দুদকের স্ট্র্যাটেজি কী?
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম
দুর্নীতির মামলা হচ্ছে। এক দিনে ২টি, ৪টি, ৬টি করে। এজাহারে উল্লেখিত টাকার অঙ্কও বিরাট। মামলায় আসামি করা হচ্ছে চিহ্নিত ব্যক্তিদের। কিন্তু কোনো মামলায় গ্রেফতার নেই। ‘গ্রেফতার নেই’ বলাটা অবশ্য সত্যের অপলাপ। অন্য মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা ব্যক্তিদের ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ কিংবা ‘গ্রেফতার’ দেখানো হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নিজস্ব কোনো মামলায় কাউকে প্রথম গ্রেফতার করেনি। ‘মরা সাপ’ ‘মারা’র কৃতিত্ব দেখানোর মতোই। সাধারণ মানুষের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগছে-তাহলে দুর্নীতি দমনে পুনর্গঠিত কমিশনের স্ট্র্যাটেজি কি? মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি? সংখ্যাতত্ত্বের সমৃদ্ধি ঘটানো? মামলায় টাকার অঙ্কের যোগফল আওয়ামী আমলের চেয়ে বেশি দেখানো? নাকি এজাহার রুজুর প্রশ্নে কমিশন কত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে- সেটি দেখানো? প্রশ্নগুলো সরাসরি দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেনকেই করার ছিলো। তিনি পাত্তা দেননি।
কমিশন পুনর্গঠন হয়েছে ১০ ডিসেম্বর। তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিশনের দু’জন যোগদান করেন ১২ ডিসেম্বর। ১৫ ডিসেম্বর যোগদান করেন কমিশনার ব্রি: জে: (অব.) হাফিজ আহসান ফরিদ। তাই প্রশ্ন আসাটা সঙ্গত যে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুনর্গঠিত কমিশনের কাছে এতো প্রত্যাশা কেন? এতো ‘দায়ী’ করা কেন? কারণটি হচ্ছে, জনআকাক্সক্ষা। হাসিনার দীর্ঘ ফ্যাসিজম বাংলাদেশকে ‘মাফিয়া স্টেট’ হিসেবে পরিচিত করে। যেখানে লুন্ঠন আর দুর্নীতি ছিলো ‘মূল নীতি’। এক রক্তক্ষয়ী অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানে উৎখাত হন হাসিনা। ফেলে যান দুর্নীতি জর্জরিত ফোকলা-ছোবড়া অর্থর্নীতি। আর দুর্নীতির প্রান্তিক ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাধারণ, দরিদ্র মানুষ। তারা হাসিনার দীর্ঘ আর্থিক শোষণের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার দেখতে চান। শাস্তি দেখতে চান। তাদের দেখতে চান কারাগারে। সকালের সূর্য দেখে দিনের তেজ আন্দাজ করা যায়। দুদকের ‘শুরু’টা দেখে মানুষ ধারণা পেতে চায় ভবিষ্যতের। কারণ মানুষ অনেক ‘দুদক’ দেখেছে। শেখ হাসিনাও একটি ‘দুদক’ পুষতেন। পুনর্গঠিত দুদক যে গৃহপালিত নয়- সেটি প্রমাণের দায় এ কমিশনের।
গতকাল রোববার তিন সদস্যের কমিশন সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হন। সেখানে চেয়ারম্যান নিজের সম্পদ বিবরণী প্রকাশ করেছেন স্বেচ্ছায়। এ দৃষ্টান্ত নজিরবিহীন নয়। ভারত সমর্থিত ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী কমিশনের চেয়ারম্যান লে. জে. (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরীও দু’পৃষ্ঠার সম্পদ বিবরণী বিলি করেছিলেন। কিন্তু তার করা মামলাগুলো সুপ্রিমকোর্টে টেকেনি। এ কমিশনও চেয়ারে বসে ধুমধাম মামলা করছে। কিন্তু মামলাগুলোর সারবত্তা নিয়ে যখন উচ্চ আদালতে চুলচেরা অ্যানাটমি হবে- তখন হয়তো এ কমিশন থাকবে না। তখন যেন মানুষ হাসান মশহুদ চৌধুরী কমিশনের সঙ্গে এ কমিশনের সাযুজ্য খুঁজে না পায়। ধুপধাপ মামলা রুজুতে কৃতিত্ব নেই। কৃতিত্ব দুর্নীতিবাজের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিতে। গ্রেফতার শাস্তিরই অংশ।
দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন যথার্থই বলেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি যে, প্রধানমন্ত্রীও পালিয়েছেন। একইসঙ্গে জাতীয় মসজিদের খতিবও পালিয়েছেন। রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। কিন্তু এ কথা যথার্থ নয় যে, দুর্নীতির বিষয়ে জনসচেতনতা নেই। দুর্নীতির প্রথম ভুক্তভোগী মানুষ। তাদের সচেতনতার চেয়ে বেশি জরুরি দুদকের সচেতনতা।
মাফিয়া সরকারের দুর্নীতিবাজরা পালিয়ে যাচ্ছে। অর্থ-সম্পদ হাসিনার আমলেই সরিয়ে নেয়া হয়েছে। অবশিষ্টগুলোও সরিয়ে নিচ্ছে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ হস্তান্তর করছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে থাকা শেয়ার বিক্রি ও হাতবদল করছে। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা দুর্নীতির আলামত নষ্ট করে ফেলছে। সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে তাদের পালিয়ে যাওয়ার। অর্থ সরিয়ে নেয়া, স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির লম্বা সময় দেয়া হয়েছে। আলামত নষ্টেরও সময় দেয়া হয়েছে যথেষ্ট। দুর্জনের ছলের অভাব নেই। দুর্নীতিবাজ ভোল পাল্টিয়ে ‘সাদা মনের মানুষ’ বনে যাচ্ছে। এর জন্য বর্তমান কমিশনকে যেন ভবিষ্যতে ‘দায়ী’ করা না যায়।
কমিশনার (তদন্ত) মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজীর মতে, মাত্র অর্ধেক জনবল নিয়ে দুদক কাজ করছে। বর্তমান কমিশন নির্মোহভাবে অনুসন্ধান করবে। কোথাও পক্ষপাত হবে না। কমিশন জাতির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
কমিশনার (অনুসন্ধান)র বক্তব্য আংশিক সত্য। দুর্নীতি অনুপাতে দুদকে জনবল কম। কিন্তু যে জনবল বিদ্যমান, সেগুলোও কি যথাযথ কাজে লাগানো হচ্ছে? বিগত কমিশন থরে থরে সাজিয়ে রেখে গেছে জনবল। এক কর্মকর্তাকে ১৫ থেকে ৩০টি হাইপ্রোফাইল অনুসন্ধান-তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছেতো অন্য কর্মকর্তাকে কোনো অনুসন্ধানই দেয়া হয়নি। ‘বিএনপি-জামায়াত’ তকমা দিয়ে অনেক কর্মকর্তাকে শুধু পদোন্নতি বঞ্চিতই করা হয়নি, সৃষ্টি করা হয়েছে বিশাল বৈষম্য। অপছন্দের কর্মকর্তাকে পোস্টিং দেয়া হয়েছে ঢাকার বাইরে। দুদক থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে প্রেষণের নামে। পক্ষান্তরে গিরগিটির মতো রঙ বদলে যারা হাসিনার অনুগত কমিশনের ফুটফরমায়েশ খেটেছেন তাদের নানাভাবে করা হয়েছে পুরস্কৃত। বিগত হাসিনা অনুগত কমিশনের সাজিয়ে যাওয়া ‘সেটআপ’এ কি কমিশন হাত দিয়েছে? দুদকের অভ্যন্তরীণ কোনো সংস্কার কি নতুন কমিশন করেছে? সুষম কর্মবণ্টন, পদোন্নতি ও পদায়ন না থাকায় অভিজ্ঞ, দক্ষ, যোগ্য কর্মকর্তারা থেকেছেন উপেক্ষিত, বঞ্চিত। পুনর্গঠিত কমিশন কি দুদক কর্মকর্তাদের ক্রমঃ বৈষম্যের দীর্ঘশ্বাস শুনেছে? তাদের হতাশার ক্ষতে হাত দিয়েছে? কমিশনার (অনুসন্ধান) ব্রি: জে: (অব.) হাফিজ আহ্সান ফরিদ বলেছেন, ‘দুদকের পেশাগত ভিত্তি অনেক শক্ত। ৪২ দিন কমিশন না থাকার পরেও দুদকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নিরলস কাজ করে গেছেন। পৃথিবীর কোনো মানুষের দাসত্ব করবে না দুদক।’ দুদকের ধারণাগত বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে তার শেষোক্ত কথায়। কারো দাসত্ব করবে না-স্বশাসিত স্বাধীন দুদকের আইনে তেমনটিই বলা আছে। বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারের দাসত্বের প্রমাণ দেয়াই ছিলো বিগত কমিশনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিগত ৬টি কমিশনের ৪টিই ছিলো আমলা নেতৃত্বাধীন। দাসত্ব করাটা ছিলো মজ্জাগত। সরকারের ‘নৈকট্য লাভ’র প্রতিযোগিতা মানুষ তখন প্রত্যক্ষ করেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে কতটা নাঙ্গা হওয়া যায় দুদক তা দেখিয়েছে। কোনো অর্থ আত্মসাৎ না হলেও দুদকের প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ‘এতিমের অর্থ আত্মসাৎ’র মামলা হয়। সেই মামলায় চার্জশিট দেয় দুদক। অনুগত বিচার বিভাগও কারাদ- দেয়। হাসিনার ইশারায় কিভাবে বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা হয়। কোনো আবেদন ছাড়া পরে সেটি প্রত্যাহারও হয়ে যায়। কিভাবে জাহালম-কা- ঘটে। দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করায় কিভাবে শরীফউদ্দিনের চাকরি যায়। কিভাবে দুর্নীতিবাজ আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা, চিহ্নিত মাফিয়াচক্র, ব্যাংক লুটেরাদের দায়মুক্তির সনদ দেয়া হয়। দুর্নীতি দমনের নামে কিভাবে চুনোপুঁটিকে কারাগারে পোরা হয়েছে। দুষ্টের লালন-শিষ্টের দমনে দুদক কোন্ ভূমিকায় ছিলো- মানুষ দেখেছে। নতুন কমিশনের প্রধানও একজন আমলা। দিনে অর্ধডজন মামলা রুজুর মধ্য দিয়ে এ কমিশন কি বার্তা দিতে চেয়েছেন কে জানে ! কিন্তু দুর্নীতির দায়ে চিহ্নিত কোনো দুর্নীতিবাজ এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়নি। মনোমুগ্ধকর কথার ফুলঝুরিতে নয়। হাসিনার মাফিয়াচক্রের পর্বতসম দুর্নীতি সাম্রাজ্যে টর্নেডোর আঘাত দেখতে চায়। এর মধ্যেই হয়তো নতুন কমিশনের ‘ভিন্নতা’ খুঁজবে মানুুষ।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
প্রোটিয়াদের হোয়াইট ওয়াশ করে পাকিস্তানের ইতিহাস
৯ গোলের উৎসবে লিভারপুলের বড় জয়
বড়দিনের ছুটির আগে রিয়ালের বড় জয়
ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড
গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ
এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ
আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?
হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে
ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন
দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা
নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই
ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে
বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না: আব্দুস সালাম
সরকারের আশ্বাসে শাহবাগ থেকে সরে গেলেন বিএসএমএমইউ ট্রেইনি চিকিৎসকরা
সাকাকে হারিয়ে চিন্তিত আর্সেনাল কোচ
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব জমা হবে : বদিউল আলম মজুমদার
সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী
মানিকগঞ্জের ঘিওরে ছাত্রদল নেতা লাভলু হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন
বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার
জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীর গতিতে চলছে: আমিনুল হক