শিক্ষা বোর্ডগুলো থেকে বছরে শত শত কোটি টাকা লুট
২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম | আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
শিক্ষার্থীদের টাকায় পরিচালিত দেশের সাতটি শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খাতা সরবরাহের নামে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের মদদপুষ্ট মাত্র ৮টি প্রতিষ্ঠান হরিলুটের রাজত্ব কায়েম করেছে। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা ও শিক্ষা বোর্ড কর্মকর্তাদের যোগসাজসে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়ে ২০১৭ সাল থেকে এই ৮টি প্রতিষ্ঠানকে খাতা সরবরাহের এককছত্র ক্ষমতা প্রদান করে। যার বদৌলতে প্রতিষ্ঠান ৮টি দেশের ৭টি শিক্ষা বোর্ড ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পরীক্ষার খাতা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির মাধ্যমে গলাকাটা দর দিয়ে সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ২০১৭ সালের আগে কাগজ, ওএমআর সিট আলাদাভাবে ক্রয় করে টেন্ডারের মাধ্যমে সহজ শর্তে মুদ্রন ও তৈরি’র করে আসছিল। এর ফলে কোটি কোটি টাকা কমে খাতা তৈরি করে আসছিল বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। জুলাই-আগষ্ট বিল্পবের পর ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরেরা আবারও আসন্ন এসএসসি ও এইএসসি পরীক্ষার খাতা সরবরাহের জন্য আগের নিয়মেই টেন্ডার (ইজিপি) করানোর মাধ্যমে ভাগাভাগির পাঁয়তারা শুরু করেছে। উল্লেখ্য, শিক্ষা বোর্ডগুলো সরকারি বরাদ্দ ছাড়াই পরীক্ষার ফরম পূরণসহ বিভিন্ন খাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া টাকায় পরিচালিত হয়ে থাকে।
দেশের বিভিন্ন বোর্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, শিক্ষা বোর্ড-এর হর্তাকর্তা হলেন চেয়ারম্যান ও সচিব। শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজের প্রফেসর ও প্রভাষকদের পেষনে শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যান সচিবসহ অন্তত ৭টি পদে পদায়ন করে থাকে। পদায়নের ক্ষেত্রে লাখ লাখ টাকার ঘুস বাণিজ্যের অভিযোগ একপ্রকার রীতিতে পরিণত হয়েছে। পেষণে আসার পর বছরের পর বছর এক জায়গায় থেকে অধিকাংশ কর্মকর্তা শিক্ষকতাই ভুলে যান। হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা।
বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে থেকে জানা গেছে, মূলত ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাবলিক পরীক্ষার খাতা তৈরিতে টেন্ডারের মাধ্যমে পৃথকভাবে কাগজ ও ওএমআর শিট ক্রয় করা হতো। পরবর্তীতে খাতার কভার মুদ্রণসহ তৈরির জন্য টেন্ডার আহবান করা হতো। মুদ্রণ ও খাতা তৈরির জন্য সাধারণত মুদ্রণালয় ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অংশ নিত। ফলে প্রতিযোগিতামূলক দর পড়তো। পাবলিক পরীক্ষা যেহেতু এই স্পর্শকাতর বিষয় তাই অনেক শিক্ষা বোর্ড নিজস্ব অর্থায়নে মুদ্রণযন্ত্র বোর্ড চত্বরে বসিয়ে মুদ্রণ কাজ করে সেখানেই ওএমআর (বোর্ডের সরবরাহ করা) দিয়ে খাতা তৈরি করে দিত। ঢাকা বোর্ডসহ কয়েকটি বোর্ড তাদের নিজস্ব ভবনেই টেন্ডার প্রাপ্তদের মুদ্রণযন্ত্র বসিয়ে খাতা তৈরির কাজটি সম্পন্ন করতো। ২০১৭ সাল পর্যন্ত একটি মূল খাতা তৈরিতে খরচ হতো সর্বোচ্চ ১১ টাকা। অতিরিক্ত ও ব্যবহারিক খাতা তৈরিতে খরচ পড়তো দুই ও দেড় টাকা।
২০১৭ সালে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের মদদপুষ্ট ৫টি প্রতিষ্ঠান মোটা অংকের অর্থ দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি প্রজ্ঞাপন জারীর মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলকভাবে খাতা তৈরির পথ রুদ্ধ করে দেয়। ওএমআর মুদ্রণ মেশিন থাকা আবশ্যকীয় করে জামানতের অংক বাড়িয়ে ২০১৭ সাল পর্যন্ত খাতা সরবরাহের কাজ করে আসা অপেক্ষাকৃত ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেন্ডারে অংশগ্রহণের সুযোগ কেড়ে নেয়।
রাজত্ব কায়েম হয় আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের মদদপুষ্ট মাস্টার সিমেক্স, মনস্পুল, ইস্ট ওয়েজ ও এলিট ও এশিয়া প্রিন্টার্স, ইউনিসন পেপার প্রোডাক্ট, এস বি এস কর্পোরেশন, প্রিন্ট মাস্টার প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং নামে ৮টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে এশিয়া প্রিন্টার্স আইনি লড়াই করে এক থেকে দুটি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহের কাজ পায়। এরপরও বাকি ৬টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বেঁধে দেয়া গলাকাটা দর দিতে বাধ্য হয়। যদিও এশিয়া প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার উল্লেখিত ৬টি প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেটের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নাই বলে জানান। তবে তিনি এও বলেন, পত্রিকায় রিপোর্ট করে কী হবে? এর আগে দুদকে অভিযোগ করেও কোনো ফল হয়নি।
বোর্ডগুলো থেকে প্রাপ্ত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে সিন্ডিকেট সৃষ্টির পর থেকে একটু রয়ে সয়ে দর বৃদ্ধি বা লুটপাট শুরু করা হয়। ছাত্র জনতার বিল্পবে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের আগে ২০২৩ সাথে ডাকাতির মতো একেকটি খাতার দর প্রায় দ্বিগুণ করে দর দেয়া হয় এবং সরবরাহ করে বিলও উত্তোলন করা হয়। সূত্রটির মতে, ২০২১ সালে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে একটি অতিরিক্ত ও ব্যবহারিক উত্তরপত্র এক দশমিক ৪৪৯ পয়সা, ২০২২ সালে একটি মূল উত্তরপত্র ১৪ দশমিক ৭৯১ পয়সায় সরবরাহ করে সিন্ডিকেটধারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ২০২৩ সালে এ উত্তরপত্র সরবরাহ করা হয় ২২ দশমিক ৯৭১ পয়সা। কুমিল্লা বোর্ডে প্রতিটি ২৩ টাকা এবং ঢাকাসহ অন্যান্য বোর্ডেও ২২ টাকার বেশি দরে সরবরাহ করা হয়। সর্বকনিষ্ট শিক্ষা বোর্ড হিসাবে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে গত বছর (২০২৩) মূল উত্তরপত্র তৈরি করা হয় ৫০ লাখটি। অন্যান্য বোর্ডে এর পরিমাণ আরো বেশি। দেশের ৭টি বোর্ড ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে কম করে হলেও ৮ থেকে ১০ কোটি মূল উত্তরপত্র তৈরি করা হয়। প্রতিটি উত্তরপত্রে ১০ টাকা করে বেশি দর দেয়ায় কত কোটি টাকা লুট করা হয়েছে তা দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষেই হিসাব করে বের করা সম্ভব। যদি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন মনোযোগী হয়। একইভাবে ২০২১ সালে অতিরিক্ত উত্তরপত্র তৈরি করা হয় মাত্র এক দশমিক ৪৪৯ পয়সা অর্থাৎ দেড় টাকারও কম। এ উত্তরপত্র ২০২৩ সালে শিক্ষা বোর্ডগুলো গ্রহণ করেছে ৮ দশমিক ৪৯১ পয়সা অর্থাৎ সাড়ে আট টাকার সামান্ন কম। অর্থাৎ প্রতিটি খাতায় বেশি দর দেয়া হয়েছে ৮ টাকারও বেশি। যদিও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড আলাদাভাবে কাগজ ও ওএমআর শিট ক্রয় করে নিজেদের মুদ্রণ যন্ত্রে কভার মুদ্রণ করে বহিরাগত বাইন্ডারদের দিয়ে একেকটি উত্তরপত্র মাত্র ১১ টাকায় তৈরি করে নজির স্থাপন করেছেন।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ও দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড এর সদস্য সচিবের সাথে। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড সচিব জানান, টেন্ডার প্রক্রিয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক আর ঢাকা বোর্ড সচিব এ ব্যাপারে কথা বলতেই অপারগতা প্রকাশ করেন।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার বিল্পবের মুখে লুটপাটের রাজত্ব কায়েমকারী আওয়ামী সরকারের বিদায়ঘণ্টা বাজলেও ছাত্র-ছাত্রীদের টাকায় পরিচালিত বোর্ড এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দোসরদের অধিকাংশই এখন বহাল তবিয়তে রয়েছে। শুধু তাই, আসন্ন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র (খাতা) তৈরির মাধ্যমে লুটের রাজত্ব অব্যাহত রাখার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। লুটপাট বন্ধ করা হলে শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ফরম পূরণ ফিসহ অন্যান্য খরচ অনেক কমে আসবে। উপকৃত হবে দেশের কোটি কোটি অভিভাবক।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ শ্রমিকদের
মির্জা ফখরুলের সঙ্গে দেখা করলেন ভুটান রাষ্ট্রদূত
ইয়েমেন টনক নাড়িয়ে দিয়েছে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের
মহাখালীতে রিকশা চালকদের অবরোধ : ট্রেন চলাচল বন্ধ
মহাখালীতে রেললাইনে ব্যাটারিচালিত রিকশা রেখে চালকদের অবরোধ, শহরজুড়ে তীব্র যানজট
ভারতে সাজাভোগ শেষে দেশে ফিরলেন পাচার হওয়া ২৪ নারী-পুরুষ
ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল নিয়ে যা বলছে নেটিজেনরা
উ.কোরিয়ার চিড়িয়াখানায় সিংহ ও বাদামী ভাল্লুক উপহার দিলেন পুতিন
"আমি 'স্টারবাকস বর্জন করি আপনাদেরও করা উচিত"
যানজটে স্থবির ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ভোগান্তি চরমে
বিসিএস কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন আর পূরণ হলো না জাবির শিক্ষার্থী রাচির
লাওসে বিষাক্ত মদের বিষক্রিয়ায় পর্যটকের মৃত্যু
বিদায় বেলা ঢাকায় আসছেন বাইডেনের বিশেষ প্রতিনিধি
ইউক্রেন যুদ্ধ,রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রতিযোগিতা!
রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক আটকে বিক্ষোভে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা : চরম ভোগান্তি
সেন্ট মার্টিন যাওয়ার ট্রাভেল পাস যেভাবে পাবেন
রাসিকের মাষ্টাররোলে নিয়োজিত ১৬১ কর্মীকে অব্যাহতি, ৩৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শোকজ
সিরিয়ার পালমিরা শহরে ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলায় নিহত ৩৬, আহত ৫০
অস্ট্রেলিয়ায় প্রস্তাবিত শিশুদের সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ কার্যকর হবে কি?
ক্ষেপণাস্ত্রের পর এবার ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্থলমাইন ব্যবহারের অনুমতি দিলেন বাইডেন