তরুণরা দেখিয়েছে সুপথ
১৩ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৩ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৪ এএম
রাজধানীর মতিঝিল সিটি সেন্টারের সামনে কিছু কিশোর-তরুণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ি থামাচ্ছেন, আবার হাতের ইশারায় গাড়ি ছাড়ছেন। মোটরসাইকেল আরোহীর হেলমেট না থাকলে অথবা ট্রাফিক আইন না মানলে জবাবদিহির মুখোমুখি করছেন। এই দৃশ্য শুধু মতিঝিল এলাকার নয়, এমনভাবে পুরো রাজধানীর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর কিছু জায়গায় ছাত্রদের সঙ্গে আনসার সদস্য, স্কাউট এবং গার্লস গাইডের সদস্যদেরও দেখা গেছে। তাছাড়া সড়ক পরিচ্ছন্নতার কাজও করেছেন ঢাকার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
হাতে ছাতা, মুখে বাঁশি, আবার হাতে লাঠি। তাদের এ লাঠির ইশারায় চলছে নগরীর সব যানবাহন। বাস, মাইক্রো, মোটরসাইকেল ও রিকশার জন্য লেন ভাগ করে দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে চলছে কাজ। আর তাতে সড়কে শৃঙ্খলা মানতে বাধ্য হচ্ছেন চলাচলকারীরা। যেখানে-সেখানে থামতে পারছে না গাড়ি। উল্টোপথে চলারও কোনো সুযোগ নেই। হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল চলা বন্ধ।
এদিকে গতকাল সোববার থেকে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দেখা গেছে পুলিশ ও ট্রাফিক সদস্যদের। প্রায় এক সপ্তাহ পর তারা রাজধানীর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে যোগ দিলেন। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও দায়িত্বপালন করছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান বলেছেন, আবার ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা কাজে যোগ দিয়েছেন। এ সপ্তাহের মধ্যে সকলেই যোগ দেবেন বলে আশা করা যায়। একটা আইস ব্রেকিং হলো। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা নেমেছেন। এর মধ্যে মিরপুরের ১৫টি স্থানে, গুলশানে ৯টি স্থানে, উত্তরায় ৫ স্থানে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। রাজধানীতে এ সপ্তাহের মধ্যেই ট্রাফিক পুলিশ পুরোপুরি কাজ শুরু করতে পারবে বলে আশা করেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের মধ্যে রাজধানীর প্রায় সব মোড় থেকে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা চলে যান। এক সপ্তাহ ধরে ঢাকার সড়কে ট্রাফিক পুলিশের দেখা নেই। এত দিন আন্দোলনের কারণে সড়কে যান চলাচল প্রায় বন্ধ ছিল। কিন্তু হাসিনার দেশত্যাগের পরদিন গত মঙ্গলবার থেকে সব অফিস খুলে দেওয়ায় সড়কে যান চলাচল বেড়েছে। সড়কে নেমেছে গণপরিবহনও। এরই মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে কর্মবিরতি পালন শুরু করেছেন পুলিশ সদস্যরা। এতে সড়কে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা দায়িত্ব নেওয়ায় সড়কে শৃঙ্খলা ফিরেছে। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সুন্দরভাবে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করছেন তারা।
রাজধানীতে গতকাল যান চলাচল বাড়তে থাকে। মহাসড়কেও শুরু হয়েছে যানবাহন চলাচল। এতে করে কোথাও কোথাও যানজট তৈরি হয়। পুরান ঢাকা, গুলিস্তান, পল্টন, ধানমন্ডি, কলাবাগান, মিরপুর রোড, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বনানী, মগবাজার, উত্তরা এলাকাসহ পুরো রাজধানীতে শিক্ষার্থীরা ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় কাউকে উল্টোপথে গাড়ি চালাতে দেখা যায়নি। এমনকি সিগন্যাল ছাড়ার আগে কেউ হুট করে পার হওয়ারও চেষ্টা করেননি। এর মধ্যে কেউ যদি শৃঙ্খলা না মানেন, তাদের ১৫ থেকে ২০ মিনিট দাঁড় করিয়ে রাখেন শিক্ষার্থীরা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, একটি দুর্যোগময় সময়ে শিক্ষার্থীরা সড়কে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, রাস্তাঘাট পরিষ্কার ও দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকছে। তারা দেশের জন্য ভূমিকা রাখছে। মাঠে কাজের জন্য তাদের মূল্যায়ন করা হবে, উৎসাহব্যঞ্জক সনদ দেওয়া হবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমি পুলিশের মহাপরিদর্শককে অনুরোধ করবো, যে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় ট্রাফিকের কাজ করছে, রাস্তাঘাট ও অলিগলি পরিষ্কার করে দেয়ালগুলোতে গ্রাফিতি আঁকছে, তাদের তালিকা করে পুলিশের পক্ষ থেকে সনদ দেওয়া হোক। চাকরির ক্ষেত্রে এই সনদের যেন মূল্যায়ন হয়। শিক্ষার্থীরা নিজের টাকায় সড়কে কাজ করছে, সড়ক পরিষ্কার করছে, রঙ কিনে দেয়াল সুন্দর করছে। এটা যদি সরকারি প্রজেক্ট হতো, হাজার কোটি টাকা লাগতো। একটা দেশে এর চেয়ে ভালো উদাহরণ হতে পারে না।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীরা রাস্তায় আমার গাড়িও ধরেছে। তারা আমার গাড়ি থামিয়ে বলেছে, পতাকাওয়ালা গাড়ি। তারপর তারা বলছে, পতাকা থাক আর যাই থাক, গাড়ি চেক করবো। এরপর আমাকে দেখে বললো, না স্যার আপনি চলে যান। যেটা পুলিশ করতে পারতো না; সেটা তারা করছে। তারা কোনও চাঁদা নেয় না। কোনও দোকানে গিয়ে বলে না খাবার দাও। এই শিক্ষার্থীরা আমাদের ভবিষ্যৎ। তারা ইতিহাসের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
মতিঝিল সিটি সেন্টারের সামনে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলেন, দেশ নতুন করে স্বাধীনতা লাভ করেছে। এ সময় সবাইকে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। দেশের জন্য একটা কিছু করতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। এই দেশ আমাদের। সংগ্রাম করে স্বৈরাচার বিদায় করেছি। এখন শৃঙ্খলা ফেরানোর সংগ্রাম করতে হবে। ব্যাচমেটসহ তারা ১৫ জন শিক্ষার্থী সকাল থেকে দায়িত্ব পালন করছেন।
যাত্রাবাড়ী মোড়ে এক মাদরাসাশিক্ষার্থী বলেন, দেশকে নতুন করে সাজাতে হবে। শিক্ষার্থীরা খুব সুন্দর ট্রাফিক পরিচালনা করছেন। মানুষও তাদের সহযোগিতা করছেন। কেউ আইন অমান্য করছেন না। যে যার লাইনে আছেন। আমরা যাত্রাবাড়ী এলাকার বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষার্থীরা দায়িত্ব পালন করছি। এক এক টিম তিন থেকে চার ঘণ্টা করে থাকছি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, শিক্ষার্থীরা শৃঙ্খলা ফেরাতে চাইছেন, এ নিয়ে তাদের দরদ আছে। ট্রাফিক পুলিশ শৃঙ্খলা চায়নি, তাদের অবৈধ ইনকামের ধান্দা ছিল। যে কারণে তারা বিশৃঙ্খলা লাগিয়ে রাখে। কারণ শৃঙ্খলা থাকলে অবৈধ ইনকাম হয় না। শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয়বারের মতো পথ দেখিয়ে দিলেন। সততা ও সদিচ্ছা থাকলে সবই সম্ভব। এ থেকে পুলিশকে শিক্ষা নিতে হবে। তারাও যদি শিক্ষার্থীদের মতো একাগ্রচিত্তে চায়, তবে সড়কে শৃঙ্খলা থাকবে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজ্জাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো লোভ নেই। তারা সত্যিকার অর্থেই শৃঙ্খলা ফেরাতে নেমেছেন। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এই কাজটা ট্রাফিক পুলিশ পারছে না। পুলিশ যদি অনিয়ম বন্ধ করে দেয়, সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় আপদকালীন সময়ে শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসছেন, এটাকে সাধুবাদ জানাতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে যারা ট্রাফিকের দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের শৃঙ্খলায় ফেরাতে যে কোনো একটি মন্ত্রণালয় বা সংস্থাপনকে এগিয়ে আসতে হবে। আধুনিক শহরের মতোই বাস স্টপেজে যাত্রী ওঠা-নামার নিয়ম মানতে বাসচালক ও যাত্রীদের সচেতন করেছন শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে গণপরিবহন থেকে চাঁদা তোলা বন্ধ আছে। এর আগে গণপরিবহনের কাছ থেকে একটি চক্র চাঁদা তুলেছে, সেই চাঁদার ভাগ ট্রাফিক পুলিশও পেয়েছে। চাঁদাবাজদের চক্র ভেঙে দিলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি
যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭
মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি
৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল
মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি
উত্তর প্রদেশে নিহত ৩ খলিস্তানি নেতা
ভারতে বাল্যবিবাহবিরোধী অভিযানে আটক ৫০০০
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
গ্রেফতার ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু
পানামা খাল দখলের হুমকিকে ভর্ৎসনা পানামা প্রেসিডেন্টের
স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা