বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে র্যাবকে ব্যবহার করতেন জিয়াউল আহসান
১৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৪ এএম
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর গুমের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান। ইলিয়াস আলী যে ফ্লাইটে সিলেট থেকে ঢাকা এসেছিলেন, সেই ফ্লাইটেরই যাত্রী হয়ে তাকে অনুসরণ করছিলেন জিয়াউল আহসান। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের শত শত নেতাকর্মী গুম-খুনের শিকার হন। বিচারবর্হিভূত এসব হত্যাকাণ্ডের মিশন বাস্তবায়ন করতে সারাদেশের র্যাবের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত কতিপয় কর্মকর্তাদের ব্যবহার করতেন জিয়াউল আহসান। আয়নাঘরের ‘জনক’, গুম-খুনের ‘মাস্টারমাইন্ড’, ফোনকলে আড়িপাতা, মানুষের ব্যক্তিগত আলাপ রেকর্ড অভিযোগের শেষ নেই সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। গত শুক্রবার গ্রেফতারের পর ৮ দিনের রিমান্ডে ডিবির হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানকে। শুক্রবার রাতে ও শনিবার দু’দফা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন তিনি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আরো জানিয়েছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে অবহিত না করে কোন কাজ তিনি করেননি।
অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, টুকু ও পলককেও জিজ্ঞাসাবাদ করছেন ডিবির কর্মকর্তারা। তাদের বিরুদ্ধে আরো অনেক মামলা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এগুলোর মধ্যে আছে শেয়ার কেলেঙ্কারী, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলামের নেতা-কর্মীদের ওপর আক্রমণ-নিধন, আড়িপাতার যন্ত্র পেপাসাস সফটওয়্যার ক্রয়, আয়না ঘর কনসেপ্ট এবং অসংখ্য গুম-খুনসহ নানা আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতি রয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করে জানায়, রিমান্ডে থাকা আসামি সালমান এফ রহমান এবং আনিসুল হকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ীই গ্রেফতার করা হয়েছে জিয়াউল আহসানকে। তারা তিনজনই এখন নিউমার্কেট থানার একটি হত্যা মামলায় ডিবির হেফাজতে রিমান্ডে আছেন।
সূত্র জানায়, সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক এবং জিয়াউল আহসানকে দুইটি টিমের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। একটি টিমে আছেন নিউমার্কেট থানার ওসি নেতৃত্বে মামলার তদন্তকর্মকর্তাসহ জুনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা। তারা মূলত থানা পুলিশের সদস্য। অপর একটি টিমের আছেন ডিএমপি সদর দফতর এবং ডিবির কর্মকর্তারা। এই টিমটি করা হয়েছে মূলত: উচ্চ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে। জুনিয়র টিম কেবল মামলার রহস্য উদ্ঘাটনের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। তারা মামলার এজাহারে বর্ণিত অভিযোগের বাইরে কোনো বিষয় জিজ্ঞাসাবাদ করছেন না। আর সিনিয়র টিমটি জিজ্ঞাসাবাদরে ক্ষেত্রে কেবল মামলার বিষয় বস্তুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছেন না। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।
জিজ্ঞাসাবাদের সময় আসামিরা কী ধরনের অভিভ্যক্তি প্রকাশ করছেন- জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, আনিসুল হক বেশিরভাগ সময় হাসছেন। বলছেন, প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) আমাদের যে গাইডলাইন দিতেন আমি সেই গাইডলাইন ফলো করেছি মাত্র। হত্যা মামলায় কেন আমাকে রিমান্ডে এনেছেন? যারা সরাসরি কিলিংয়ে অংশ নিয়েছিল তাদের ধরেন। জিয়াউল হক বলেছেন, আমি তো কোনো ইউনিটের ইনচার্জ ছিলাম না। আমি সরকারে টপ অর্ডারের নিদের্শে কাজ করেছি। তার কাছে তদন্তসংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন ছিল, আপনি তো এনটিএমসি (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার)-এর মহাপরিচালক ছিলেন। আড়ি পেতে মানুষের প্রাইভেসি নষ্ট করেছেন। আপনার নির্দেশেই বিরোধী মতের অনেকেকে আয়না ঘরে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়েছে। গুম-খুনের শিকার হয়েছেন অনেকে। তখন বলেন, আমি তো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করেছি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি। যে আয়না ঘরের কথা বলা হচ্ছে সেখানে আমাকেও আটদিন রাখা হয়েছে। এরপর আমাকে গ্রেফতার দেখানো হয়।
জানতে চাইলে নিউমার্কেট থানার ওসি আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা কেবল মামলার অভিযোগের বিষয়েই আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মামলা বাদী যে সংশোধনী এজাহার থানায় জমা দিয়েছে তা ইতোমধ্যে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, ছাত্র আন্দোলনের সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কয়েকজন মন্ত্রীর ফোনালাপ রেকর্ডের সারাংশ গণভবন থেকে উদ্ধার হয়। তাতে আন্দোলন দমনে ইন্টারনেট বন্ধসহ নানা কৌশলের তথ্য উঠে আসে। এনটিএমসিতে কর্মরত ছিলেন, এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, জিয়াউল আহসান অনেকের ব্যক্তিগত ফোনালাপ রেকর্ড করতেন। বিশেষ করে বিএনপির নেতাদের কল রেকর্ড করে সেগুলো শুনতেন। কোটা সংস্কারের দাবি বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের ব্যানারে আন্দোলন চলাকালে গত ১৭ জুলাই থেকে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ১৮ জুলাই থেকে ব্রডব্র্যান্ড ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ করা হয়। পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু করা হয়। তৎকালীন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক ও মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান ডাটা সেন্টারগুলো বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। কয়েকটি ডাটা সেন্টারে হুমকি দিয়ে বন্ধ করেন জিয়াউল আহসান।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, জিয়াউল আহসান কর্মজীবনের বিগত এক দশকের বেশি সময় গুম, খুন ও ব্যক্তিগত ফোনকল আড়িপাতাসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগে তিনি সমালোচিত হয়েছে। তবে তৎকালীন সরকারের আস্থাভাজন হওয়ায় ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি পেয়ে মেজর থেকে মেজর জেনারেল হয়েছেন। কথিত গোপন বন্দিশালা আয়নাঘর তৈরি করে সেখানে বিরোধী মতাবলম্বীদের তুলে নিয়ে বছরের পর বছর গুম করে রাখার অভিযোগ রয়েছে জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে। পুলিশও দাবি করেছে, কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান আয়নাঘর এবং ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের ওপর আক্রমণ ও হত্যার সঙ্গে থাকার কথা স্বীকার করেছেন।
জিয়াউল আহসানের কিলিং মিশনের বিষয়ে র্যাবের তৎকালীন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইনকিলাবকে বলেন, অনেক নেতাদেরকে র্যাবের কালো গাড়িতে করে ধরে আনা হতো। এনে র্যাব ওয়ানের গোপন আস্তানায় আটক রাখা হতো। এরপর তাদের সময়মতো অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হত্যা করা হতো। অজ্ঞাত স্থানেই তাদের লাশ ডুবিয়ে দেয়া হতো, নয়তো তাদের দাফন করা হতো, না হয় এসিডের মাধ্যমে গলিয়ে দেওয়া হতো।
হত্যার সিদ্ধান্ত জিয়াউল আহসান দিতেন জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদকে যখন অ্যারেস্ট করে আনা হলো। তাকে অ্যরেস্ট করে আনার সময় ধস্তাধস্তিতে মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন। তাকে র্যাবের গোপন কক্ষে আটক করে রাখা হয়েছিল দীর্ঘ দিন। এরপর তাকে একসময় ভারতে পাচার করে দিয়ে আসা হয়। তাকে অজ্ঞাত কারণে হত্যা করা হয়নি।
সূত্রগুলো বলছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে যে কয়টি গুম খুনের ঘটনা ঘটেছে তার প্রত্যেকটির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জিয়াউল আহসানের সম্পৃক্ততা রয়েছে। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী থেকে শুরু করে চৌধুরী আলম, সাজেদুল ইসলাম সুমন, আদনান চৌধুরী, কাওসার আহমেদ, ইফতেখার আহমেদ দিনার, জুনায়েদসহ আরও অসংখ্য বিএনপিপন্থি ও সরকারবিরোধী আলোচনা-সমালোচনার সঙ্গে যুক্তদের গুম হতে হয়েছে। তাদের হদিস এখনো পাওয়া যায়নি। তবে বছরের পর বছর ধরে এত অভিযোগের পরও বহাল তবিয়তে ছিলেন জিয়াউল আহসান। আওয়ামী লীগ সরকারের আশির্বাদপুষ্ট হওয়াতে তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পেতেন না। আওয়ামী লীগ সরকার যেমন তার কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছে ঠিক তেমনি তিনিও দাপটের সঙ্গে চাকরি করছিলেন। তিনি এতটাই সরকারের আস্থাভাজন ছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় তার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে সরকারের পোস্ট দিয়েছেন। তিনি তার পোস্টে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন রেখে ঘরে ফেরার কথাও বলছিলেন। এরকম অনেক পোস্ট তিনি দিয়েছিলেন। যদিও সরকার পতনের পর সেগুলো তিনি ডিলিট করে দেন।
মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম বলেন, দেশে ২০০৯ সাল থেকে বিভিন্ন সময় গুম হওয়াদের সন্ধান ও জড়িতদের শাস্তির দাবিতে আমরা তাকে (জিয়াউল আহসান) গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছিলাম। গত রাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে শুধু গ্রেপ্তার করলেই হবে না, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতসহ প্রত্যেকটা গুম-খুনের গ্রহণযোগ্য তদন্ত করতে হবে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন
গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত
মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ
কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের
৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী
৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান
তুষারপাতে অচল হিমাচল দুই শতাধিক রাস্তা বন্ধ
ক্রিপ্টো রিজার্ভ গড়বেন ট্রাম্প?
মোজাম্বিকে কারাদাঙ্গায় নিহত ৩৩, পলাতক ১৫০০ কয়েদি
গাজায় যুদ্ধবিরতি বিলম্বে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ হামাস-ইসরাইলের
পাকিস্তানে সড়ক অবরোধে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি
আফগানিস্তানে ৭১ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে পাকিস্তান
শুধু নারীদের জন্য
নিথর দেহ
আত্মহননে
জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী
মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু
গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়
শুধু নামেই জিমনেসিয়াম
মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে কী পরিবর্তন আসছে?