কেবিন ক্রু’দের স্বপ্ন ককপিটে বন্দি
০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম | আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
আকাশে উড়ার স্বপ্নে বিভোর মনোভাব নিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটা নেন তরুন-তরনীরা। উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের হাতছানি যেন তাদের ডাকে। হাজারো স্বপ্ন থাকে তাদের মনে। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পরিশ্রম ও শিক্ষাকে মিলন ঘটিয়ে বিমানের কেবিন ক্রু নামক চাকরিতে ক্যারিয়ার গড়েন। ইচ্ছে থাকে আকাশে উড়ার। দুচোখ মেলে নতুন কিছু দেখার। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকার। সুখে-দুঃখে, হাসি-কান্নায় পাশে থেকে সেবা করার। পরিবারের সদস্যদের সেবার পাশাপাশি মানুষের সেবার ব্রত নিয়ে যুক্ত হন কেবিন ক্রু নামক চাকরিতে। নিজের মনের মধ্যে হাজারো কষ্ট জমা থাকলেও উড়োজাহাজের কোনো যাত্রীকেই বুঝতে দেন না তার মনের ব্যাথার কথা। একজন প্রফেশনাল কেবিন ক্রুকে অনেকটা সময়ই বাইরে থাকতে হয়। পরিবার, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে তাকে দেশে-বিদেশে কাটাতে হয়। তাদের এই চাকরি জীবনে আসে নানা হয়রানী ও দুঃখ দুর্দশা। বিশেষ করে নারী কেবিন ক্রুদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট সহ্য করতে হয়। নারী কেবিন ক্রু’রা যেন একবারেই অসহায়। নারী কেবিন ক্রু’রা সবচেয়ে বেশি হেনস্তার শিকার হন তাদের সাথে কাজ করা পাইলট বা ক্যাপ্টেন কর্তৃক। তাদের সরলতা ও অসহায়েত্বের সুযোগ নিয়ে ক্যাপ্টেন বা পাইলটরা তাদের সাথে যৌন হয়রানীর মতো ঘটনা ঘটান। অনেক নারী কেবিন ক্রু তাদের সাথে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানী ও শ্লীলতাহানীর ঘটনা কারো সাথে বলেন না। অনেক সময় চাকরি হারানোর ভয়ে থাকে। নিরবেই সয়ে যান সবকিছু। সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু ঘটনায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
অভিযোগ উঠেছে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে কর্মরত কিছু কর্মী তাদের নারী সহকর্মীদের যৌন হয়রানি করে থাকে। এর আগেও বিমানের ফ্লাইটে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় অনেক নারী কর্মী আতঙ্কিত বলে ভুক্তভোগীরা জানান। তবে ভুক্তভোগী অনেকেই ঘটনা প্রকাশ করেন না। আবার সাহস করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেও বিচার পান না। ফলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ভুক্তভোগী নারীরা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কেবিন ক্রু বলেন, আমরা যেখানে কাজ করি সেখানে অনেকটাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। উড়োজাহাজ চলাচলের সময় ককপিটে দুইজন পাইলট থাকেন। কোনো কারণে একজন ওয়াশরুমে বা সিট থেকে উঠে আসলে আরেকজন পাইলট একাই থাকেন। সাধারণত পাইলটরা একা থাকার সময় কেবিন ক্রু’দের ককপিটের কাছে থাকতে হয়। ককপিটের স্থানে কোনো ধরনের সিসি ক্যামেরা বা শব্দ ধারণের সুযোগ নেই। এই সময়টার মধ্যেই কেবিন ক্রু’দের একা পেয়ে পাইলটরা শ্লীলতাহানীর ঘটনা ঘটায়। এ বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে চাকরি হারানোর হুমকি আসে। অথবা মৌখিকভাবে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হয়। এছাড়াও কেবিন ক্রু’দের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্প্রতি কেবিন ক্রু’দের সাথে কয়েকজন ক্যাপ্টেনের বেশকিছু শ্লীলতাহানীর ঘটনা ঘটে। এমন ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে বলেও জানা যায়। এমন কয়েকটি ঘটনায় ইতোমধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও বরাবর অভিযোগ দেয়া হয়েছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে কর্মরত কেবিন ক্রু’রা অভিযোগে তাদের সাথে যেসব আচরণ করা হয়েছে তার বর্ণনা করেছেন। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন তাদের নিদারুন কষ্টের কথা।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ক্যাপ্টেন আবেদ (পি-৩৭২২১) এর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানিমূলক এবং অপেশাদারমূলক আচরণের অভিযোগ করেছেন একজন কেবিন ক্রু। তার অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন গত ১০ নভেম্বর বিজি-১৩৫ নম্বর ফ্লাইট (ঢাকা-চট্টগ্রাম-জেদ্দা) অপারেট করেন। ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন মুনতাসীর এবং ক্যাপ্টেন আবেদ অপারেটিং পাইলট ছিলেন। ফ্লাইটের মাঝামাঝি সময় তারা ভুক্তভোগী কেবিন ক্রু’কে ককপিটে ডাকেন। কুশল বিনিময়ের একপর্যায়ে ক্যাপ্টেন আবেদ তার সাথে অপেশাদার মূলক (ব্যক্তিগত) কথাবার্তা বলেন। পরবর্তীতে ককপিট দরজার সামনে তাকে একা পেয়ে সে জোরপূর্বক হ্যান্ডসেক করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন যেটি তার কাছে অপেশাদার কুশলাদি/আচরণ বলে মনে হয়েছে। তিনি ঘটনাটি ফ্লাইট পার্সার ম্যাডামকে অবগত করেন। ফিরতি ফ্লাইটে (বিজি-২৩৬ জেদ্দা-সিলেট-ঢাকা) তার ওয়ার্কিং পজিশন ছিল সামনের দিকে। কাজের জন্য তাকে বেশ কয়েকবার ককপিটে যেতে হয়েছে। তখন ক্যাপ্টেন আবেদ কৌতুক শোনানোর ছলে কারক, সমাস, লিঙ্গ পরিবর্তন নিয়ে কথা বলেন। এক পর্যায়ে তিনি নানা রকম কুরুচিপূর্ণ এবং অশ্লীল মন্তব্য করেন। এছাড়াও তিনি কুৎসিত, জঘন্য এবং যৌন হয়রানিমূলক কথা বলেন। নোংরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করেন। পরবর্তীতে ভুক্তভোগী সেই মহিলা কেবিন ক্রু লিখিত ভাবে বিমানের এমডি বরাবর ক্যাপ্টেন আবেদ এর বিরুদ্ধে যৌনহয়রানির অভিযোগ করেন। অন্যদিকে অভিযোগের ব্যাপারে সহোযোগিতা করতে গেলে বাংলাদেশ বিমান কেবিন ক্রু ইউনিয়নের একজন এক্সেকিউটিভকে বিমান ম্যানেজমেন্ট নিয়ম বহির্ভূতভাবে ফ্লাইট থেকে গ্রাউন্ডেড করে রেখেছে। ক্যাপ্টেন আবেদের কো-পাইলট ক্যাপ্টেন মুন্তাসির এর ভিত্তিহীন অভিযোগের প্রেক্ষিতে সেই ইউনিয়ন এক্সেকিউটিভকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে ক্যাপ্টেন আবেদ এর ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্যই ভুক্তভোগীকে সহযোগিতাকারী সেই ইউনিয়ন এক্সেকিউটিভকে ক্যাপ্টেন মুন্তাসির হয়রানি করার চেষ্টা করছেন। কর্মক্ষেত্রে এ ধরনের অপেশাদার, যৌন হয়রানিমূলক আচরণ এবং এ ঘটনায় তিনিসহ সকল নারী কেবিনক্রু সহকর্মীরা চরমভাবে চিন্তিত ও অনিরাপদ বোধ করছেন বলে জানিয়েছেন।
এছাড়াও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে আরেক ক্যাপ্টেনের বিরুদ্ধে চলন্ত উড়োজাহাজে নারী কেবিনক্রুকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি ঢাকা থেকে মাসকাটগামী বিমানের ফ্লাইটে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী কেবিন ক্রু।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, গত ৩ নভেম্বর ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া বিজি ৭২১ নম্বর ফ্লাইটে ইউসুফ মাহমুদ নামের এক ক্যাপ্টেন ককপিটের এক নারী কেবিন ক্রুকে যৌন হয়রানি করেন।
এ ঘটনায় গত ৭ নভেম্বর বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী ক্রু। লিখিত অভিযোগ সূত্র জানা গেছে, ক্যাপ্টেন ইউসুফ ওই নারী কর্মীকে ককপিটে ডেকে নিয়ে তার শরীর স্পর্শ করেন এবং জোর করে কমলা খাইয়ে দেন। এ ঘটনায় বিমান কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে বিমানের মহাব্যবস্থাপক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা বোসরা ইসলামকে।
এর আগে ২০১৯ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১০ জন পাইলটের বিরুদ্ধে ককপিটে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছেন একাধিক কেবিন ক্রু। বিমানের সিনিয়র পাইলট ক্যাপ্টেন ইশরাত আহমেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। ওই কেবিন ক্রু তার কথা না শোনায় তাকে পেছনের কেবিনে পাঠিয়ে দেন। অপর কেবিন ক্রু অভিযোগ করেন, ক্যাপ্টেন তাকে ককপিটে ডেকে নিয়ে তার সঙ্গে নানা অশ্লীল কথাবার্তা বলেন। তাকে কুপ্রস্তাব দিয়েছেন। সেসময় একাধিক কেবিন ক্রু ১০ জন পাইলটের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক (কাস্টমার সার্ভিস) হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন ইনকিলাবকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি তেমন কিছু বলতে পারবো না। বিষয়টি জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বোসরা ইসলাম দেখছেন।
জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ বিভাগ) বোসরা ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তের কাজ চলাকালীন সময়ে ব্যাপারটি নিয়ে বিমানের কেউ কিছু বলবে না।#
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
৯ দফা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ কতদূর?
মর্গের দুই লাশের দাবিদার দুই পরিবার,
আইনজীবীকে হত্যার হত্যাচেষ্টা: শেখ হাসিনা-জয়সহ ৯৩ জনের মামলা এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ
তথ্য থাকলেও সন্দেহজনক লেনদেনে দেরিতে ব্যবস্থা নিচ্ছে বিএফআইইউ!
সাবেক এমপি হেনরীর ৫৬ কোটি টাকার সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ,
গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগে উৎকণ্ঠায় নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীরা
দেশে এইচএমপি ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত
শাহজালাল বিমানবন্দরে বিমান বাহিনীর সদস্যদের অপসারণে আইনি নোটিশ
চকরিয়ায় পুলিশ-সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি: বসতবাতিতে আগুন, ওয়ার্ড মেম্বারসহ আহত ২
স্বাধীন সামরিক বাহিনী সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব
শেখ হাসিনার চোখ ছিল শুধু ঢাকা থেকে টুঙ্গীপাড়া পর্যন্ত : সারজিস
শেখ হাসিনা ভারতের সাথে বৈষম্যমৃলক চূক্তি করেছিলেন-মৌলভীবাজারে সারজিস আলম
ব্র্যাক ব্যাংকের টপ টেন রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড জয় ২০২৪ সালে ১.৬ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স সংগ্রহ
ওসি মুহিবুল্লাহকে বাঁচাতে স্বজনদের মানববন্ধন
পাটগ্রাম সীমান্তে বাংলাদেশিকে লক্ষ্য করে বিএসএফের গুলি, আহত ১
ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৬ হাজার প্রতিষ্ঠান: বিপিজিএমইএ
চলমান সংস্কার গতিশীল করতে হবে, যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে : মান্না
ফরিদপুরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় তিন দিনে মোট ১১ জন নিহত, আহত ৩৫
বিধ্বংসী শতকে লিটনের জবাব, ঝড়ো সেঞ্চুরি তানজিদেরও, বিপিএলে রেকর্ড
ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোন ষড়যন্ত্রকারী বিএনপির ক্ষতি করতে পারবে না : আমিনুল হক