দলবাজ বিচারপতিরা এখনো বহাল!
১২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ১২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৩ এএম
আপিল বিভাগের পর এবার দাবি উঠেছে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের অপসারণের। গত দেড় দশকে যারা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের করুণা-সানুগ্রহে ‘বিচারপতি’ পদে পুরস্কৃৃত হয়েছেন আলোচনায় রয়েছে তাদের নাম। বিগত ১৬ বছরে অন্ততঃ অর্ধশত বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগপ্রাপ্তদের বেশির ভাগই আইনজীবী।
কেউ আওয়ামী সরকারের ডেপুটি জেনারেল হিসেবে কাজ করেছেন, কেউ বার সম্পৃক্ত ছিলেন আওয়ামী ঘরানার বার পলিটিক্সে। জুডিশিয়াল সার্ভিস থেকে কিছু বিচারককে টানা হলেও তাদের বিচারিক কার্যক্রম, রায় এবং ভূমিকা ছিলো আওয়ামীলীগ সরকারের ফরমায়েশ অনুযায়ী। আইনজীবীদের মধ্য থেকে যাদের বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়েছে তারা প্রায় সবাই কোনো না কোনো ব্যানারে আওয়ামীলীগ-ছাত্রলীগ করা। দুয়েকজন রয়েছেন জাসদ রাজনৈতিক ব্যাক গ্রাউন্ডের। আওয়ামীলীগ করেনÑ এমন অনেক মেধাবী আইনজীবী থাকলেও তারা বিচারপতি পদে নিয়োগ পেতে আগ্রহী ছিলেন না। ফলে নিয়োগকৃত বিচারপতিদের সততা, ইন্টিগ্রিটি. দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে বড় রকম প্রশ্ন রয়েছে। পতিত আওয়ামীলীগ সরকার এসবের ধারও ধারেনি।
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের নির্দিষ্ট কোনো বিধান নেই। এমনকি বিচারকদের পারফর্মেন্স মূল্যায়নেরও নেই সুস্পষ্ট কোনো বিধি। দলীয় আনুগত্য, অতীতের রাজনৈতিক পারফর্মেন্স এবং ভারতীয় কোটায় নিয়োগ প্রদানকে পতিত সরকার এক প্রকার রেওয়াজে পরিণত করে।
আইনমন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ১৬ বছরে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ভারত কোটা, শেখ ফজলে নূর তাপসের কোটা যেন সংরক্ষিতই ছিলো। পরপরই ছিলো আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কোটা, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের কোটা। এসব কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া বিচারপতিগণ শুধু প্রটোকল, গাড়ি, বাসা এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়েই তুষ্ট ছিলেন না। অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার, তদবির, জমি দখল ও পুলিশী হয়রানি করার মতো নৈতিক স্খলনের এন্তার অভিযোগ। কিন্তু এসব অভিযোগের কারণে কোনো বিচারপতিকেই পদত্যাগ কিংবা অপসারণ করা হয়নি।
সূত্রমতে, ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করে। এ সময় ভারতের পছন্দে আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হন ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। আওয়ামীলীগের পরবর্তী চার মেয়াদে আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন বহুল বিতর্কিত ও দুর্নীতিবাজ অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। পুরো সময়ে অন্ততঃ ৭২ জন বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে ২০০৯ সালের ৩০ জুন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল থেকে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান নাঈমা হায়দার, বিচারপতি রেজাউল হাসান। ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল আওয়ামীলীগ সরকার নিয়োগ দেয় বিচারপতি আবদুর রব, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক, বিচারপতি একেএম জহিরুল হক, বিচারপতি শেখ মো: জাকির হোসেন, বিচারপতি হাবিবুল গনি, বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ এবং বিচারপতি জেবিএম হাসান। একই বছর ৪ নভেম্বর অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হন মো: রূহুল কুদ্দুস, বিচারপতি মো: খসরুজ্জামান, বিচারপতি ফরিদ আহমেদ এবং বিচারপতি মো: নজরুল ইসলাম তালুকদার। ২০১০ সালের ১২ ডিসেম্বর নিয়োগ পান বিচারপতি আকরাম হোসাইন চৌধুরী এবং বিচারপতি আশরাফুল কামাল। ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর নিযুক্ত হন বিচারপতি একেএম কামরুল কাদের, বিচারপতি মো: মজিবুর রহমান মিয়া, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম, বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহ, বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার, বিচারপতি সহিদুল করিম, বিচারপতি মো: জাহাঙ্গীর হোসেন এবং বিচারপতি আবু তাহের মো: সাইফুর রহমান। ২০১২ সালের ১৪ জুন নিয়োগ দেয়া হয় বিচারপতি আশিস রঞ্জন দাস, বিচারপতি মাহমুদুল হক, বিচারপতি মোহাম্মদ বদরুজ্জামান, বিচারপতি জাফর আহমেদ এবং বিচারপতি কাজী ইজারুল হক আকন্দ। ২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান খিজির আহমেদ চৌধুরী, রাজিক-আল-জলিল, ভীষ্মদেব চক্রবর্তী, মো: ইকবাল কবির, মো: সেলিম এবং মো: সোহরাওয়ার্দী। ২০১৮ সালের ৩১ মে নিয়োগ পান বিচারপতি এসএম আব্দুল মোবিন, বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমান, বিচারপতি ফাতিমা নজীব, বিচারপতি কামরুল হোসেন মোল্লা, বিচারপতি এসএম কুদ্দুস জামান, বিচারপতি মো: আতোয়ার রহমান, বিচারপতি খিজির হায়াৎ, বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকার, বিচারপতি মোহাম্মদ আলী, বিচারপতি মহিউদ্দীন শামীম, বিচারপতি মো: রিয়াজউদ্দিন খান, বিচারপতি এম. খায়রুল আলম, বিচারপতি এসএম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি আহমেদ সোহেল, বিচারপতি সরদার মোহাম্মদ রাশেদ জাহাঙ্গীর, বিচারপতি খন্দকার দিলীরুজ্জামান এবং বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলম। ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি মোহাম্মদ মাহবুব-উল ইসলাম, বিচারপতি শাহেদ নূরুদ্দীন, বিচারপতি জাকির হোসেন, বিচারপতি আখতারুজ্জামান, বিচারপতি মাহমুদ হাসান তালুকদার, বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেন, বিচারপতি কেএম জাহিদ সারওয়ার, বিচারপতি একেএম জহিরুল হক এবং বিচারপতি কাজী জীনাত হক।
২০২২ সালের ৩১ জুলাই বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান মো: শওকত আলী চৌধুরী, মো: আতাবুল্লাহ, বিশ্বজিৎ দেবনাথ, মো: আলী রেজা, মো. বজলুর রহমান, কেএম ইমরুল কায়েশ, ফাহমিদা কাদের এবং মো: বশিরউল্লাহ, একেএম রবিউল হাসান, মো: আমিনুল ইসলাম, এসএম মাসুদ হোসেন দোলন। তবে শেষোক্ত দু’জন এখনও অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে রাখা হয়েছে। নিয়োগের পর ২ বছর হলেও তাদের স্থায়ী করা হয়নি।
উল্লেখিত বিচারপতিগণের মধ্যে বিচারপতি খসরুজ্জামানের বিরুদ্ধে রয়েছে ২০০৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের দরজায় লাথি মারা এবং ভাঙচুরের অভিযোগ। বিচারপতি মো: রূহুল কুদ্দুস ছিলেন হত্যা মামলার আসামি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির নেতা হত্যা মামলা ছিলো তার বিরুদ্ধে। সেই মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাকে বিচারপতি হিসেবে শপথ দেয়া হয়। তিনি জাসদ (ইনু) ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিচারপতি হাবিবুল গনি বিএনপি’র আমলে বাদ পড়া ১০ বিচারপতিদের একজন। দীর্ঘ মামলা পরিচালনার মাধ্যমে তিনি আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এলে পুনরায় নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বিচারপতি ফাতিমা নজীব আওয়ামীলীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক নজিবুল্লাহ হিরুর স্ত্রী। জেলা জজ থেকে তাকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। জুডিশিয়াল সার্ভিস থেকে আসা বিচারপতি আখতারুজ্জামান বেগম খালেদা জিয়ার বিরদ্ধে রায় প্রদানের কারণে পুরস্কৃত হন। বিচারপতি মামুদ হাসান তালুকদার একজন মার্কিন নাগরিক। তিনি জামালপুর-৪ আসনের সাবেক এমপি ও আওয়ামীলীগ সরকারের বহুল সমালোচিত তথ্যপ্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান তালুকদারের সহোদর। গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর। ভারতীয় কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত এই বিচারপতির বিরুদ্ধে রয়েছে নিজ জেলা মাদারীপুরে সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর নিগ্রহ, মামলা দায়ের এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ। তার অপসারণ চেয়ে নিজ এলাকার সংখ্যালঘুরা মানব বন্ধন করেছেন।
শেখ হাসিনার সরকার আমলে বিচার বিভাগকে এতোটাই কলুষিত করা হয় যে, নৈতিক স্খলনের হাজারো প্রমাণ থাকলেও কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অপসারণের আইনসিদ্ধ পদ্ধতিকে (সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল) কৌশলে ‘বিলুপ্ত’ করে দলবাজ বিচারপতিদের যা ইচ্ছে তা-ই করার লাইসেন্স দিয়ে রাখা হয়।
সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবীরা আলাপচারিতায় জানান, শেখ হাসিনার সরকার আমলে নিয়োগ দেয়া বিচারপতিদের সপদে বহাল রেখে কখনোই দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাদের মতে, আপিল বিভাগের মতো হাইকোর্ট বিভাগেও চালাতে হবে শুদ্ধি অভিযান। একই সঙ্গে আওয়ামী দুঃশাসনে কোণঠাসা করে রাখা, সুপারসিটেড বিচারপতিদের আপিল বিভাগে উন্নীতকরণ এবং দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন তারা।
এদিকে সুপ্রিমকোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন দুর্নীতিবাজ, দলবাজ বিচারপতিদের অপসারণ দাবি করেছেন একাধিকবার। এ ছাড়া ইউনাইটেড ল’ইয়ার্স ফোরাম-্ইউএলএফ নেতা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুবও প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ ৫৭ বিচারপতির অপসারণ দাবি করেন। এসব দাবির মধ্যেই গত ১০ আগস্ট জুডিশিয়াল ক্যু করার চেষ্টা করেন ওবায়দুল হাসান। পরে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে সেটি ব্যর্থ হয়ে যায়। তাদের দাবির মুখে ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের ৬ বিচারপতি শনিবারই পদত্যাগ করেন। এর পরপরই হাইকোর্ট বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করেন প্রেসিডেন্ট। গতকাল রোববার শপথ গ্রহণের পরপরই তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে কার্যক্রম শুরু করেন।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ময়মনসিংহে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অস্ত্রসহ মাদক উদ্ধার
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও রাজনীতি নিয়ে জাতীয় সেমিনার
লোহাগড়ায় কাঠ বোঝাই নসিমন উল্টে হেলপার নিহত
বাসার আল-আসাদ ও আসমা’র ডিভোর্সের সংবাদ প্রত্যাখ্যান রাশিয়ার
রাজশাহীতে সড়ক দূর্ঘটনায় মহানগরী জামায়াতের আমিরসহ আহত ৩
ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিদুৎস্পর্শে শ্রমিকের মৃত্যু
রাজশাহীতে ছাত্রীনিবাসে নি¤œমানের খাবার, গভীর রাতে রাস্তায় নেমে ছাত্রীদের বিক্ষোভ
কুমিল্লায় মুক্তিযোদ্ধাকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত
টিকটক-এ ৭ কোটি বারের বেশি দেখা হয়েছে স্বল্পদৈর্ঘ্যের ওয়েব সিরিজ ‘প্রেমের বিকাশ’
'সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নগরীর যানজট নিরসন করা হবে' ---বিভাগীয় কমিশনার মোখতার আহমেদ
অস্তিত্ব সংকটে ট্রাম্প টাওয়ারসহ ৩৫ বিলাসবহুল ভবন
রাজশাহী সীমান্তে গভীর রাতে বিএসএফের দফায় দফায় গুলি বর্ষন
আজীবন সন্মাননা পাচ্ছেন আবদুল হাদি-খুরশিদ আলম
প্রকৌশলীর দুর্নীতির ৮ প্রকল্পের ৭৫ লাখ টাকা আত্মসাতের সত্যতা পেয়েছে দুদক
পদ্মা সেতু হয়ে বেনাপোল-ঢাকা রুটে আগামীকাল ২৪ ডিসেম্বর যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু: যাত্রীদের মাঝে ব্যপক সাড়া
বাংলাদেশের কাছে ২০০ কোটি রুপি পায় ত্রিপুরা, জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা
লক্ষ্মীপুরে দুই নারীকে পিটুনি, অভিযুক্ত যুবক গ্রেপ্তার
নওগাঁর রাণীনগরে জাতীয়তাবাদী প্রবাসী ঐক্য পরিষদের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত
বিনিয়োগ ‘ধ্বংসের’ অভিযোগে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি এস আলমের
বাতিল হলো মৌলভীবাজারের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক প্রকল্প