শাপলার ‘গণহত্যা’ তদন্ত কমিশন সময়ের দাবি
০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:২৫ এএম | আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:২৫ এএম
রাজধানীর মতিঝিলে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কর্মসূচিতে রাতের অন্ধকারে চালানো হয়েছিল গণহত্যা। ২০১৩ সালের ৫ মে’র মহাসমাবেশে যৌথ বাহিনীর রাতের অভিযান ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’য় কতজন নিরীহ সাধারন মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্রকে হত্যা করা হয় তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামীলীগ সরকারের পতন হলেও এ গণহত্যার সাথে সংশ্লিষ্টদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার কোন উদ্যোগ নেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। অথচ এখনই সময় উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিশন গঠন করে নির্দেশ দাতা, নেপথ্যের কারিগর এবং সরাসরি হত্যাকান্ডে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করা। ওই রাতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে কয়েক শত সাধারন শিক্ষক-ছাত্রকে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছিল। পুরো মতিঝিল ও এর আশপাশ এলাকার বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ করে দিয়ে নিরীহ মাদরাসা ছাত্রদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়। অভিযানের পর দ্রুত সিটি করপোরেশনের গাড়ি এনে লাশগুলো অজ্ঞাত স্থানে গুম করে ফেলে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
অন্যেিদকে সেই রাতের ভয়াবহ ও নিষ্ঠুর অভিযানে ৬১ জন নিহত হওয়ার তথ্য দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’। তবে পুলিশের দাবি, রাতের অভিযানে কেউ মারা যাননি। দিনভর সংঘাতে নিহত হয়েছেন ১১ জন।
পুলিশের বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, আলেম ও মাদরাসার ছাত্রদের একটি সমাবেশে রাতে অন্ধকারে যেভাবে গণহত্যা চালানো হয়েছিল তা কোন সভ্য সমাজে নেমে নেয়া যায় না। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির যেসব কর্মকর্তারা এ ধরনের নিষ্ঠুর কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিল তাদের দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। এ জন্য অতি দ্রুত তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে জড়িতদের এবং নেপথ্যে থেকে যারা নির্দেশনা দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। দেশের মানুষ এ ধরনে গণহত্যায় জড়িতদের শাস্তি দেখতে চায় বলে ওই কর্মকর্তারা মন্তব্য করেন। তারা আরও বলেন, বর্তমান ছাত্র-জনতার সরকার বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে সরাসরি জড়িত ও নেপথ্যে নির্দেশ দাতাদের শনাক্ত করার পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করার এখনই উপযুক্ত সময়।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলামের অবস্থান কর্মসূচিতে রাতের অন্ধকারে যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল তা ওপেন সিক্রেট। যেহেতু পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্রদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা-আহত করা হয়েছে, তাই ওই সরকার সঠিক বিচার করবে না এটাই ছিল স্বাভাবিক। বর্তমান অন্তবর্তীকালিন সরকারের উচিত দ্রুত নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের মাধ্যমে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিশন গঠন করে নির্দেশ দাতা, নেপথ্যের কারিগর এবং সরাসরি হত্যাকান্ডে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করা। বর্তমান সরকার দেশের জনসাধারণ দীর্ঘ দিনের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে বিচার ব্যবস্থা করবেন যেন ভবিষ্যতে কোন নিরীহ সাধারন মানুষকে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে এভাবে হত্যা না করা হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, শাপলা চত্বরে রাতে অন্ধকারে পুরো মতিঝিল এবং এর আশপাশের এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে গণহত্যার পর লাশ ট্টাকে করে নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে। এ সময় গণহত্যার ভিডিও ও ছবি ধারণ করতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতনে শিকার হতে হয়েছিল মিডিয়া কর্মীদের। এখনও শাপলা চত্বরের গণহত্যার ভিডিও ও স্থির চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মানুষের কাছে রয়ে গেছে। অতিসাধারণ মাদসারার শিক্ষক-ছাত্র হত্যার তদন্ত করে জড়িতদের বিচার করা এখন সময়ের দাবি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মেজর জেনারেল (প্রকৌশলী) অব. আব্দুল মতিন ইনকিলাবকে বলেন, শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কর্মসূচিতে রাতের অন্ধকারে যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত। একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে ওই গণহত্যার বিচার হতে পারে। কারন ২০১৩ সালের ৫ মে’র হেফাজতের মহাসমাবেশে যৌথ বাহিনীর রাতের অভিযানে কতজন নিরীহ সাধারন মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্রকে হত্যা করেছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি। এছাড়া নিরীহ ও নি:অস্ত্র মানুষের উপর এ ধরনের হত্যাকান্ডকে আওয়ামী লীগ সরকার বৈধতা দিলেও কার্যত এটি বড় ধরনের গণহত্যা ছিল। রাতের আধারে পুরো মতিঝিল ও এর আশপাশের এলাকার বিদ্যুত বন্ধ করে যেভাবে যৌথ অভিযান চালানো হয় তা কখনোই কোন সভ্য সমাজে নেমে নেয়া যায় না। হত্যাকান্ড আড়াল করতে মিডিয়াও বন্ধ করে দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, শাপলা চত্বরের ঘটনার রেশ ধরে পরদিন হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানেও নাশকতায় অভিযোগ আনা হয়। এসব ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৪৯টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে ৩টি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। বাকি ৪৬টি মামলার তদন্ত থমকে আছে। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় হেফাজত নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আরও অন্তত ৩০টি মামলা হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন থানায় করা হেফাজতের মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৩ সালে মামলা হয়েছে ৪৯টি। এর মধ্যে রমনা বিভাগে ৫টি, মতিঝিলে ২৬টি, ওয়ারীতে ৩টি, ডিবির মতিঝিল বিভাগে ১২টি, ডিবির লালবাগ বিভাগে ২টি ও ডিবির ওয়ারী বিভাগে ১টি। এর মধ্যে রমনা বিভাগের ৩টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এ ছাড়া ২০২০ সালে হেফাজতের বিরুদ্ধে রাজধানীতে ৪টি ও ২০২১ সালে ১৩টি মামলা হয়েছে। সব মিলিয়ে ঢাকায় হেফাজতের মামলার সংখ্যা ৬৬টি। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের নাশকতার ঘটনায় তিন হাজার ৪১৬ জনের নামে এবং ৮৪ হাজার ৭৯৬ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছিল। আসামিদের মধ্যে হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট, জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি, ইসলামী ছাত্রশিবির, ছাত্রদল, যুবদল, নেজামে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতাকর্মীর নাম রয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ, পিবিআইসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে এসব মামলা তদন্তাধীন। তবে এসব মামলায় দ্রুত আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা উচিত।
ফিরে দেখা: ১১ বছর আগে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে আলোচনায় এসেছিল কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগ ও নারী নীতির বিরোধিতা করাসহ ১৩ দফা দাবি তুলে হেফাজতে ইসলাম ওই কর্মসূচি নিয়েছিল। ২০১৩ সালের ৫ মে দিনভর উত্তেজনা ও সহিংসতা ছড়িয়েছিল সংগঠনটির ওই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে। সেই রাতে রাজধানীর অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলের শাপলা চত্বর ঘিরে তৈরি হয়েছিল এক ভীতিকর পরিবেশ। পুলিশ, র্যাব ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির অভিযানে খালি করা হয়েছিল শাপলা চত্বর। রাত দেড়টার দিকে বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা এগোনোর চেষ্টা করেন। তারা প্রথমে হাতমাইক ব্যবহার করে অবস্থানকারীদের সরে যেতে বলেন। কিন্তু মঞ্চ থেকে তখনো আসতে থাকে বক্তব্য। ঘণ্টাখানেক এভাবে চলে।
মূল অভিযান শুরু রাত পৌনে তিনটায়। বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ তিন বাহিনীর তখনকার শীর্ষ কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে সদস্যরা ফাঁকা গুলি আর কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে থাকেন। থেমে থেমে সাউন্ড গ্রেনেডও ব্যবহার করা হয়। শত শত গুলি, সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ এবং অন্ধকার এলাকায় এসবের আলোর ঝলকানি মুহূর্তেই ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। ২০ মিনিট ধরে চলে এ পরিস্থিতি। এরই মধ্যে একপর্যায়ে মঞ্চের মাইক বন্ধ হয়ে যায়। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুলি, কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে এগোতে শুরু করেন শাপলা চত্বরের দিকে। বিরতিহীন গুলি, কাঁদানে গ্যাস আর সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দের মধ্যেই ২০০ মিনিটেই পৌঁছে যান শাপলা চত্বরে। সেখানে দেখা যায়, নটর ডেম কলেজের সামনে রাস্তা ও দিলকুশা এলাকা থেকেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রায় একই সময়ে শাপলা চত্বরে পৌঁছেছেন। তখন তিন দিক থেকে আসা পুলিশ, র্যাব, বিজিবির দখলে শাপলা চত্বর। সেখানে মঞ্চের পাশে একটি ভ্যানের ওপর কাফনের কাপড় এবং পলিথিন দিয়ে মোড়ানো চারটি লাশসহ ১১টি লাশ ছিল।
হেফাজতের শত শত কর্মীসমর্থক মাথার ওপর দুই হাত তুলে লাইন ধরে পুলিশের কর্ডনের মধ্য দিয়ে ওই এলাকায় বিভিন্ন ভবন থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। তাদের বেশির ভাগ ছিল মাদরাসার ছাত্র ও কিশোর। তাদের চোখেমুখে ছিল অজানা আতঙ্ক, ভয়। রাতের অভিযানে নিহতের সংখ্যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। আড়াই হাজারের মতো নিহত হওয়ার অভিযোগ তুলেছিল বিভিন্ন দল। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছিলেন, অভিযানের সময় আহত একজন পরে হাসপাতালে মারা যান। আর দিনের সহিংসতায় নিহত চারজনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল মঞ্চের কাছে একটি ভ্যানে। ২০১৩ সালের ৫ মে দিনের সহিংসতা এবং পরদিন ৬ মে দুই দিনে সারা দেশে সহিংসতায় ২৮ জনের নিহত হওয়ার কথা বলেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ঈশ্বরগঞ্জে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া সামগ্রী বিতরণ
যুক্তরাষ্ট্রে দাবানলের কবলে অভিনেত্রী নোরা ফাতেহি
হাসপাতালের তত্তাবধায়কের সাথে অসৌজন্যমূলক আচারণ জেলা প্রশাসকের মধ্যস্থতায় মিমাংশা
ঈশ্বরদী ইপিজেডে কর্মকর্তার অমানুষিক মারধরে শ্রমিকের মৃত্যু
নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাসের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন
মানিকগঞ্জে খান বাহাদুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ
কাউখালীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করার জরিমানা
কালীগঞ্জে দিনব্যাপী পিঠা উৎসব
আগামী মাসের মধ্যে পাঠ্যপুস্তক সবাই হাতে পাবে: প্রেস সচিব
ভাঙ্গায় ডাক্তারের ফাঁকা বাড়িতে মিললো কেয়ারটেকারের হাত-পা বাঁধা মরদেহ
দৌলতপুরে প্রতিপক্ষের হামলায় আহত ১৫, ভাঙচুর ও ব্যাপক লুটের অভিযোগ
কারও পক্ষ নিয়ে কাজ করলে এবার অসুবিধা হবে: কর্মকর্তাদের সিইসি
রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে শহীদ মনিরের নামে হল করার দাবি পিসিসিপি'র
মহেশপুরের ট্রাক ও মোটরসাইকেলে মুখোমুখি সংঘর্ষে যুবক নিহত
শ্রীমঙ্গলে ট্যুরিজম বোর্ডের তিনদিনব্যাপী হারমোনি ফেস্টিভ্যাল মেলা
নীলফামারীর এসিসিএফ ব্যাংকের ম্যানেজার দেড় কোটি টাকা নিয়ে গা ঢাকা
জাবি ছাত্রদলের কমিটি ঘোষনা; বাবর আহবায়ক অনিক সদস্য সচিব
৫৪ ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারের বিরুদ্ধে মামলা করলো দুদক
গভীর রাতে বেসিক ব্যাংকের তালা ভেঙে ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা
বগুড়ার সান্তাহারে তারুণ্যের উৎসব উপলক্ষে র্যালি অনুষ্ঠিত