ঢাকায় অপহরণের ৯০ শতাংশই নারী-শিশু
২৪ মার্চ ২০২৩, ১১:৫৯ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৬:২৭ পিএম
অপহরণের প্রধান কারণগুলো হলো মুক্তিপণ আদায়, যৌন নির্যাতন, পরিবার ও ভ‚মি নিয়ে বিবাদ ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করা
রাজধানীর অদূরে ফতুল্লায় গত বুধবার রাতে শারজাহান রোলিং মিলস্থ বাজারের একটি চায়ের দোকানে বসে চা পান করছিলেন ইয়াসীন ও মনির। সেখান থেকে তারা বাসায় যাবার পথে কয়েকজন মিলে তাদের অপহরণ করে নিয়ে যায় একটি পরিত্যক্ত ঘরে। তাদের হাত-পা বেঁধে নির্যাতন চালায় অপহরণকারিরা। একপর্যায়ে মনিরের ফোন দিয়ে তার ভাইয়ের কাছে মুক্তিপণ হিসেবে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। গতকাল শুক্রবার পুলিশ তাদের উদ্ধারসহ অপহরণকারী চক্রের একাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করে।
গত বছরের ১ ডিসেম্বর দুপুরে গুলশান নতুন বাজার এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হন লতিফ নামে এক ব্যবসায়ী। বিকেলে তার স্ত্রী লতার মোবাইল ফোনে অপহরণকারীরা ৭ লাখ টাকা দাবি করেন। পুলিশের তৎপরতায় শেষে লতিফকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থানায় নিয়ে যান চক্রের সদস্যরা।
রাজধানীর ডেমরা থেকে অষ্টম শ্রেণি পড়–য়া এক কিশোরীকে গত বছরের ১৯ অক্টোবর অপহরণ করে জিসান নামের এক তরুণ। প্রেম প্রস্তাবে রাজি না হলে প‚র্ব পরিকল্পিতভাবে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ওই কিশোরীকে অপহরণ করেন জিসান। পরে কিশোরীকে উদ্ধার করে পুলিশ।
বাড্ডার সাঁতারকুল এলাকা থেকে গত বছরের ১৯ জুলাই দুপুরে রাস্তা থেকে অপহরণ হন বীণা রানী নামে এক গার্মেন্টস কর্মী। জিডির ভিত্তিতে পাঁচদিন পর খুলনা থেকে তাকে উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর অপহরণ মামলায় গ্রেফতার করা হয় রাফিজুলকে। যিনি বীনাকে বিভিন্ন ধরনের কুপ্রস্তাব দিতেন।
মুক্তিপণের দাবিতে প্রায়শই অপহরণের ঘটনা ঘটলেও রাজধানীতে অপহরণের শিকার এমন বেশিরভাগ ঘটনারই ভুক্তভোগী নারী ও শিশু। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য মতে, শুধু গত বছরেই (২০২২) রাজধানীতে ৪৯০ জনকে অপহরণ করা হয়। এর মধ্যে ২৪৭ জন নারী ও ১৯৪ জন শিশু। বাকি ৪৯ জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ অপহরণের শিকার হন। অর্থাৎ রাজধানীতে অপহরণের ৯০ শতাংশেরই ভুক্তভোগী নারী ও শিশু। এছাড়া গত পাঁচ বছরে শুধু ঢাকা মহানগরীতে নারী ও শিশু অপহরণের ঘটনায় ২ হাজার ৩৬৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে নারী অপহরণের ঘটনায় মামলা ১ হাজার ৫১০টি ও শিশু অপহরণ মামলা ৮৫৫টি। নারী ও শিশু অপহরণের পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ অপহরণের ঘটনা ঘটেছে অর্ধশত।
গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত খোদ রাজধানীতে অপহরণের শিকার হয়েছেন ২১৩ জন। সেই হিসাবে রাজধানীতে গড়ে একদিন পরপর একজন অপহরণের শিকার হচ্ছেন। একই সময়কালে অপহরণের ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ১০৩টি। নিখোঁজ-সংক্রান্ত জিডির সংখ্যা দুই শতাধিক। অনেক স্বজন র্যাব-পুলিশকে না জানিয়ে অপহরণকারীদের হাতে মুক্তিপণের টাকা তুলে দিচ্ছেন। সরকারি খাতায় এসব ঘটনা লিপিবদ্ধ হচ্ছে না।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নারী ও কন্যা নির্যাতন বিষয়ক তথ্য অনুযায়ী, ‘২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ৭৪০ নারী ও শিশুকে অপহরণ করা হয়। এর মধ্যে ২০২১ সালে ১৮০ জন, ২০২০ সালে ১২৫ জন, ২০১৯ সালে ১৪৭ জন, ২০১৮ সালে ১৪৫ জন, ২০১৭ সালে ১৪৩ জন ও ২০১৬ সালে ১৩২ জন ছিল।
ডিএমপির তথ্য মতে, ২০২২ সালে রাজধানীতে এ ধরনের ৪৯টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ডিএমপির মিরপুর বিভাগে। এ এলাকায় গত বছর এজাতীয় ১০টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া তেজগাঁও বিভাগে আটটি, মতিঝিল, ওয়ারী বিভাগে সাতটি করে, উত্তরায় ছয়টি, গুলশান, রমনায় পাঁচটি করে এবং লালবাগ বিভাগে একটি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে।
তবে এসব অপহরণের মামলার মধ্যে প্রেমের সম্পর্কের জেরে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ছিল। গত বছর বাড্ডার আলাতুন্নেছা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির আসমা খাতুন (ছদ্মনাম) তার সহপাঠীর সঙ্গে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় আসমার বাবা বাড্ডা থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন।
বাড্ডা থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, অপ্রাপ্ত বয়সে আবেগের বশে অনেক সময় প্রেমের সম্পর্কের কারণে কেউ কেউ পালিয়ে যায়। যেহেতু মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক, ফলে অভিভাবকরাও অপহরণ মামলা করেন। তবে যখন ওই মেয়ে ফিরে আসে তখন দুই পরিবার যদি মীমাংসা করতে চায় তো তখন মামলা তুলে নেয়।
রাজধানীর বিভিন্ন থানায় কথা বলে জানা গেছে, নারী ও শিশু অপহরণের ঘটনা অধিকাংশই প্রেমঘটিত। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগী ও অভিযুক্তদের অধিকাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। এরমধ্যে যারা ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি তাদের ক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন অনুযায়ী শিশু অপহরণ মামলা হয়। এসব ঘটনায় অভিভাবকরা সাধারণত অপহরণ মামলা করেন।
অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যও অনেক সময় এ ধরনের অপহরণ এবং খুনের ঘটনা ঘটে। গত বছরের ২ জানুয়ারি মিরপুর থেকে নিখোঁজ হন তপু। দুদিন পর মিরপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় তপুর লাশ উদ্ধার করা হয়। টাকার লোভে তাকে অপহরণ করা হয়। অপহরণকারীরা চেয়েছিল তাকে অপহরণ করে টাকা নেবে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলেছেন, অপহরণের পেছনে নানা ধরনের উদ্দেশ্য কাজ করে। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক শত্রæতা, মুক্তিপণ আদায়, ব্যবসায়িক বিরোধ ইত্যাদি কারণে অপহরণের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। আবার রাজনৈতিক কারণও অপহরণের ক্ষেত্রে বড় ভ‚মিকা রাখে বলে অনেকের ধারণা। কাজেই সব অপহরণের ঘটনার রহস্য ভেদ করে মানুষের মন থেকে আতঙ্ক দ‚র করতে হবে। অপহরণকে ধরা হয় মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসেবে। ফলে অপহরণের ক্ষেত্রে প্রতিটি ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। একই সঙ্গে আইনের দ্রæত বাস্তবায়ন ও শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক মো. ন‚র খান লিটন বলেন, অপহরণের ঘটনা নতুন নয়। অপহরণেরও বিভিন্ন রকমফের রয়েছে। দুর্বৃত্তরা কখনো জিম্মি করে টাকা আদায় করে, কখনো মারধর করে। আবার কখনো এ ধরনের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ত থাকার কথাও শোনা যায়। যেই ধরনের অপহরণই হোক না কেন, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
তবে পুলিশ বলছে, আইন যেভাবে আছে সেটা যত দ্রæত বাস্তবায়ন করা যায়, সেই কাজটাই করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
জামায়াতে ইসলামী ন্যায় ও ইনসাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়-হারুনুর রশিদ
সড়ক দুর্ঘটনায় পবিপ্রবির উপপরিচালকের মৃত্যু
'মলম' ময়ূখ বিধ্বস্ত তারেকের যুক্তির কাছে: অতঃপর পলায়ন!
হাসিনাকে ফেরাতে ঢাকার অনুরোধকে কেন গুরুত্ব দিচ্ছে না ভারত?
দেশবাসীকে আশ্বস্ত করছি, আমরা বসে নেই: পিনাকী ভট্টাচার্য
৪১ বছর ইমামতি করা ইমামকে রাজকীয় বিদায়
ট্রাম্পের সমর্থকদের মধ্যে বিদেশি কর্মী, ভিসা নিয়ে বিতর্ক
আজও ঢাকার বাতাস ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’
মাদারীপুরের মুখে গামছা বাঁধা অবস্থায় শিশু শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার
বাংলাদেশের মানুষ ভারতের আধিপত্যবাদ রুখে দিবে: মিজানুর রহমান আজহারী
টেনিস বল ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপ টুর্নামেন্টে অংশ নিতে নেপাল গেল সৈয়দপুরের দল
আকাশ মণ্ডল থেকে ইরফান, তদন্তে জানা গেলো আসল পরিচয়
পর্তুগালে জাসাসের ৪৬ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন
আজারবাইজানের বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ইউক্রেনকে দায়ী করলেন রুশ বিমান প্রধান
প্রকাশ্যে এলো হানি-বাদশার দ্বন্দ্ব, গুরুতর অভিযোগ হানির
বন্ধ হয়ে গেলো গাজার শেষ হাসপাতালটিও
মনমোহন সিংহ,ভারতকে নেতৃত্ব দেওয়া এক সাহসী ও দৃঢ় সংকল্পের নেতা
জনগণের অংশগ্রহণেই নির্ধারিত হবে আমরা আসলে কী চাই : জোনায়েদ সাকি
নাগরিক কমিটির ৩৬ সদস্য বিশিষ্ট ‘নির্বাহী কমিটি’ ঘোষণা
সচিবালয়ের কাগজ ভেবে দুটি ট্রাক আটকালো জনতা