এত সংস্কারের কথা হচ্ছে, কিন্তু গরিব মানুষের কথা ভাবছি না
২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০২ এএম
এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সকলেই সংস্কার নিয়ে কথা বলছি; আমরা উপরিকাঠামো নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু গরিব মানুষের কথা ভাবছি না বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ভূমিহীন কৃষকের কী হবে, গার্মেন্টস কর্মীদের স্যালারি কতো হবে এসব নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। গতকাল সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) কর্তৃক বিআইআইএসএস-এ আয়োজিত ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ; অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রসঙ্গ’ শীর্ষক সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন। অন্যান্য বক্তারা বলেন, রাষ্ট্র ও রাজনীতির পরিপূরক হচ্ছে অর্থনীতি। দেশ গঠনে রাষ্ট্র ও রাজনীতির সংস্কার করতে চাইলে সবার আগে অর্থনীতি সংস্কার প্রয়োজন। অর্থনীতির সংস্কার ছাড়া সামনের দিকে আগানো সম্ভব নয়। এ বাস্তবতা বুঝতে হবে। তারা আরো বলেন, হাসিনা রেজিমের পরিসংখ্যানের ভিত্তি হচ্ছে মিথ্যা। সেখান থেকে সরে আসতে হবে। পরিসংখ্যানকে ঠিক করতে হবে। অর্থনৈতিক কাঠামোকে অটোমেশনের আওতায় আনতে হবে। রফতানি পণ্যের বহুমুখিতা বাড়াতে হবে। আয়কর আদায়ের আওতা বাড়াতে হবে। রাজনৈতিক ঐক্যমত ছাড়া এগুলো সম্ভব না। যদি রাজনৈতিক ঐক্যমত সৃষ্টি করতে পারি তাহলে মূল্যস্ফীতিসহ অন্যান্য সমস্যাগুলোর সমাধানও করতে পারবো। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এটা স্বাভাবিক কোনো সরকার নয়। মাত্র তিন মাস আগে এই সরকার এসেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের একটা ছেদ হয়েছে। যার কারণে নতুন করে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। আলোচনা হওয়া নীতিগুলোইতো দেড় দশক ধরে আলোচনা করে আসছি। সেগুলো দেড় দশকে কেন বাস্তবায়ন হলো না? তাদের কাছে প্রশ্ন, কেন আপনারা বাস্তবায়ন করতে পারলেন না? রাজনীতিবিদরা এখন ব্যবসায়ী আর আমলারা এখন রাজনীতিবিদ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, বিগত বছরে জাতীয় আয়, মূল্যস্ফীতি, খানা জরিপ, রপ্তানি আয়ের ভুল তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। বিচারবিভাগকে প্রভাবিত করেছে স্বার্থগোষ্ঠীর মাধ্যমে। চুরির ঘটনাও নেয়া যেত না এলাকার নেতার পারমিশন ছাড়া। ডিএনএ টেস্ট ছাড়া ট্রেড লাইসেন্স পেত না। উন্নয়নের কথা বলে টাকা ছাপিয়ে দিল। এ রকম একটা ব্যবস্থার পর নতুন একটা সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। রাতারাতি পরিবর্তন তো আসবে না। ওনার (সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) কোনো নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল না, জবাবদিহিতা ছিল না।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সভাপতি আরো বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। সরকার বেশকিছু উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিয়েছে। এখনো সুফল না এলেও হয়ত সামনে আসবে।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) চেয়ার মুনিরা খান বলেন, দেশ থেকে কিভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেল, এখানে আমাদের সংস্কার আনতেই হবে। এখনো পাচার চলছে। মিডিয়া এবং ব্যাংক যখন বলে ১০টা ব্যাংক দুর্বল তখন সে ব্যাংকগুলোর লোকেরা তো টাকা উঠিয়ে নিবেই। টাকা তুলে সে হয় বাড়িতে লুকিয়ে রাখবে আর না হয় দেশের বাহিরে পাচারের ব্যবস্থা করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন হচ্ছে না। আমাদের মূল কর্মসংস্থান হচ্ছে ইনফরমাল খাতে। ফরমাল খাতে আমাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে না। আমরা অধ্যাপক ইউনূসের ইমেজকে দেখিয়ে তো সেখানে কোনো কাজ করছি না।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, আমাদের দুটি বিষয় একদম শেষ করে দিচ্ছে- এক ব্যাংকিং সুশাসন, আরেকটি এনার্জি সেক্টর। আমাদের পলিসিগুলোতে সংশ্লিষ্ট যারা আছে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। আমরা এমন পলিসি করি যেখানে সম্পৃক্তদের কোনো সম্পর্ক থাকে না। ফলে সে পলিসিও বাস্তবসম্মত হয় না। বাস্তবায়নও হয় না।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) প্রেসিডেন্ট আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, বর্তমানে আমরা কেউ স্বস্তিতে নাই। আমরা যেখানে আছি সেখান থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। ইন্ডাস্ট্রিগুলো গ্যাস পাচ্ছে না। ইন্ডাস্ট্রিগুলোর সুরক্ষা নেই।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট সবুর খান বলেন, উন্নয়নের ক্ষেত্রে মূল হচ্ছে পরিসংখ্যান। দেশের সব পরিসংখ্যান সঠিক চাই। আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে পরিসংখ্যান। আমরা ব্যাংক থেকে ঋণ দিয়ে দিচ্ছি কিন্তু যাকে ঋণ দিচ্ছি তার ট্যাক্স ফাইলে সে সম্পদ আছে নাকি সেটা দেখি না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম আবু ইউসুফ বলেন, আমাদের জিডিপি ও জনসংখ্যার যে তথ্য সে তথ্য নিয়ে কিন্তু অনেক বড় প্রশ্ন আছে। আগে আমাদের তথ্য ঠিক করতে হবে। তাহলে আমরা পরিমাপ করতে পারবো যে খাদ্যের পরিমাণ কতো লাগবে। সেজন্য আমাদের তথ্যের জায়গাটা ঠিক করতে হবে।
সিজিএস’র নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, আস্থার সংকট বিগত সরকারের সময় ছিলো, এখনো আছে। আস্থার সংকট কাটাতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ যেটা এই আলোচনার মধ্যে আসছে। সেটা নিশ্চিত না করা গেলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না। আবার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসলে রাজনৈতিক সংকট যাবে না।
সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা না আসলে মূল্যস্ফীতিসহ সার্বিক পণ্যমূল্যে প্রভাব পড়ে। আমরা দেখি রাজনীতিবিদরা হয়ে গেছেন আমলাতান্ত্রিক আর আমলারা রাজনীতিবিদ হয়ে গেছেন। সেখান থেকে আমাদের বের হতে হবে। আমাদের এখানে ট্যারিফ কমিশন আছে কিন্তু তারা কোনো কিছুর দাম নির্ধারণ করে না, সেখানেও সংস্কার আনতে হবে।
বারভিডার প্রেসিডেন্ট আব্দুল হক বলেন, বাজার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কো-অপারেটিভ সোসাইটি করতে পারি কি না সেদিকে আমাদের চিন্তা করতে হবে। জাপানের মতো শিল্পোন্নত দেশে এখনো কোণ্ডঅপারেটিভ চালু আছে। ডলারে ঘুষ নেয়া হয়েছে। সেটা নিয়ে ব্যাংকের ভোল্টে রাখা হয়েছে। অনেকের বাড়িতেও কোটি কোটি টাকা আছে, সেগুলো কিভাবে ব্যাংকে আনা যায় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. সায়েমা হক বিদিশা বলেন, ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সরকারি সহায়তার মাধ্যমে সুরক্ষার আওতায় আনতে হবে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অল্প শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত তরুণদের নিয়ে নির্দিষ্ট কোন রোডম্যাপ এখনো আমাদের নেই। উচ্চশিক্ষিত বেকারদের সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রিজের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আবার দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমরা ইকোনমিক জোন তৈরি করে তাদের কর্মসংস্থানে সহায়তা করতে পারি।
ইউএনডিপি বাংলাদেশের সাবেক আবাসিক প্রতিনিধি প্রসেনজিৎ চাকমা বলেন, উপজাতিদের ক্ষেত্রে শুধু বৈষম্যহীন হলেই হবে না, তাদের ক্ষেত্রে পজিটিভ বৈষম্য করতে হবে। তাদের সেফটিনেটের আওতায় আনতে হবে। তাদের মধ্যে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইন্সুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম জাহিদ বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে যারা ডিফল্টার তাদের সবাইকে আমরা চিনি, আমরা তাদের আগেও গোপন রাখার চেষ্টা করেছি, এখনো হয়তো করে যাচ্ছি। এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাংক পুনরুজ্জীবিত করতে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। সেজন্য আমরা যাদের ঋণ দিয়েছি তাদের ঋণগুলো নিয়মিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী সুপ্রভা সুভা জামান বলেন, ক্রনি ক্যাপিটালিজমকে আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার যতোই সংস্কার করুক, সংস্কার ইউনিভার্সাল প্রসেসে না গেলে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক কুক্ষিগত করে নিবে।
আলোচনায় আরো বক্তৃতা করেন অর্থনীতিবিদ প্রফেসর আবু আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহিদুল ইসলাম জাহিদ, এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু, মীর নাসির হোসেন অর্থনীতিবিদ ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ, এফবিসিসিআই-এর স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম আবু ইউসুফ প্রমুখ।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি
যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭
মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি
৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল
মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি
উত্তর প্রদেশে নিহত ৩ খলিস্তানি নেতা
ভারতে বাল্যবিবাহবিরোধী অভিযানে আটক ৫০০০
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
গ্রেফতার ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু
পানামা খাল দখলের হুমকিকে ভর্ৎসনা পানামা প্রেসিডেন্টের
স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা