যদশার জন্য গত কয়েকদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় সব বিভাগের কর্মকর্তারা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন। তাদের ভাষ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা ‘অপকর্মে’ জড়িয়ে গেছে। গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নররা কোনো কাজ ‘সঠিকভাবে’ করতে পারেন না। আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলোতে তারা সঠিক পদক্ষেপ নেননি। বিক্ষোভকারীরা বলেন, দেশ থেকে অনেক টাকা পাচার হয়েছে, কিন্তু বিএফআইইউ’র প্রধান মাসুদ বিশ্বাস তা ঠেকাতে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারেননি। টাকা পাচার ও আর্থিক অনিয়মে এরা সবাই দায়ী। একাধিক কর্মকর্তা জানান, এসব কর্মকর্তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নিজের মত কাজ করতে পারছে না। কারণ এরা নানা রকম অনৈতিক কাজের সাথে জড়িয়ে গেছে।
সূত্র জানায়, শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় বড় ঋণ খেলাপীদের বিশাল অঙ্কের ঋণ মওকুফ করে দিয়ে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। শুধু ঋণ মওকুফই নয়; সচিবালয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং ব্যাংকিংখাতে নিজস্ব একটি বলয় তৈরি করেছেন। গত কয়েক বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকগুলোতে জিএম, ডিএমডি পদোন্নতি ও পরিচালক বসানো, নিজস্ব লোককে চেয়ারম্যান বানানো, বোর্ড ভেঙ্গে দেওয়া, ব্যাংকগুলোতে নিজস্ব লোককে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়ে বাণিজ্য করার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি অভিযোগ রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে ওই ব্যাংকটির সকল বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বানিয়ে বড় অঙ্কের ঋণ, পদোন্নতি বাণিজ্যসহ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা নেয়ার।
এদিকে আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর পদে থাকাকালীন অনেকগুলো ব্যাংকে আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, সেক্ষেত্রে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলে তিনি সব জবাবদিহিতার আওতা থেকে বের হয়ে যাবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ ও পরকিল্পনা উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এর মধ্যে একটি প্রক্রিয়ার ব্যাপার আছে। পদত্যাগপত্র উনি দিয়েছেন, তবে সেটা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত আমি একা নেব না। যেহেতু গভর্নরের পদটি কিছুটা স্পর্শকাতর তাই এ ব্যাপারে রোববার নির্ধারিত হওয়া সভায় সবার সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
দেশের বাইরে টাকা পাচার হওয়ার ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় কী ভূমিকা রাখবে তা জানতে চাওয়া হলে এটি সমাধানেও নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে বলে জানান এ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, টাকা পাচার হয়েছে সেটি আমরা জেনেছি। নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এ বিষয়ে তথ্যও লাগবে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
হাসিনাকে ফেরত আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন
আসাদের পতন, নিজের বেঁচে থাকার গল্প বললেন এক সিরিয়ান শরণার্থী
গভীর রাতে শীতার্ত মানুষের পাশে বিএনপি নেতা আমিনুল হক
বঙ্গতে আসছে 'ফ্যামিলি ফিউড বাংলাদেশ'
সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ সম্পন্ন
পানামা খাল দখলের হুমকি ট্রাম্পের, ভর্ৎসনা পানামার প্রেসিডেন্টের
কুমিল্লায় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হেনস্তার ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা
পাবনা-৩ এলাকায় অ্যাডভোকেট রবিউলের গণসংযোগ ও কম্বল বিতরণ
পান্থকুঞ্জ ও আনোয়ারা পার্ক নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
নারী পুলিশের দিকে তাকিয়ে আসামির হাসি, নেটদুনিয়ায় তোলপাড়
জার্মানির ক্রিসমাস মার্কেটে হামলায় ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুতে শোকের ছায়া
স্ত্রী-কন্যাসহ সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুরের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
গ্রেপ্তারের ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু
নাটোরে ৬ ট্রাকের সংঘর্ষে চালকসহ নিহত ২, আহত ৭
রাখাইনের অস্থিরতায় টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি কমেছে ৯০ ভাগ
ক্রিসমাস মার্কেট হামলা, জার্মান কর্তৃপক্ষের কাছে গত বছরেই এসেছিল সতর্কবার্তা
উপদেষ্টা হাসান আরিফকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন
ডলার বাজারে অস্থিরতা, দাম বেড়ে ১২৯ টাকা
উত্তরার বিপ্লবী জনতাকে যে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিল