দুদক পুনর্গঠন কবে?
০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম
এক মাসেরও বেশি সময় ধরে অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র সংস্থা ‘দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক’। পুনর্গঠনের নাম নেই। এই মওকায় দুর্নীতিবাজরা বিক্রি করে দিচ্ছেন দুর্নীতিলব্ধ অর্থে কেনা স্থাবর-অবস্থাবর সম্পদ। কেউ বা হেবা দলিল কিংবা পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে স্বজনদের নামে হস্তান্তর করছেন। স্ট্যাম্পে চুক্তিপত্রের মাধ্যমেও অনেকে গোপনে বিক্রি করে দিচ্ছে দুর্নীতিলব্ধ অর্থে গড়ে নামে-বেনামে গড়ে তোলা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি কিংবা কোম্পানির শেয়ার। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ নগদায়ন করে অপ্রাতিষ্ঠানিক, অবৈধ চ্যানেলে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন অনেকে। ভারতে পালিয়ে পাওয়া হাসিনা পরিবারের যেসব সদস্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচার করেছেন, তারা বর্তমান সরকারের প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে থেকে যাওয়া বিশ্বস্ত আমলা-কামলাদের দিয়ে দুর্নীতির আলামত নষ্ট করে ফেলছে। দুদকের অভিজ্ঞ ও সিনিয়র কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্নীতিবাজরা যেন এমন একটি অবস্থার অপেক্ষায়ই ছিল। কারণ এক কমিশন থেকে অপর কমিশন যোগদানের মধ্যবর্তী সময়টুকুতে অন্তর্বর্তীকালীন কোনো বিধান-ব্যবস্থা বিদ্যমান আইনে নেই। এটি বিদ্যমান আইনের একটি বড় ঘাটতি। গত ২০ বছরে কয়েক দফা দুদক আইন সংশোধন ও নতুন বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে। অথচ ‘সাময়িক শূন্যতা’ পূরণের কোনো ব্যবস্থা আইন কিংবা বিধানে যুক্ত করা হয়নি। এর সুযোগ নিচ্ছে দুর্নীতিবাজরা। তবে আইনজ্ঞরা মনে করেন, আইনে শর্তযুক্ত এমন বিধান করা যেতে পারে যে, বিদায়ী কমিশনই পরবর্তী কমিশন দায়িত্বভার গ্রহণ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবে। সেটি সম্ভব না হলে দুদকের নিজস্ব জনবল থেকে সিনিয়র, দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন একটি ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
সিনিয়র কর্মকর্তারা আলাপচারিতায় জানান, রীতিমতো ‘কর্মহীন অবস্থা’র মধ্যে পড়ে আছে দুদক। ২০০৪ সালে কমিশন গঠন হওয়ার পর একবার এমন ‘কর্মহীন’ অবস্থায় নিপতিত হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। তখন বিভিন্ন প্রকল্পের গায়েব হয়ে যাওয়া ৪০০ গাড়ির তত্ত্ব-তালাশ শুরু করেছিল বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন। দুদকের এ তৎপরতা পছন্দ হয়নি তৎকালীন আমলাচক্রের। তাই ‘কার্যবিধি নেই’ এমন ছুতোয় তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সাদত হুসাইন এক চিঠি দিয়ে দুদক কর্মকর্তাদের ‘কর্মহীন’ করে দিয়েছিলেন। ওই ঘটনার প্রায় ২০ বছরের মাথায় দুদক কর্মকর্তারা প্রায় কর্মহীন হয়ে পড়লেন আবারো। এবার কোনো আমলার চিঠিপত্র নেই। কর্মহীন করা হয়েছে অনেকটা সিস্টেমেটিকভাবে। হাসিনা নিযুক্ত কমিশন পদত্যাগ করেছে ২৯ অক্টোবর। এক মাসের বেশি সময় হলেও দুদক পুনর্গঠনের নাম-গন্ধ নেই। জানা গেছে, আইনে বর্ণিত ‘বাছাই কমিটি’ তার কাজ সম্পন্ন করে একটি পদের বিপরীতে দুজন করে কমিশনার হিসেবে ছয়জনের নাম প্রধান উপদেষ্টার দফতরে জমা দিয়েছে। সরকারের সম্মতি মিললেই প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দিতে পারেন নতুন কমিশন। কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটিও ঝুলে আছে দুই বেশি সময় ধরে। কবে দেয়া হবে এ নিয়োগ-নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না কেউ।
আলাপচারিতায় দুদক কর্মকর্তারা আরো জানান, দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনে উন্নীত করে। উদ্দেশ্য, দুর্নীতির তদন্তকে সরকারের প্রভাববলয়ের বাইরে নিয়ে আসা। দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমকে স্বচ্ছ ও গতিশীল করা। কিন্তু নির্মম পরিহাস এই যে, তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ বিরামহীন প্রপাগান্ডায় উল্টো বিএনপি সরকারকেই দুর্নীতিবাজ তকমা দেয়। ভারত সমর্থিত ওয়ান-ইলেভেন সরকার দুর্নীতি দমনের নামে বিএনপি দমনে নিবিষ্ট হয়। পরবর্তী দেড় যুগের শাসনামলে সংস্থাটিকে ব্যবহার করা হয় বিএনপি দমনের হাতিয়ার হিসেবে। দুদককে পরিণত করা হয় ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার মাফিয়াচক্রের সহযোগী প্রতিষ্ঠানে। গত ৫ আগস্ট মাফিয়াতন্ত্রের উৎখাত হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নিয়েছে ৮ আগস্ট। জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং হাসিনার দুর্নীতির বিচার এ সরকারের প্রধান প্রতিশ্রুতি। প্রথমোক্ত প্রতিশ্রুতি পূরণের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপের অগ্রগতি দৃশ্যমান। পক্ষান্তরে হাসিনা রেজিমের দুর্নীতির শ্বেতপত্র হস্তান্তর হয়েছে মাত্র। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দুর্নীতির তদন্ত ও বিচার করা হবে সেটি অকার্যকর হয়ে আছে এক মাসের বেশি সময় ধরে। গত ২৯ অক্টোবর থেকে দুদকে কোনো কমিশন নেই। কমিশন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে গঠিত হয়েছে বাছাই কমিটি। সেই কমিটি দুদক কমিশনার হওয়ার উপযোগী এমন ছয়জনের নাম প্রস্তাব করেছে বলে জানা গেছে। কিন্তু অদ্যাবধি কমিশন গঠন সংক্রান্ত কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি; বরং দুদক পুনর্গঠন সম্পর্কে বাজারে ছড়াচ্ছে নানা কথা। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, বিদ্যমান আইনেই কমিশন পুনর্গঠন হবে? নাকি দুদক সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সংস্কার সম্পন্নের পর নতুন অধ্যাদেশ বলে পুনর্গঠন হবে কমিশন? খুব বেশি হিসাব-নিকাশ নাকি হচ্ছে এবার কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে। কাকে চেয়ারম্যান করা হবে, কাদেরকে কমিশনার করা হবেÑ এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভাগাভাগির খবর পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ এখানে সার্চ কমিটি যেন ঠুঁটো জগন্নাথ। সার্চ কমিটি, সংস্কার কমিশন, দুদক পুনর্গঠন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘বোঝাপড়া’ ইত্যাদির মাঝে কালক্ষেপণটাই যেন মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসিনা রেজিমের দুর্নীতির তদন্ত নিয়ে যে সময়টিতে দুদক প্রবল রকম ব্যস্ত থাকার কথা সে সময়টিতেই সংস্থাটি অকার্যকর। এ অকার্যকর অবস্থা আশার আলো দেখাচ্ছে হাসিনা রেজিমে বিদ্যুৎ খাতসহ বিভিন্ন সেক্টরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লোপাটকারীদের। দুর্নীতিবাজদের বিচারের কাঠগড়ায় তুলতে যত দেরি হবেÑ তত মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যাবে দুর্নীতির ভয়াবহতা। বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছেÑ দুর্নীতির আলামত, রেকর্ডপত্র-সাক্ষ্য-প্রমাণ সরিয়ে ফেলা। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ-সম্পদ সরিয়ে ফেলছে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজরা। অর্জিত অবৈধ স্থাবর সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছে। কৌশলে হস্তান্তরও করে দিচ্ছে বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের কাছে। অনেকে সম্পত্তি, কোম্পানি কিংবা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে অর্থ সরিয়ে নিচ্ছে। এসব বিষয়ে দুদকে তথ্য-প্রমাণসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জমা পড়লেও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। কারণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা শুধু কমিশনের। প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে বর্তমানে সচিব বহাল থাকলেও তার এখতিয়ার নেই এ সিদ্ধান্ত নেয়ার। বিগত কমিশনের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে অনুসন্ধান-তদন্ত, তলব, জিজ্ঞাসাবাদ, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, বিচারাধীন মামলার চালিয়ে যাওয়ার কাজ করছেন সংস্থার কর্মকর্তারা। কিন্তু নতুন কোনো অনুসন্ধান কিংবা মামলা রুজুর সিদ্ধান্ত নেই। এতে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। আখেরে ফল উঠছে দুর্নীতিবাজদেরই ঘরে। তবে কমিশন পুনর্গঠনে কালক্ষেপণ করা দুর্নীতিবাজদেরই কোনো কৌশল কি-না এমন সন্দেহ প্রকাশ করেছেন আইনজ্ঞরা।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, দুদককে অকার্যকর করে রাখার একটি চেষ্টা আমলাতন্ত্রের মধ্যে সব সময়ই ছিল। এখনকার অচলাবস্থা সৃষ্টির মধ্যেও যে এদের হাত নেইÑ এমনটি বলা যায় না। ভেবে দেখুন, দুর্নীতি করে কারা? যারা চেয়ারে থাকেন, যাদের ক্ষমতা থাকে তারাই বেশি দুর্নীতি করেন। পক্ষান্তরে দুদক বেশির ভাগ সময়ই ছিল আমলাদের পদানত। এ কারণে দুদক দুর্নীতির বিরুদ্ধে সেই অর্থে কার্যকর হতে পারেনি। কার্যকর হতে দেয়া হয়নি। বর্তমান প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়ে গেছে বিগত দুর্নীবাজ সরকারের আমলারা। তারা কি এত সহজেই দুদককে কার্যকর হতে দেবে? দুদক সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. ইফতেখারুজ্জামান তো পরিষ্কার বলেই দিয়েছেন, দুদককে আমলা-গহ্বরে পতিত হতে দেয়া যাবে না।
সাবেক জেলাজজ মুহাম্মদ আব্দুর রউফ বলেন, একটি থানা ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হয়। দুদক তেমনি একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এটি এক ঘণ্টার জন্যও বন্ধ থাকতে পারে না। অথচ দেখুন, কমিশন থাকা অবস্থায়ও দুদক শুধু ওয়ার্কিং আওয়ারে (আট ঘণ্টা) খোলা থাকে। ১৬ ঘণ্টাই থাকে বন্ধ। এখন তো কমিশন না থাকায় বলা চলে এক মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ। কারণ কমিশনের অনুমোদন ছাড়া মামলা করা যাচ্ছে না। নতুন অনুসন্ধান-তদন্ত করা যাচ্ছে না। চার্জশিট দেয়া যাচ্ছে না। বদলি-পদোন্নতির মতো রুটিন ওয়ার্কের কথা বাদই দিলাম। গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান মুণ্ডুবিহীন অবস্থায় এতদিন থাকতে পারে না। এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার।
দুদকের সাবেক আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের দুর্নীতিবাজদের সামলে নেয়ার স্পেস দিচ্ছে দুদকের বর্তমান এই অভিভাবক-শূন্যতা। খোঁজ নিয়ে দেখুন, হাসিনা আমলের দুর্নীতিবাজ-ব্যাংক লুটেরাদের টাকা-পয়সা নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে সরকারে থাকা হাসিনার অনুগত আমলারা। তারাই একটিকে অকার্যকর করে রেখেছে।
এদিকে দুদকের সিনিয়র পরিচালক ড. মোহাম্মদ জহিরুল হুদার মতে, অন্তর্বর্তীকালীন কোনো ব্যবস্থা না থাকা দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের একটি সীমাবদ্ধতা। নানা কারণে কমিশন শূন্য হতে পারে। পুনর্গঠনে বিলম্ব হতে পারে। এ পরিস্থিতি বিবেচনা করে অভিযোগ যাচাই-বাছাই, অনুসন্ধান শুরু, অভিযান পরিচালনার মতো রুটিন ওয়ার্ক পরিচালনার জন্য দুদকের নিজস্ব কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন ‘অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা’র আইনি বিধান থাকা জরুরি।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
এসবির প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে গোলাম রসুলকে
পিএসসির ৬ সদস্যের নিয়োগ বাতিল করেছে সরকার
বাংলাদেশের সীমান্তে ১৬০টি জায়গায় কাটাতারের বেড়া দিয়েছে ভারত : রিজভী
সব ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি বন্ধ, ভোগান্তিতে গ্রাহকরা
মোক্ষম চাল রাশিয়ার
লুকিয়ে পাথর লুঠে যেয়ে সিলেটে এক শ্রমিকের মৃত্যু !
বাগেরহাটে আওয়ামী লীগ নেতা বাদশা মিয়া গ্রেফতার
ভারতে পালানোর সময় ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ নেত্রী সুস্মিতা পান্ডে গ্রেপ্তার
খুশদিল ঝড়ে খুলনাকে চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য দিল রংপুর
টানা ৩৫ ঘণ্টা পর অনশন প্রত্যাহার জবি শিক্ষার্থীদের
যাদের চিন্তাধারায় গড়ে উঠেছে পাশ্চাত্য জীবন দর্শন
`সমন্বয়ক, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হ'
মুজিবনগর ঘোষণায় সেক্যুলারিজম সমাজতন্ত্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ছিল না : ৭২ এর সংবিধানে আছে
সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-দখলবাজি রুখতে হবে
এইচএমপিভি: বিমানবন্দর ও এয়ারলাইন্সগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা
হতাহত ৩০
৩শ’ সৈন্য নিহত
৫ মাওবাদী হত্যা
দাবানলে চুরি
চেক প্রজাতন্ত্রে নিহত ৬