ঢাকা   শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৬ পৌষ ১৪৩১

সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে বাধা দান ঝুঁকি আছে সাবধান

Daily Inqilab ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

২০ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:০৪ পিএম

নদীপথের একদল মুসাফির লটারি দিয়েছিল নৌকার নিচ তলা বা উপর তলায় আসন ভাগাভাগির জন্য। বড় দ্বিতল নৌকার আরেক নাম সাম্পান । সম্পানের নিচ তলা থাকে পানির ভেতর এবং সবদিক থেকে বদ্ধ। উপর তলা খোলামেলা আলো বাতাসে উন্মুক্ত। নিচ তলার লোকদের পানির প্রয়োজন হলে উপর তলায় গিয়ে বালতি ফেলে সংগ্রহ করতে হয় । নিচ তলার এক যাত্রীর পানির প্রয়োজন দেখা দেয়ায় সে উপর তলায় যায় পানি সংগ্রহের জন্য। কিন্তু উপর তলার লোকেরা বিরক্তি মনে করে বাধা দেয়, এদিক থেকে পানি নেয়া যাবে না। নিচ তলার লোকটি বাধ্য হয়ে বিকল্প পথ বেছে নেয়।ফিরে এসে হাতুড়ি বাটাল নিয়ে সম্পানের তলা ফুটো করতে খনননকার্য শুরু করে । এই পরিস্থিতিতে যদি অন্য লোকেরা লোকটি হাত ধরে ফেলে তাহলে সাম্পান ডুবে যাওয়ার কবল থেকে রেহাই পাবে এবং যাত্রীরাও প্রাণে রক্ষা পাবে। যদি নৌকা ফুটো করার কাজে লোকেরা বাধা না দেয় তাহলে যাত্রী শুদ্ধ নৌকাটির সলিল সমাধি হবে।

এই উপমাটি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাদীস থেকে নেয়া। সমাজে যারা আল্লাহর আদেশ মান্য করে ও যারা অমান্য করে তাদের পরিণতি কী হতে পারে তা বুঝানো হয়েছে এই উপমার মাধ্যমে। সমাজে কেউ যদি অন্যায় অপকর্ম করে তাকে থামাতে হবে, বাধা দিতে হবে। নচেত অন্যায় অপকর্মের বিস্তার ঘটে গোটা সমাজ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। ঠিক যেন নিচের ফুটো দিয়ে পানি ঢুকে নৌকা, সাম্পান, জাহাযের সলিল সমাধি হওয়া।

সমাজ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন থাকতেই হবে। বৈদ্যুতিক তারে রাবারের বেষ্টনির ভেতর দুটি তার থাকে । একটি নেগেটিভ, অপরটি পজেটিভ। উভয় তারে বিদ্যুত প্রবাহ না থাকলে যে কোনো বিপর্যয় ঘটবে, বর্তমান সভ্যতা অচল হয়ে পড়বে। সাগরে জোয়ার ভাটা থাকতেই হবে। নচেত অনন্ত সাগর জমাট বরফে পরিণত হয়ে বিশ^প্রকৃতি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। নারী আর পুরুষ না হলে যেমন মানব বসতি পৃথিবীতে থাকবে না। সৎকাজ অসৎকাজে আদেশ নিষেধ না থাকলেও মানব সভ্যতা টিকবে না। মানব দেহে দুটি চোখ একই কাজ করে। এরপরও একটির নাম বাম চোখ অপরটির নাম বাম চোখ। সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের বিপরীতমুখি দুটি প্রক্রিয়ায় মানব সমাজ ও সভ্যতা টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে মুসলিম উম্মাহকে।

‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির (কল্যাণ সাধনের) জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে; তোমরা সৎকাজের আদেশ দান কর, অসৎকাজে নিষেধ কর এবং আল্লাহতে বিশ^াস রাখ...। -(সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১১০)
সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজে বাধা দেয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা হল, এই দায়িত্ব পালনে উৎসাহী একটি মহলের নানা পদক্ষেপ সমাজ ও সভ্যতার জন্য কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণ ডেকে আনে। এর কারণ, এই দায়িত্ব পালনের পরিসর কতটুকু এবং কোথায় কীভাবে ভ‚মিক রাখতে হবে সে জ্ঞান তাদের নেই। ফলে আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের বিখ্যাত হাদিসটির ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে অযাচিত তালগোল পাকিয়ে ফেলে। রাসূলে পাক (সা) বলেছেন,

‘আবু সাঈদ খুদরি (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোনো অন্যায় অসৎকর্ম দেখতে পায় সে যেন হাতের দ্বারা তাকে পরিবর্তন করে। যদি তাতে সমর্থ না হয়, তাহলে মুখের দ্বারা যেন এর পরিবর্তন করে। যদি তাও সম্ভব না হয়, মন থেকে তার পরিবর্তন কামনা করবে। আর এটি ঈমানের দুর্বলতম পর্যায়।’ (মুসলিম)

বাস্তব অবস্থা হল, কোথাও কোনো অন্যায় দেখে যদি কেউ হাতের দ্বারা বা জোর পূর্বক বাধা দেয়ার চেষ্টা করে লোকটি নিজেই বিপদের মুখে পড়ে যায়, সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। মুখে পরিবর্তন করার ক্ষেত্রেও এ ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। কারণ, মুখে পরিবর্তন চাওয়ার জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন, যে বিষয়টিকে অন্যায় মনে করা হচ্ছে তা শরীয়তের দৃষ্টিতে অন্যায় কিনা বা কোন পর্যায়ের অন্যায় তা নির্ণয়ের জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন। তারপর বিষয়টি যে অন্যায় যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে হবে, অন্যথায় হিতে বিপরীত ফল বয়ে আনবে।
আপনি চোখে দেখেছেন একজন চুরি করেছে কিংবা ব্যভিচারে লিপ্ত । আপনি কি চুরির শাস্তি হাতকাটা বা ব্যভিচারের শাস্তি পাথর ছুড়ে হত্যা বা একশ ঘা বেত্রাঘাত কার্যকর করতে পারবেন। তাহলে হাদীসের ব্যাখ্যা কি হবে।
আমরা হয়ত মনে করি, ইসলাম নিয়ে আলেমদের মাথা ব্যথা। কিন্তু ইসলাম তো সমাজের সর্বস্তরের সকল মুসলমানদের জন্য। হাদীসে নির্দেশিত হাতের দ্বারা বা ক্ষমতা প্রয়োগে অন্যায় প্রতিরোধের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে সেসব লোকদের উপর, যাদেরকে আল্লাহ রাষ্ট্রক্ষমতা দিয়েছেন বা আইন প্রয়োগের বৈধ অথিরিটি হিসেবে সমাজে স্বীকৃত। যদি রাষ্ট্রীয় বা আইন প্রয়োগের ক্ষমতার অধিকারী না হয়, তাহলে দ্বিতীয় স্তরের দায়িত্বটি বর্তাবে সমাজের আলেম সমাজ বা জ্ঞানীগুণি মহলের উপর। তারাই লেখালেখি, বক্তৃতা-বিবৃতি, মিছিল-মিটিং মতামত প্রকাশ বা জনমত গঠনের মাধ্যমে এই দায়িত্ব আঞ্জাম দেবে। আপনি আমি যদি উল্লেখিত দুই শ্রেণীর অন্তভর্‚ক্ত না হই, যদি প্রশাসনিক ক্ষমতা বা ন্যায় অন্যায় নির্ণয়ে জ্ঞানের অধিকারী না হই তা হলে আমার আপনার দায়িত্ব হবে তৃতীয় প্রকারের । অর্থাৎ কোনো অন্যায় হতে দেখলে মন থেকে তার পরিবর্তন কামনা করা, ঘৃণা করা এবং এ কাজে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির লোকদের সমর্থন যোগানো।

আমার কথাগুলো একেবারে সহজ ও সংক্ষিপ্ত। তবে এ বিয়য়ে দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাসটুকু এখানে উপস্থাপন করেছি। মনে রাখতে হবে, হাদীসের ব্যাখ্যায় সামান্য বিচ্যুতি মুসলিম উম্মাহর মধ্যে উগ্রবাদী চিন্তার বিস্তার ঘটাতে পারে, সমাজ ও সভ্যতার জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। তার ভয়াবহ নজির আমরা দেখেছি একযোগে চৌষট্টি জেলায় বোমাবাজির মধ্যে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও কথায় কথায় ভিন্ন মতের মুসলমানকে কাফের ও হত্যাযোগ্য গণ্য করার যে উন্মাদনা ছড়ানো হচ্ছে তার গোড়ায় রয়েছে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকজে বাধা দানের আদেশ সম্পর্কিত হাদীসের ব্যাখ্যায় বিভ্রাট। কাজেই সাবধানে পা ফেলতে হবে।

 


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে চূড়ান্ত লড়াই

যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে চূড়ান্ত লড়াই

টিউলিপ সিদ্দিককে মন্ত্রিত্ব থেকে সরানোর কথা ভাবছেন কিয়ার স্টারমার

টিউলিপ সিদ্দিককে মন্ত্রিত্ব থেকে সরানোর কথা ভাবছেন কিয়ার স্টারমার

আগুনে পুড়ল ৫০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ, চলছে লুটপাট

আগুনে পুড়ল ৫০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ, চলছে লুটপাট

লস অ্যাঞ্জেলেসে দাবানল, প্রবল বাতাসে পরিস্থিতি ভয়াবহ

লস অ্যাঞ্জেলেসে দাবানল, প্রবল বাতাসে পরিস্থিতি ভয়াবহ

কাতারের আমিরের উদ্দেশে ফেসবুকে যা লিখলেন তারেক রহমান

কাতারের আমিরের উদ্দেশে ফেসবুকে যা লিখলেন তারেক রহমান

গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরও ৭০ ফিলিস্তিনি, মানবিক বিপর্যয় অব্যাহত

গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরও ৭০ ফিলিস্তিনি, মানবিক বিপর্যয় অব্যাহত

নারী শিক্ষার্থীদের ওয়াশরুমে ভিডিও ধারণ, যুবক আটক

নারী শিক্ষার্থীদের ওয়াশরুমে ভিডিও ধারণ, যুবক আটক

শেখ হাসিনার সাথে হত্যা মামলায় জড়িত পটুয়াখালীর ইটবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগ নেতা মোজাম্মেল আটক

শেখ হাসিনার সাথে হত্যা মামলায় জড়িত পটুয়াখালীর ইটবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগ নেতা মোজাম্মেল আটক

বেরোবিতে দুই বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ

বেরোবিতে দুই বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ

ঠাকুরগাঁওয়ে ইত্যাদি চিত্রায়ন অনুষ্ঠানে চেয়ার ভাঙচুর-মারামারি, অনুষ্ঠান স্থগিত

ঠাকুরগাঁওয়ে ইত্যাদি চিত্রায়ন অনুষ্ঠানে চেয়ার ভাঙচুর-মারামারি, অনুষ্ঠান স্থগিত

কেসিসির সাবেক কাউন্সিলর টিপু কক্সবাজারে খুন

কেসিসির সাবেক কাউন্সিলর টিপু কক্সবাজারে খুন

লক্ষ্মীপুরে বিদেশি পিস্তলসহ গৃহবধূ আটক

লক্ষ্মীপুরে বিদেশি পিস্তলসহ গৃহবধূ আটক

ফটিকছড়িতে অবৈধ বালু উত্তোলনে বাধা দেয়ায় কৃষককে পিটিয়ে হত্যা!

ফটিকছড়িতে অবৈধ বালু উত্তোলনে বাধা দেয়ায় কৃষককে পিটিয়ে হত্যা!

৭ ডিগ্রিতে নামল পঞ্চগড়ের তাপমাত্রা

৭ ডিগ্রিতে নামল পঞ্চগড়ের তাপমাত্রা

ম্যাচের আগে হঠাৎ বরখাস্ত এভারটন কোচ

ম্যাচের আগে হঠাৎ বরখাস্ত এভারটন কোচ

চীনের অবিশ্বাস্য সামরিক উত্থানে টনক নড়েছে ভারতের

চীনের অবিশ্বাস্য সামরিক উত্থানে টনক নড়েছে ভারতের

পারমাণবিক বোমা সজ্জিত নতুন যুদ্ধজাহাজে আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন কিম

পারমাণবিক বোমা সজ্জিত নতুন যুদ্ধজাহাজে আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন কিম

ধর্ষণের প্রতিশোধে বাবাকে হত্যা, গ্রেফতার ২ কিশোরী

ধর্ষণের প্রতিশোধে বাবাকে হত্যা, গ্রেফতার ২ কিশোরী

আমাকে ধর্ষণ করার ভিডিও দেখে স্বামী

আমাকে ধর্ষণ করার ভিডিও দেখে স্বামী

হজযাত্রীর সর্বনিম্ন কোটা নির্ধারণে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা নেই

হজযাত্রীর সর্বনিম্ন কোটা নির্ধারণে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা নেই