শুকনো নদী খাল বিলে ফসলের সমারোহ : কৃষি অর্থনীতি চাঙ্গা

Daily Inqilab রেজাউল করিম রাজু

০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৩ এএম


কৃষি প্রধান উত্তরাঞ্চলের মাটি আর মানুষ যেন একাত্মা। মাটিতে সোনা ফলানো কৃষকের ধ্যান-জ্ঞান। এ অঞ্চলের মাটির বৈশিষ্ট্য যেন আল্লাহতায়ালার আর্শীবাদ। মাটি চষে যা লাগানো যায় তাই যেন সোনালী হয়ে ওঠে। ধান, পাট, আখ, আলু, গম, পান, আম, লিচু, টমেটো, শাকসব্জি কি হয় না এখানকার মাটিতে। এ অঞ্চলের মানুষের পেশা ও নেশা হলো ফসল ফলানো। প্রতি ইঞ্চি জমির বুকে হাত চালিয়ে ফসল ফলানোর আনন্দ যে আলাদা। শত দুঃখ কষ্টের মধ্যে নিজ হাতে ফসল ফলানোর অনুভূতি অন্যরকম। মাটি ফুঁড়ে বীজ বুনে একটু শ্রমঘাম আর একটু আদর যতœ দিলে ফসল যেন লকলকিয়ে বেড়ে ওঠে। মাটি অকৃপণভাবে উপহার দেয় আশাতীত ফলন। মেটায় দেশের কোটি কোটি মানুষের প্রয়োজন। চাষাবাদযোগ্য জমির বাইরেও লিজে পাওয়া নদ-নদী, খাল-বিলের বুকে চলছে আবাদ।

এ অঞ্চলের বুক চিরে যাওয়া পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, মহানন্দাসহ বিভিন্ন নদীর উজানে বাঁধ দেয়ায় এসব বড় বড় নদীর সাথে সাথে মরে গেছে অসংখ্য শাখা নদী, খাল বিল। নদ নদীগুলো তলদেশ ভরাট হতে হতে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। বর্ষা মওসুমে এরা জানান দেয় তাদের ক্ষীণ অস্তিত্ব। বর্ষা মওসুম শেষ হওয়ার পর আবার বিশাল বিশাল বালিচর। শাখা নদী গুলোর তলদেশে চাষাবাদ হয় বিভিন্ন ফসলের। চলনবিলসহ খাল বিলগুলোর একই দশা। নদী কেন্দ্রীক পেশাজীবীরা তাদের পেশা বদল করেছে। নৌকার মাঝিমাল্লা জেলে এখন কৃষক। যে নদীর বুকে পাল তুলে নৌকা নিয়ে ছুটেছে মাছ ধরতে সে নদী পানিশূন্য। বিশাল বিশাল বালিচর। প্রতি বছর এর বিস্তৃতি আর উচ্চতা বাড়ছে। এ বিশাল বালিচরের মাঝ খানে যেখানে যেখানে সামান্য পলি পড়েছে সেখানে কাস্তে কোদাল আর লাঙ্গল নিয়ে নেমে পড়েছে ফসল আবাদের জন্য। নিচু স্থানে ইরি, বোরো, গম, মাসকলাই, সরিষা, তরমুজসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করছে। নদীর বালি ফুঁড়ে বসিয়েছে সেচযন্ত্র। চরের নিচে থেকে পানি তুলে তা দিয়ে সেচ দিচ্ছে। মরা নদীর বুকে ঘটিয়েছে সবুজ বিপ্লব। নদীর পাড়ের যে সব স্থান ভরাট হতে হতে উঁচু হয়ে গেছে সেখানেও তৈরী করা হচ্ছে বাগান। কঠোর পরিশ্রম করে বালি সরিয়ে সেখানে মাটির ঢিবি বানিয়ে লাগানো হচ্ছে আম, লিচু আর বাউকুলের গাছ। নিবিড় পরিচর্যার কারণে অনেক বাগান বেড়ে উঠছে। ইতোমধ্যে ফলও ধরতে শুরু করেছে।

শুকনো বালুরর বুকে সবুজের সমারোহ যে কারো মন আকৃষ্ট না করে পারে না। শুধু মনহরণ নয়, এতে করে বদলে গেছে অনেক বেকারের ভাগ্যের চাকা। অনেক কৃষক কৃষাণী তাদের বাড়ির পাশের পুকুর ডোবার পাড় কিংবা খাল বিলের পাড়ে বিভিন্ন ধরনের সব্জির আবাদ করে অভাব ঘুঁচিয়েছে। শিক্ষিত বেকার যুবকরা উৎসাহী হওয়ায় আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ হচ্ছে যা সনাতনী চাষাবাদ ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে বদলে যেতে শুরু করেছে চাষাবাদের ধরণ। এতে উৎপাদনের পরিমানও বাড়ছে। বাইরে থেকে আসা মানুষ পদ্মার পাড়ে গিয়ে একদার প্রমত্ত পদ্মার মরণ দশা দেখে যেমন আঁতকে ওঠেন, তেমনি পদ্মার বালিচরের মাঝে সবুজের সমারোহে পুলকিত হন। বিশেষ করে পদ্মার বালিচরের মাঝে সেচের জন্য শ্যালো মেশিনের ব্যবহার দেখে। এ যেন মরুভ’মির বুক ফুঁড়ে পানির ধারা।

কৃষকরা ইনকিলাবকে জানালেন, বর্ষার সময় পদ্মা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এখন যেখানে চাষাবাদ করা হচ্ছে সেখান দিয়ে নৌকা যায়। তিন চার মাস পর আবার শুধু বালিচর। যেন সাহারা মরুভূমির প্রতিচ্ছবি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পয়েন্ট যেখানে ভারত থেকে পদ্মানদী এসে পড়েছে সেখান থেকে বাঘা লালপুর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পর্যন্ত নদীর তীর ধরে দুশো কিলোমিটারজুড়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়বে। মরা পদ্মার বুকজুড়ে বিশাল বালুচরের বিরুপতা থেকে রক্ষার জন্য কোথাও কোথাও তীরজুড়ে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া পদ্মার তীরজুড়ে আশ্রয় নিয়েছে হাজার হাজার ছিন্নমূল মানুষ। নদ নদীতে জেগে ওঠা পলি মাটি নিয়েও রয়েছে আধিপত্যের থাবা। পানি কমতে না কমতে প্রভাবশালী মহল তৎপর হয়ে যায়। চলে চর দখলের লড়াই। যারা জিতে তাদের পক্ষে ভূমিহীন কৃষক শ্রমঘাম ঝরিয়ে ফসল ফলায়। এটা যে তাদের পেশা ও নেশা। মাটি যে তাদের ডাকে। একদিন ক্ষেতে যেতে না পারলে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আগে চরের এসব ফসল নিয়ে কৃষি বিভাগ মাথা না ঘামালেও এখন তারা আমলে নিয়েছে।

রাজশাহী কৃষি অফিস সূত্র জানায়, জেলায় বিচ্ছিন্ন চর এলাকার ১১টি ব্লকে মোট জমি আছে ১৪ হাজার ৪৪ হেক্টর। এরমধ্যে ৭ হাজার ৯৪৮ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়ে থাকে। আর ১৫ হেক্টর জমি পতিত আছে। চরাঞ্চলের ২ হাজার ৭৯ হেক্টর জমিতে বছরে এক ফসল হয়। আর ৪ হাজার ১৭০ হেক্টর জমিতে দুই ফসল এবং বাকি ১ হাজার ৮১৯ হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে তিন ফসল। কৃষি বিভাগ জানায়, জেলায় মোট ৯টি উপজেলার মধ্যে পবা, গোদাগাড়ী, চারঘাট ও বাঘা চরের আওতায়। এসব উপজেলায় চর আছে ১৪টি। এরমধ্যে পবার চর মাজারদিয়াড় ও চর খিদিরপুর, গোদাগাড়ীর চর আষাঢ়িয়াদহ ও চরদিয়াড় মানিকচর এবং চারঘাটের টাঙ্গন। প্রায় ৫ হাজার ৮১৬ হেক্টর জমির আয়তন নিয়ে সবচেয়ে বড় চর খিদিরপুর। গত অর্থবছরে ১৪টি চরের অন্তভুক্ত মোট জমি ছিল ১৪ হাজার ৮৫৩ হেক্টর। এরমধ্যে ১০ হাজার ১৮৭ হেক্টর জমিতে ফসল আবাদ হয়। টমেটো, মসুর, গম, সরিষা, শাকসব্জি, ভুট্টা, পিয়াজ, রসুন, আদা, আলু, মাসকলাই, চিনাবাদাম ও ধনিয়াপাতা চাষে বেশী আগ্রহ কৃষকদের। গত বছর সবচেয়ে বেশী গম চাষ হয়েছে ২ হাজার ৬৯৫ হেক্টর জমিতে। এর পরই টমেটো চাষ হয়েছে।

চর মাজারদিয়াড়ে গিয়ে দেখা যায়, ভারত সীমান্ত ঘেষা বিস্তীর্ণ মাঠে মাসকলাই, টমেটো ও কাঁচামরিচ চাষ করেছেন চরাঞ্চলের বাসিন্দারা। চাষাবাদে আছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। তবে কাটা তারের বেড়ার পাশেই অনেকটা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই কাজ করেন স্থানীয় কৃষকরা। আর সীমান্তের দুই পাশে বিজিবি ও বিএসএফ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। কৃষি কাজে অভ্যস্ত কৃষকদের এ নিয়ে ভয়-ডর নেই।

ভারত সীমান্তের পিলারের কাছে মাঠে টমাটোর জমিতে নিড়ানি দিচ্ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ কৃষক মিলন। তিনি বলেন, আগে ভাঙ্গাড়ির ব্যবসা করতাম। কিন্তু কয়েক বছর আগে ব্যবসায় লস খেয়ে নিঃস্ব হয়ে যাই। পরে চরে ফিরে এসে ফসল করা শুরু করি। টমেটো, ধান, গম আর আলুর ওপর দিয়েই আমার সংসার চালাচ্ছি। এখন আর্থিকভাবে সচ্ছল আছি। এ চিত্র রাজশাহীর হলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা পর্যন্ত এর হিসাবে আরো অনেক। মরা নদী খাল বিলের বুকে ফসল ফলিয়ে কৃষি ক্ষেত্রে খানিকটা ভূমিকা রাখলেও নদী মরে যাবার ক্ষতিটা অপরিসীম। নদী তীরের মানুষের দাবিÑ ‘ফিরিয়ে দাও সেই প্রবাহ’।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ভারতীয় মিডিয়াকে অপতথ্য ছড়াতে আওয়ামী লীগ সহায়তা করছে: প্রেস সচিব
ফারাক্কার ৫০ বছর: বাংলাদেশের যে প্রভাব পড়েছে
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি এইড ফর মেন ফাউন্ডেশনের
করিডর দেয়ার সিদ্ধান্ত আসতে হবে নির্বাচিত সংসদ থেকে: তারেক রহমান
নির্বাচিত সরকার অবশ্যই স্বৈরাচারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে : তারেক রহমান
আরও
X

আরও পড়ুন

রাজশাহীর চারঘাটে ককটেল বিস্ফোরন ও ভাংচুর

রাজশাহীর চারঘাটে ককটেল বিস্ফোরন ও ভাংচুর

ডিমলায় বিদ্যুতের তাড়ে জড়িয়ে কৃষকের মৃত্যু

ডিমলায় বিদ্যুতের তাড়ে জড়িয়ে কৃষকের মৃত্যু

সালথায় নসিমন-মোটরসাইকেল সংঘর্ষে প্রাণ গেল কলেজ শিক্ষার্থীর

সালথায় নসিমন-মোটরসাইকেল সংঘর্ষে প্রাণ গেল কলেজ শিক্ষার্থীর

পাকিস্তান আকাশসীমা বন্ধ করায় ৭ হাজার কোটি টাকা লোকসান! চাপে এয়ার ইন্ডিয়া

পাকিস্তান আকাশসীমা বন্ধ করায় ৭ হাজার কোটি টাকা লোকসান! চাপে এয়ার ইন্ডিয়া

পায়রা নদী থেকে মৃত ডলফিন উদ্ধার

পায়রা নদী থেকে মৃত ডলফিন উদ্ধার

পূবাইলে শাকিলের বিরুদ্ধে থানায় চাঁদাবাজির অভিযোগ

পূবাইলে শাকিলের বিরুদ্ধে থানায় চাঁদাবাজির অভিযোগ

নিজস্ব সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশ সাধনে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে --অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান

নিজস্ব সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশ সাধনে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে --অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান

সোনারগাওয়ে ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার

সোনারগাওয়ে ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার

রাজশাহীতে সেচ্ছাসেবকলীগ নেতাকে কুপিয়েছে দুর্বত্তরা

রাজশাহীতে সেচ্ছাসেবকলীগ নেতাকে কুপিয়েছে দুর্বত্তরা

কসবায় ছুরিকাঘাতে চাচাতো ভাইকে খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত শাওন ঢাকায় গ্রেপ্তার

কসবায় ছুরিকাঘাতে চাচাতো ভাইকে খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত শাওন ঢাকায় গ্রেপ্তার

'আমিন আমিন' ধ্বনীতে শেষ হলো দাওয়াতে ইসলামীর তিনদিনের ইজতেমা

'আমিন আমিন' ধ্বনীতে শেষ হলো দাওয়াতে ইসলামীর তিনদিনের ইজতেমা

গ্লোবাল লেবার ডে সামিট অনুষ্ঠিত

গ্লোবাল লেবার ডে সামিট অনুষ্ঠিত

শিল্পের নামে জিয়াউর রহমানকে কলঙ্কিত করার ব্যর্থ চেষ্টা, টুইটারে ভাইরাল সাজু খাদেমের ভিডিও

শিল্পের নামে জিয়াউর রহমানকে কলঙ্কিত করার ব্যর্থ চেষ্টা, টুইটারে ভাইরাল সাজু খাদেমের ভিডিও

মাসিক বিলের পাশাপাশি আদানির বকেয়া  পরিশোধ করছে বাংলাদেশ

মাসিক বিলের পাশাপাশি আদানির বকেয়া পরিশোধ করছে বাংলাদেশ

ভারতীয় মিডিয়াকে অপতথ্য ছড়াতে আওয়ামী লীগ সহায়তা করছে: প্রেস সচিব

ভারতীয় মিডিয়াকে অপতথ্য ছড়াতে আওয়ামী লীগ সহায়তা করছে: প্রেস সচিব

ফারাক্কার ৫০ বছর: বাংলাদেশের যে প্রভাব পড়েছে

ফারাক্কার ৫০ বছর: বাংলাদেশের যে প্রভাব পড়েছে

সীমান্তে ২ কৃষককে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, ২ ভারতীয়কে আটক করলো স্থানীয়রা

সীমান্তে ২ কৃষককে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, ২ ভারতীয়কে আটক করলো স্থানীয়রা

নারী সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা কুফর ও শিরক জুমার খুৎবা পূর্ব বয়ান

নারী সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা কুফর ও শিরক জুমার খুৎবা পূর্ব বয়ান

ধামরাইয়ে ছাত্র হত্যা চেষ্টা মামলায় ৫ আসামী গ্রেফতার

ধামরাইয়ে ছাত্র হত্যা চেষ্টা মামলায় ৫ আসামী গ্রেফতার

নিষেধাজ্ঞার ২ মাসে লক্ষ্মীপুরের মেঘনায় ৯৪ জেলের দণ্ড

নিষেধাজ্ঞার ২ মাসে লক্ষ্মীপুরের মেঘনায় ৯৪ জেলের দণ্ড