ফ্যাসিবাদের দোসর বিচারপতি মো. শওকত হোসেন

স্বেচ্ছাচারিতার ছড়ি ঘোরাচ্ছেন প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে

Daily Inqilab বিশেষ সংবাদদাতা

২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম

হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে অবসর নিয়েছেন ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি। বিচারিক জীবনের পারফরম্যান্সে তুষ্ট হয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা তাকে চুক্তিতে বসান প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে। স্বকার্যে দারুণ রকম স্বেচ্ছাচারী ও প্রবল আওয়ামীমনা বিচারপতি শওকত হোসেন এখন পুরোদস্তুর ‘হাসিনাবিরোধী’।
বাহ্যত ‘হাসিনাবিরোধী’ হলেও ভেতরে প্রবল আওয়ামীপনায় হাসিনার হয়ে এখনো ছড়ি ঘোরাচ্ছেন স্বেচ্ছাচারিতার।

ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, গত বছর ১৫ আগস্ট তিনি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে জাতীয় শোক দিবসের আয়োজন করেন। চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের আগে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান শেখ মুজিবের কবরে। মাথার ওপর টাঙিয়ে রাখেন মুজিব-হাসিনার ছবি। তবে এবার ১৫ আগস্ট তিনি প্রচণ্ড মুজিববিরোধী। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এমন ভোল পাল্টানো আওয়ামী লীগার বিচার বিভাগে মেলা দুষ্কর। বিচার বিভাগে যারা ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ ছিলেন, তারা স্বপরিচয়েই পদ থেকে বিদায় নিয়েছেন। অন্তত ভোল পাল্টাননি। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকও হাসিনার গণহত্যাকে যথার্থ বলেছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন বিচারের মুখোমুখি। ভোল পাল্টাননি তিনিও। কিন্তু আওয়ামী লীগের করুণাপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. শওকত হোসেন এখন অবধি আওয়ামী উপঢৌকন ভোগ করছেন। অথচ ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হাসিনা রেজিমে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত সব নিয়োগ বাতিল করে। কিন্তু চামে-চিকনে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ‘প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল’-এ রয়ে গেছেন দুই বছরের চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া বিচারপতি শওকত হোসেন। এ পদ আঁকড়ে থাকার জন্য তিনি এখন প্রচণ্ড আওয়ামী লীগবিরোধী সেজেছেন। কথা বলছেন ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের পক্ষেও।

জানা গেছে, ২০০৯ সালে কথিত বিডিআর বিদ্রোহে হত্যা করা হয় দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ৫৭ চৌকস সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে। যার নেপথ্যে ছিল ভারতের মাস্টারপ্ল্যান। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে ভারত দ্রুতই বাস্তবায়ন করে সেই প্ল্যান। এ ঘটনায় দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ফেরাতে বলির পাঁঠা বানানো হয় কিছু বেসামরিক ব্যক্তিকে। এদের একজন ছিলেন ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলী। বিডিআরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে তোরাব আলীর কাছে পরিকল্পিত সেনা হত্যার বিষয়ে আগাম তথ্য ছিল এবং সেই তথ্য তিনি আগাম সরকারকে জানাননিÑ মর্মে বিচারিক আদালতের রায়ে বলা হয়। এ অভিযোগে নিম্ন আদালত সেনা হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করার অভিযোগে ৩০২ ধারায় তোরাব আলীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন তোরাব আলী। শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর বিচারপতি মো. শওকত হোসেন নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বিভাগের বৃহত্তর বেঞ্চ তোরাব আলীকে বেকসুর খালাস দেন। পরের বছর ৫ জানুয়ারি অবশ্য তোরাব আলী মৃত্যুবরণ করেন কিংবা তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। কারণ এখন নতুন করে বিডিআর পিলখানায় সেনা হত্যার পুনঃতদন্ত এবং পুনঃবিচারে তোরাব আলী হতে পারতেন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। সেটি যাতে না করা যায় এ কারণেই তাকে পরিকল্পিত হত্যা করা হয়েছেÑ মর্মে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

আপিল শুনানি শেষে এ হেন তোরাব আলীকে বেকসুর খালাস দেন বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ। তোরাব আলীকে খালাস দেয়ায় বিচারপতি মো. শওকত হোসেনকে পুরস্কৃত করেন শেখ হাসিনা। ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি হাইকোর্ট বিভাগ থেকে অবসরে যান। ওই বছরই ২৭ মার্চ হাসিনার আইন মন্ত্রণালয় বিচারপতি মো. শওকত হোসেনকে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পদে বসিয়ে তার ‘ঋণ শোধ’ করেন। আইন অনুযায়ী প্রশাসনিক পদে নিয়োগের বিধান চুক্তিভিত্তিক। দুই বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। দায়িত্ব গ্রহণের আগে ২০২০ সালের ২৮ নভেম্বর মুজিবভক্ত শওকত হোসেন শেখ মুজিবের কবের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
কার্যক্রমে স্বেচ্ছাচারিতা : বিচারপতি শওকত হোসেনকেও নিয়োগ দেয়া হয় দুই বছরের জন্য। কিন্তু সেই ‘দুই বছর’ যেন পাঁচ বছরেও শেষ হচ্ছে না। পরপর তিনবার চুক্তি বাড়িয়ে তাকে ছয় বছরে জন্য বসিয়ে যান হাসিনা। সর্বশেষ হাসিনা উৎখাতের মাস দুই আগে তাকে তৃতীয়বারের মতো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা উৎখাত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু প্রভুভক্ত শওকত ঘাপটি মেরে রয়ে গেছেন প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগোচরে তিনি রয়ে গেছেন স্বৈরাচারের চিহ্ন হিসেবে। তবে স্বৈরাচারের দোসর বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের এখনো সপদে বহাল থাকা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের আইনজীবীরা।

তারা জানান, হাইকোর্ট বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণের পর ফ্যাসিস্ট হাসিনার নিশেষ স্নেহধন্য হওয়ায় বিচারপতি শওকত রাজনৈতিক বিবেচনায় পরপর তিন দফা প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যান পদ করায়ত্ব রেখেছেন। তার বয়স ৭২-৭৫ বছর হলেও পরিবর্তন করার নাম নেই। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল এখন তার স্বেচ্ছাচারিতার শিকার। রায় দিচ্ছেন ইচ্ছেমতো। যেমনÑ সম্প্রতি তিনি নিজের ঘোষিত নিয়ম ভঙ্গ করে ৪৩৮/২৩ নম্বর মামলার রায় ঘোষণা করেন। ১১৬/২০২৪ নম্বর আপিল মামলাটি চলতি বছরের হলেও বাদিরা বিচারিক ট্রাইব্যুনালে উপযুক্ত কারণে হেরে যাওয়ার পরও তিনি এ আপিল মামলায় স্বেচ্ছাচারী ও অনুরাগের বশবর্তী হয়ে পদোন্নতিতে পদ সংরক্ষণের আদেশ দেন। মামলটিকে ‘অতীব গুরুত্বপূর্ণ’ বিবেচনায় চার মাসের মধ্যেই নিষ্পত্তি করেন। শুনানিকালে তিনি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের অ্যাডভোকেট স্বপন কুমার আইচ, আব্দুর রহিম (কাজল) ও শফিকুল ইসলাম তথা আপিলকারীদের কোনো আবেদন ছাড়াই বিচারিক ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা আর্জির মৌলিক অংশ সংশোধনের পরামর্শ দেন।

উল্লেখ্য, ১০৭/২৪ আপিল মামলাটিও অসৎ উদ্দেশ্যে চরম স্বেচ্ছাচারী ও অনুরাগের বশবর্তী হয়ে ব্যক্তি বিশেষকে অবৈধ সুবিধা দিতে চলতি বছরই নিষ্পত্তির চেষ্টা চালান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আইনজীবী জানান, বিচারিক ট্রাইব্যুনাল থেকে কনটেম্পট মামলা ফাইল অগ্রায়ণ করা হলে ফ্যাসিস্ট সরকারকে সুরক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে বিচারপতি শওকত হোসেন নানা অজুহাতে কনটেম্পট পিটিশনটি নিষ্পত্তি করেননি। এমন অনেক স্বেচ্ছাচারিতার জ্বলন্ত প্রমাণ রয়েছে আইনজীবীদের হাতে। তাই আইনের শাসনে বিশ্বাসী ট্রাইব্যুনালের আইনজীবীদের দাবি, অবিলম্বে স্বৈরাচারের দোসর ও উচ্ছিষ্টভোগী বিচারপতি মো. শওকত হোসেনকে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনাল পদ থেকে অপসারণ করা হোক।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

যে সন্মান অর্জন করেছেন তা এইভাবে নষ্ট কইরেন না

যে সন্মান অর্জন করেছেন তা এইভাবে নষ্ট কইরেন না

নতুন ভূগর্ভস্থ নৌ ঘাঁটি উন্মোচন ইরানের

নতুন ভূগর্ভস্থ নৌ ঘাঁটি উন্মোচন ইরানের

সম্পর্ককে বাণিজ্য সহযোগিতায় রূপান্তরের জন্য আর্জেন্টিনার প্রতি প্রধান উপদেষ্টার আহ্বান

সম্পর্ককে বাণিজ্য সহযোগিতায় রূপান্তরের জন্য আর্জেন্টিনার প্রতি প্রধান উপদেষ্টার আহ্বান

গ্রেফতারকৃত এসকে সুরের বাসায় দুদকের অভিযান, ১৭ লাখ টাকা উদ্ধার

গ্রেফতারকৃত এসকে সুরের বাসায় দুদকের অভিযান, ১৭ লাখ টাকা উদ্ধার

চাল আমদানির সময় বাড়ল ২৭ দিন: দুইমাসে ৯,৬৬২ টন চাল আমদানি হলেও প্রভাব নেই বাজারে

চাল আমদানির সময় বাড়ল ২৭ দিন: দুইমাসে ৯,৬৬২ টন চাল আমদানি হলেও প্রভাব নেই বাজারে

সিরিয়ার আসাদ সরকারের মাদক বাণিজ্যের ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ

সিরিয়ার আসাদ সরকারের মাদক বাণিজ্যের ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ

হাইকোর্টে চিন্ময়ের জামিন আবেদন, শুনানি সোমবার

হাইকোর্টে চিন্ময়ের জামিন আবেদন, শুনানি সোমবার

পুলিশ লাইন্সে ফ্যানের সঙ্গে নারী কনস্টেবলের লাশ ঝুলছিল

পুলিশ লাইন্সে ফ্যানের সঙ্গে নারী কনস্টেবলের লাশ ঝুলছিল

দাউদকান্দির গৌরীপুর চররায়পুর আসমানিয়া সড়কে বড় বড় গর্ত, জনদুর্ভোগ চরমে

দাউদকান্দির গৌরীপুর চররায়পুর আসমানিয়া সড়কে বড় বড় গর্ত, জনদুর্ভোগ চরমে

লৌহজংয়ে যানবাহন চলাচলে জন্য বালিগাঁও সেতু উন্মুক্ত করা হয়েছে

লৌহজংয়ে যানবাহন চলাচলে জন্য বালিগাঁও সেতু উন্মুক্ত করা হয়েছে

নারায়ণগঞ্জে পাওয়ার প্ল্যান্টের ৩৬০ মেট্রিকটন তেল ডাকাতি, ৮ ডাকাত গ্রেপ্তার

নারায়ণগঞ্জে পাওয়ার প্ল্যান্টের ৩৬০ মেট্রিকটন তেল ডাকাতি, ৮ ডাকাত গ্রেপ্তার

ভারতের  প্রথম মহিলা  নৃবিজ্ঞানী ইরাবতী কারভে, সাহসী গবেষক ও সংস্কারক

ভারতের প্রথম মহিলা নৃবিজ্ঞানী ইরাবতী কারভে, সাহসী গবেষক ও সংস্কারক

মুজিবনগরে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৮৯ তম জন্মবার্ষিকী পালন

মুজিবনগরে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৮৯ তম জন্মবার্ষিকী পালন

ভয়ঙ্কর প্রেমের ফাঁদ!

ভয়ঙ্কর প্রেমের ফাঁদ!

মিডিয়া থেকে ইসলামফোবিয়া কবে যাবে? সারজিস আলম

মিডিয়া থেকে ইসলামফোবিয়া কবে যাবে? সারজিস আলম

যুদ্ধবিরতি স্থগিত করে গাজায় হামলা অব্যাহত রাখল ইসরাইল

যুদ্ধবিরতি স্থগিত করে গাজায় হামলা অব্যাহত রাখল ইসরাইল

দাউদকান্দিতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী পালিত

দাউদকান্দিতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী পালিত

টেকনাফমুখী ৪টি পণ্যবাহী জাহাজ এখনো ছাড়েনি আরাকান আর্মি

টেকনাফমুখী ৪টি পণ্যবাহী জাহাজ এখনো ছাড়েনি আরাকান আর্মি

বাঁওড়ের ইজারা বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

বাঁওড়ের ইজারা বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

মার্কিন মুলুকে নিষিদ্ধ টিকটক, আমেরিকা প্লাটফর্মটি প্রত্যাশা করেঃ মি.বিষ্ট

মার্কিন মুলুকে নিষিদ্ধ টিকটক, আমেরিকা প্লাটফর্মটি প্রত্যাশা করেঃ মি.বিষ্ট