আস্থা ফিরছে গ্রাহকদের মধ্যে
০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম
হাসিনা সরকার গত সাড়ে ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে। এ খাতে লুটপাট হয়েছে দুই লাখ কোটি টাকার বেশি। রাষ্ট্রীয় মদদে ব্যাংক খাতে বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারি, প্রতারণা, ভুয়া ঋণ ও ঋণের অপব্যবহারের মাধ্যমে এ অর্থ লুট করা হয়েছে, যার বড় অংশই পাচার হয়েছে। আর যে কারণে প্রায় ১ ডজন ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। চরম অর্থ সংকটে ছিল এ সব ‘দুর্বল’ ব্যাংকগুলো। চরম নগদ অর্থের সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে পারছিল না। নতুন করে আমানতও পাচ্ছিল না। এ অবস্থায় দুর্বল এসব ব্যাংকের নাজুক তারল্য পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে ছয়টি দুর্বল ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে। যে সব ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো- ন্যাশনাল, এক্সিম, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন।
এসব ব্যাংকের আমানতকারীরা যেন তাদের টাকা ফেরত পান, সেই চিন্তা থেকেই টাকা না ছাপানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই সহায়তা দিচ্ছে, বলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। একই সঙ্গে বর্তমান সঙ্কট কাটাতে এটাই যথেষ্ট হবে। প্রয়োজনে আরও দেয়া যাবে, কোনো অসুবিধা নাই। গভর্নর বলেন, গ্রাহকদের বলবো আপনাদের টাকা নিরাপদ জায়গায় আছে, নিশ্চিন্তে থাকুন, এটা নিয়ে মাথাব্যথা আমাদের। আমরাই সমাধান করব।
এদিকে গতকাল দুর্বল ব্যাংকগুলো ও গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিছুটা হলেও স্বাভাবিক ধারায় ফিরেছে ব্যাংকগুলোর লেনদেন। ব্যাংকাররা বলছেন, পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। তবে গ্রাহকরা অনেকটা আস্থা রাখছেন ব্যাংকগুলোকে। অনেকে ডিপোজিটও করছেন। অপরদিকে গ্রাহকরা জানান, এখনো চাহিদা মাফিক টাকা না পেলেও প্রয়োজনীয় টাকা মিলছে। বড় অঙ্কের টাকার ক্ষেত্রে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে শিগগিরই সমাধানের। মোটকথা কিছুটা স্বাভাবিক ধারায় হচ্ছে ব্যাংক লেনদেন। দু’একদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে আসবে ব্যাংকের নগদ অর্থ সঙ্কটের পরিস্থিতি।
ডজন খানেক ব্যাংকে নগদ অর্থ সঙ্কট তৈরি হওয়ায় ব্যাংকখাতে আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছিল। ব্যাংকিংখাতে বর্তমান সঙ্কট দূরীকরণ এবং আস্থা বাড়াতে টাকা ছাপিয়ে সহায়তাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, হাসিনা সরকার ব্যাংক থেকে অর্থ লুটপাট এবং পাচার করে ব্যাংকগুলোকে খাদের কিনারে পৌঁছে দিয়েছে। তাই বর্তমান সঙ্কট নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের পাশে দাঁড়িয়ে যথার্থ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ‘আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষাকেই’ টাকা ছাপানোর প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন। তার মতে, দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকের গ্রাহকদের চাহিদা যদি আংশিকভাবেও পূরণ করা না যায় তাহলে “আতঙ্ক তৈরির শঙ্কা আছে, যা পুরো ব্যাংকিং খাতকে আক্রান্ত করতে পারে”।
সূত্র মতে, দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট বহুদিনের। গণঅভ্যুত্থানের পর আস্থার সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো আরও বেশি বিপাকে পড়েছে। এসব ব্যাংক থেকে আমানতের অর্থ তুলতে পারছিলেন না গ্রাহক। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টিতে ভালো ব্যাংক থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু এতেও চাপ সামাল দেওয়া যায়নি। এজন্য এবার গ্যারান্টির বাইরে তারল্য সহায়তা দেওয়ার চিন্তা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এজন্য ব্যাংকগুলোকে দিতে হবে ব্যবসা পরিকল্পনা। অর্থাৎ কোনো ব্যাংক এসব অর্থ ফেরত দেওয়ার বিষয়ে ভালো ব্যবসা পরিকল্পনা দিতে পারলেই সহায়তা পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মোট ৬ হাজার ৮৫০ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এসব অর্থ দেওয়া হয়েছে ভালো ব্যাংকগুলো থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টিতে। তবে এতে দুর্বল ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনায় কোনো উন্নতি হয়নি। এখনো ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। যে কারণে আমানতকারীরা অর্থ তুলতে না পারায় ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। এজন্য আমানতকারীদের আস্থা ফেরাতে টাকা ছাপিয়ে অর্থ সহায়তার ব্যবস্থা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর আগে আন্তঃব্যাংক সহায়তার মাধ্যমে এই পদক্ষেপেও ‘হয়তো পর্যাপ্ত সাড়া পায়নি’ বলেই টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। আর তার কারণ হিসেবে ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিনের আস্থার সংকটকেও দেখছেন কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ।
যেমন, কোনো দুর্বল ব্যাংক যদি ঋণ নেয়ার পর তা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকেও সেই অর্থ উদ্ধার করতে সবল ব্যাংকে বেশ অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। সবমিলিয়ে যে অঙ্কের অর্থ সবল ব্যাংকগুলো দিয়েছে সেটা তাদের দুর্বল ব্যাংকের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে আমানতকারীদের মধ্যে তৈরি হওয়া আতঙ্ক ঠেকাতেই বাংলাদেশ ব্যাংককে টাকাটা দিতে হয়েছে বলে মনে করেন ড. জাহিদ হোসেন।
এদিকে সাধারণত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক অন্য ব্যাংকগুলোতে ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রি করে। এই বিল ও বন্ড হচ্ছে এক রকমের জামানত। এগুলোর বিপরীতে ব্যাংকগুলো টাকা নিয়ে থাকে। ব্যাংকগুলোতে যখন তারল্য সংকট তৈরি হয় তখন বিল-বন্ডের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা ধার নেয়। কোনো ধরনের জামানত ছাড়া টাকা ধার নেওয়া যায় না। তবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ইসলামী ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকে বিশেষ অনুমোদনে সিকিউরিটি ছাড়াই টাকা ধার দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকার পতনের পর আরও কয়েকটি ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা দিতে না পারার কাতারে যুক্ত হয়। দুর্বল এসব ব্যাংকেরও জামানত বা সিকিউরিটি রাখার মত অবস্থা নেই। অর্থাৎ ট্রেজারি বিল-বন্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিয়ে টাকা ধার নেবে সেই অবস্থাও নেই। ট্রেজারি বিল ও বন্ড থেকে টাকা ধার দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানত পেলে সেখান থেকে ন্যূনতম ১৩ শতাংশ এসএলআর (স্ট্যাচুটরি লিকুইডিটি রেশিও) হিসাবে সংরক্ষণ করতে হয়। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এ হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। মূলত এসএলআর থেকেই ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করে। নানা অনিয়মে খেলাপি ঋণে জর্জরিত হওয়া এসব ব্যাংক গত আড়াই বছর ধরে এসএলআর সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, আন্তঃব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তা দেওয়া পর্যাপ্ত নয়। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিভিন্ন বৈঠকে বিকল্প পন্থায় এসব দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টাকা ছাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পাগলা মসজিদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা বরখাস্ত
একযোগে ৭ শিক্ষা বোর্ড সচিব পদে রদবদল
ইসরায়েলি বর্বর হামলায় গাজায় নিহত আরও ২৮ ফিলিস্তিনি
হাঁটতে পারছেন খালেদা জিয়া, দোয়া চাইলেন দেশবাসীর কাছে
মধ্যরাতে অনশনে যোগ দিলেন জবির অর্ধশতাধিক ছাত্রী
রিয়ালকে গোলবন্যায় ভাসিয়ে চ্যাম্পিয়ন বার্সা
গোলরক্ষক বীরত্বে ১০ জনের ইউনাইটেড হারাল আর্সেনালকে
৯ দফা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ কতদূর?
মর্গের দুই লাশের দাবিদার দুই পরিবার,
আইনজীবীকে হত্যার হত্যাচেষ্টা: শেখ হাসিনা-জয়সহ ৯৩ জনের মামলা এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ
তথ্য থাকলেও সন্দেহজনক লেনদেনে দেরিতে ব্যবস্থা নিচ্ছে বিএফআইইউ!
সাবেক এমপি হেনরীর ৫৬ কোটি টাকার সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ,
গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগে উৎকণ্ঠায় নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীরা
দেশে এইচএমপি ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত
শাহজালাল বিমানবন্দরে বিমান বাহিনীর সদস্যদের অপসারণে আইনি নোটিশ
চকরিয়ায় পুলিশ-সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি: বসতবাতিতে আগুন, ওয়ার্ড মেম্বারসহ আহত ২
স্বাধীন সামরিক বাহিনী সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব
শেখ হাসিনার চোখ ছিল শুধু ঢাকা থেকে টুঙ্গীপাড়া পর্যন্ত : সারজিস
শেখ হাসিনা ভারতের সাথে বৈষম্যমৃলক চূক্তি করেছিলেন-মৌলভীবাজারে সারজিস আলম
ব্র্যাক ব্যাংকের টপ টেন রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড জয় ২০২৪ সালে ১.৬ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স সংগ্রহ