ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

মারাত্মক অচলাবস্থায় বাংলাদেশ : ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদন

Daily Inqilab স্টাফ রিপোর্টার

০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:১৩ এএম | আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:১৩ এএম

‘বিয়োন্ড দ্য ইলেকশন: ওভারকামিং বাংলাদেশজ পলিটিক্যাল ডেডলক’ শীর্ষক দীর্ঘ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রাসেলসভিত্তিক অলাভজনক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন থিংকট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। সে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। কর্তৃত্ববাদ ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের মধ্যে অনেকটাই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ওপর সরকারের দমনপীড়ন ও বিরোধী দলের সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার উত্তেজনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে এবং বিরোধীদের নির্বাচন বর্জনের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে আরো বলেছে, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নিজ তত্ত¡াবধানে ত্রæটিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতায় তার দলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে বেপরোয়া কর্মকান্ড চালিয়েছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট, বৈদেশিক সম্পর্কের পালাবদল এবং নতুন করে উজ্জীবিত বিরোধী দল আওয়ামী লীগের জন্য আরেকটি একতরফা নির্বাচন করা কঠিন করে তুলেছে। এতে আরও বলা হয়,  বিরোধীদের নির্বাচন বর্জন মানে ভোটার উপস্থিতি সম্ভবত কম হতে যাচ্ছে। ব্যালটে তেমন বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প না থাকায় অসন্তুষ্ট বাংলাদেশিরা রাজপথে নামছে এবং রাজনৈতিক সহিংসতার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্ব›দ্বী পক্ষগুলোর মধ্যেও দাঙ্গাহাঙ্গামা দেখা দিতে পারে।

এক্ষেত্রে করণীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে, যদিও জানুয়ারির নির্বাচন পিছিয়ে দিতে এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের উচিত ভোটের পর উভয়পক্ষ থেকে ছাড়ের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনা কমাতে কাজ করা। বিদেশি অংশীদারদের উচিত তাদের এই লক্ষ্যে উৎসাহিত করা। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি মারাত্মক অচলাবস্থার মধ্যে আটকা পড়েছে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার এবং বিরোধী দল বিএনপি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং নির্বাচন তদারকির জন্য একটি তত্ত¡াবধায়ক প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহŸান সরকার প্রত্যাখ্যান করার পর বর্তমান সরকারের প্রতি ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও তার মিত্ররা ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে।

এর পরিবর্তে শেখ হাসিনা তাকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করতে বিরোধীদের প্রচেষ্টাকে দুর্বল করতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা- পুলিশ, বিচার বিভাগ ও বেসামরিক প্রশাসনের ওপর থাকা নিজ নিয়ন্ত্রণকে ব্যবহার করে আসছেন। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় একটি বড় সমাবেশের পর, যা সহিংসতায় রূপ নেয়, বিরোধী দলের বেশিরভাগ সিনিয়র নেতাদের আটক করে সরকার এবং বিএনপিকে ভেঙে দেওয়াটা উদ্দেশ্য বলে মনে হচ্ছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব ছিল। এরপর আরেকটি ত্রæটিপূর্ণ ভোট বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তেজনাকে বাড়িয়ে তুলবে। যদিও এখন ভোট স্থগিত করতে অনেক দেরি হয়ে গেছে, সংকটের সমাধান এবং আরও অস্থিতিশীলতা রোধ করার লক্ষ্যে সরকার ও বিরোধীদের উচিত ভোটের পর আলোচনা শুরু করা।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার তাদের বিরোধীদের দমিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন প্রশাসনে পরিণত হয়েছে। এমনকি ১৯৮০’র দশকের সামরিক শাসনকেও ছাড়িয়ে গেছে। দেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে পাওয়া উত্তরাধিকার এবং একটি শক্তিশালী দলীয় কাঠামো থাকায় তিনি ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে তার সাফল্য গড়ে তুলেছেন। তার সরকার এক দশকেরও বেশি সময় শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নত স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তার তদারকিতে নিরাপত্তা বাহিনী ২০০০-এর দশকে উত্থান হওয়া জিহাদি গোষ্ঠীগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে। পুরোনো মিত্র ভারতসহ বিদেশি সমর্থন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেও, যারা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে’ আওয়ামী লীগকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করে এবং ২০১৭ সালে মিয়ানমারে দমনপীড়ন থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে গ্রহণে তাদের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয়- এ বিষয়গুলোও শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে।

শেখ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, কিন্তু যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার আওয়ামী লীগের সংকল্প বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে অবক্ষয় সাধন করেছে। এক দশকে হাসিনা আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা সংস্থা ও নির্বাচনী কর্তৃপক্ষসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন; অনুগতদের এসব জায়গায় বসিয়েছেন। তার সরকার বিরোধীকর্মী, সুশীল সমাজের ব্যক্তিত্ব এবং সাংবাদিকদের ওপরও নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। নিরাপত্তা বাহিনী কয়েকশ বলপূর্বক নিখোঁজ (গুম) এবং কয়েক হাজার বিচারবহির্ভ‚ত হত্যাকাÐের সঙ্গে জড়িত ছিল। আরো অনেক কর্মীকে অন্তহীন মামলায় আদালতে দৌড়াতে হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নতুন কঠোর আইনে করা মামলাও। শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের জন্য তেমনই গুরুত্বপূর্ণ ছিল ২০১১ সালের সংবিধানের সংশোধনীগুলো। এর মাধ্যমে ভোটের আগে তত্ত¡াবধায়ক প্রশাসনকে পথ করে দিতে নির্বাচিত দলীয় সরকারগুলোকে সরে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয় বিধানগুলো বাদ দেয়া হয়। এই সংশোধনীর কারণে বিরোধী দল ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে এবং ২০১৮ সালের ভোটে অংশ নেওয়ার সময় তারা কর্তৃপক্ষের হাতে ক্রমাগত দমনপীড়নের সম্মুখীন হয়। এ নির্বাচনে ব্যালটবাক্স ভর্তির ব্যাপক অভিযোগের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা ৯৬ শতাংশ আসনে জয়ী হয়। এই ভোট এভাবে সংসদের ভ‚মিকাকে শেখ হাসিনার নির্বাহী আদেশ কার্যত দ্বিমত ছাড়াই অনুমোদনে কুক্ষিগত করে ফেলে, যেখানে ২০১৪ সালে বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কটের পর ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ ছিল।

গত নির্বাচনের (২০১৮ সালে রাতের নির্বাচন হিসেবে পরিচিত) পর থেকেই দেশে-বিদেশে অসন্তোষ বাড়ছে। অনেক বাংলাদেশি অভিযোগ করেন, পনের বছর ধরে তারা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। তারা তাদের মতপ্রকাশের সুযোগ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন। সরকারের জন্য আরও ক্ষতিকর হলো অর্থনীতির চাকচিক্য ¤øান হয়ে গেছে; ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি ও উচ্চ মুল্যস্ফীতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যার ফলে অনেক নিম্ন-আয়ের শ্রমিককে জীবিকা উপার্জনে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যদিও বাহ্যিক কিছু কারণ আংশিক ভ‚মিকা রেখেছে, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে বেঁধে দেওয়া মুদ্রাবিনিময় হার নীতির ফলে এই অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো প্রকটতর হয়েছে। এদিকে ওয়াশিংটনে বাইডেন প্রশাসন মানবাধিকার লংঘনে জড়িত বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের (র‌্যাবের কয়েকজন সদস্য) ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে মনে করা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্যদের ভিসায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার হুমকি দিয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের এসব পদক্ষেপ বিরোধী দলকে জাগিয়ে তোলে। তারা ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে ঢাকা ও অন্য শহরগুলোতে অসংখ্য বড় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে, যা প্রায় এক দশকের মধ্যে প্রথম। তাদের ব্যর্থ করে দেয়ার সরকারি প্রচেষ্টা সত্তে¡ও ২০২২ সালের ডিসেম্বর এবং ২০২৩ সালের জুলাই ও অক্টোবরে বড় সমাবেশগুলোতে লাখো সমর্থক অংশ নেন। এ সমাবেশগুলোর মধ্যে সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের সমাবেশটি বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের পর পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও স্টান গ্রেনেড দিয়ে উপস্থিত লোকজনকে ছত্রভঙ্গ করে দিলে আগেভাগেই শেষ হয়ে যায়। রাস্তায় সংঘর্ষের সময় বিএনপির সমর্থকরা একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। প্রতিক্রিয়ায় সরকার দলটির বেশিরভাগ জ্যেষ্ঠ নেতাকে গ্রেপ্তার করে এবং কারাগারে রিমান্ডে নেয়।

এসব ঘটনা দুই পক্ষের মধ্যে বৈরিতা আরও তীব্র করেছে। শেখ হাসিনা বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ নাকচ করে দিয়েছেন। এদিকে বিএনপি ও তার মিত্ররা অর্থনীতিকে ব্যাহত করতে এবং সরকারকে তাদের নির্বাচনী দাবিতে রাজি হতে বাধ্য করতে হরতাল ও অবরোধের ডাক দিয়েছে। সিনিয়র নেতাদের দলত্যাগের প্রলোভন দিয়ে বিএনপিকে বিভক্তও করতে চেয়েছে আওয়ামী লীগ, যদিও এক্ষেত্রে খুব একটা সফল হয়নি তারা। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী শক্তিগুলো একটি বৃহত্তর সরকারবিরোধী জোট গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, যেখানে সেসব দলও থাকছে, যারা আগে কখনো ছিল না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ এখন এক সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছে। অপূর্ণ হলেও একসময়ের প্রাণবন্ত গণতন্ত্র শিগগির ক্ষমতাসীন সরকার বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প ছাড়াই তৃতীয় নির্বাচন করবে। শেখ হাসিনার নিজের মতো করে নির্বাচন করার সংকল্প ভোটের আগে ও পরে সহিংসতার ঝুঁকি বাড়াবে। অর্থনৈতিক ও ভ‚রাজনৈতিক প্রতিক‚ল পরিস্থিতির পাশাপাশি দলটি যে অভ্যন্তরীণ বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছে, সে পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের একটি সমঝোতা চাওয়ার কারণ রয়েছে। যদিও শেখ হাসিনার দল স্বল্পমেয়াদে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে, বিরোধী দল নিজেদের কর্মকাÐ চালিয়ে নিতে পারে। সম্ভাব্য সহিংস প্রতিক্রিয়াসহ আওয়ামী লীগের ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ বাড়তে পারে। অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে দুই পক্ষকে সংলাপে বসতে হবে। প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক পুনর্গঠন এবং বাংলাদেশকে গণতন্ত্র, শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে ফিরিয়ে আনতে আলোচনার জন্য উভয়পক্ষ থেকে ছাড় প্রয়োজন। দেশটির বিদেশি অংশীদারদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের উচিত তাদের সেই দিকে সক্রিয়ভাবে উৎসাহিত করা।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ তার প্রতিবেদনে আরো বলেছে, মানবাধিকার লংঘনকে খতম করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসা সত্তে¡ও এই সরকার এই অধিকার লংঘনের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের মুখে, কখনো তা লংঘন হয়েছে রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশি মানবাধিকার বিষয়ক গ্রæপগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে কমপক্ষে ৬০০ মানুষকে জোরপূর্বক গুমের জন্য দায়ী নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। ভিকটিমদের মধ্যে এখনও প্রায় ১০০ জন নিখোঁজ। সবচেয়ে খারাপ যেটা তা হলো, বিচারবহির্ভ‚ত হত্যাকাÐের অভিযোগ আছে র‌্যাবের মতো আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে। তারা একে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ বলে চালিয়ে দেয়। ২০১৮ সালে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসেবে এমন ক্রসফায়ার হলেও অনেক সময় রাজনৈতিক বিরোধীরা ভিকটিমে পরিণত হয়েছেন। বিরোধী নেতাকর্মী, নাগরিক সমাজের সদস্য এবং সাংবাদিকদের দমনপীড়নে পুলিশ এবং ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ আইনি ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণকে ব্যবহার করেছে সরকার। সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে মানহানির ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনেকের কারাদÐ হয়েছে। এসব ঘটনা আতঙ্কের আবহ সৃষ্টিতে ভ‚মিকা রেখেছে। এর ফলে সেলফ-সেন্সরশিপ একটি আদর্শ হয়ে উঠেছে। এটা শুধু সংবাদমাধ্যম নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের জন্যও। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের স্থান ‘ক্লোজড’ হিসেবে মূল্যায়ন করেছে অধিকার বিষয়ক গ্রæপ সিভিকাস মনিটর। এর মধ্য দিয়ে চীন, মিয়ানমার ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোর র‌্যাকিংয়ে গেছে বাংলাদেশ।

এই প্রতিবেদনে নতুন চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে বলা হয়েছে, সা¤প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার। এই অসন্তোষ তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য হুমকি হতে পারে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর তাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে দেখা যায়। পরবর্তী নির্বাচনে গুরুতর চ্যালেঞ্জ বিরোধীরা দাঁড় করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে ছিল সংশয়। কিন্তু সরকারের পররাষ্ট্রনীতি বদলে যাওয়া এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি মিলে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। এতে বিরোধীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যাহত ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা সত্তে¡ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট ২০২৩ সালে এক জরিপে দেখতে পায় যে, জরিপে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা মাত্র ৪৪ ভাগ মানুষ মনে করেন দেশ সঠিক পথে এগুচ্ছে। ২০১৯ সালে এই হার ছিল শতকরা ৭৬ ভাগ। যদিও গণতান্ত্রিক অবস্থা নিয়ে অসন্তোষ ছিল, তবু ক্রমবর্ধমান পণ্যমূল্য উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রাথমিক কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বিরোধী দলের প্রতি দ্রæতগতিতে জনসমর্থন বৃদ্ধি পায়। ২০১৯ সালে এই হার ছিল শতকরা ৩৬ ভাগ। তা বেড়ে হয়েছে শতকরা ৬৩ ভাগ। এর ফলে বর্তমান নির্বাচন পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করা কঠিন বলে দেখতে পেয়েছে সরকার।

ওই প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক সঙ্কট সম্পর্কে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের মধ্যভাগ থেকে বিশেষ করে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘অর্থনৈতিক মিরাকল’ সম্পর্কে আখ্যান প্রকাশ পায়। বাহ্যিক উন্নয়ন এবং আভ্যন্তরীণ নীতির সিদ্ধান্ত মিলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক এক আঘাত দিয়েছে। তা বৃদ্ধি পেয়েছে মুদ্রাস্ফীতির কারণে। বাজারের চাহিদা মেটাতে ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও দ্রæত পতন হয়। এর ফলে ২০২২ সালের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফের কাছ থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ চায় সরকার। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রোস রিজার্ভ ছিল ৪৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের নভেম্বরে তা ২৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। নিট রিজার্ভ ছিল ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে। তিন মাসের আমদানি খরচ মেটাতে এই অর্থ যথেষ্ট নয়। যদিও বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক তৈরি পোশাক খাতের বড় অবদানের কারণে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতি ভাল মনে হচ্ছে, কিন্তু ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে অবনতিশীল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অর্থনীতি যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে তা সরকারি ডাটায় পুরোপুরি প্রতিফলিত নাও হতে পারে। বিশেষ করে এই অবনতিশীল ক্ষতিকর অবস্থার শিকার নিম্ন আয়ের মানুষরা।

প্রাথমিকভাবে বাহ্যিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের বিষয়ে সরকারের প্রতিক্রিয়া পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে। সবচেয়ে ক্ষতিকরভাবে স্থানীয় টাকাকে কৃত্রিমভাবে ডলারের বিপরীতে উচ্চ হার নির্ধারণ করে মুদ্রাস্ফীতিকে সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছে সরকার। এতে রিজার্ভের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি হয়েছে। অনানুষ্ঠানিক বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন চালিয়েছে সরকার। এসব মার্কেটে ডলার বিক্রি হচ্ছিল শতকরা কমপক্ষে ১০ ভাগ প্রিমিয়ামে। এসব কারণে বাণিজ্যে তারল্য চ্যালেঞ্জ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার আর্থিক, মনিটারি এবং বাণিজ্যিক পলিসিতে ধারাবাহিক ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে। সামনের মাসগুলোতে অর্থনীতি কিভাবে আবর্তিত হবে তা নিয়ে বিভক্ত মতামত আছে। বিনিময় হার সংস্কার বিলম্বিত করে সরকার একটি ঝুঁকিপূর্ণ খেলা খেলছে, যখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রতি মাসে একশ কোটি ডলার করে কমে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর আরো পতন হলে নির্বাচনের পরে ভাসমান মুদ্রার ব্যবস্থাপনায় সরকারের তত কম সম্পদ থাকবে। সরকারের ঘনিষ্ঠ একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, অর্থনীতি লেজেগোবরে অবস্থা। খুব সহসাই তার উন্নতি হবে না। শেখ হাসিনাকে ‘শক’ থেরাপি বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব কারণে সব ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সাময়িক স্থগিত হয়ে যেতে পারে এবং সরকারি কর্মচারীদের বেতন শতকরা ২০ ভাগ কর্তন করতে হতে পারে। তিনি আরো বলেন, তার দরকার একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক টিম। কিন্তু বর্তমান সময়ে তার তেমন টিম নেই। আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা এসব উদ্বেগের প্রতিধ্বনি করেছেন। দেশের অর্থনীতিতে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। তবে তা কতটা খারাপ অবস্থার তা আমরা এখনও জানি না। আমরা আশা করি শেখ হাসিনা (নির্বাচনের পর) একটি নতুন টিম নিয়ে যাত্রা শুরু করবেন। এই টিমের সদস্যদের থাকবে আপডেট জানাশোনা। তারা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবেন। অন্য কর্মকর্তারা এবং ব্যবসায়ীরা আরো আশাবাদী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর স¤প্রতি বলেছেন, তার সরকারি চাকরির ৩৬ বছরের মধ্যে এই মাত্রার অর্থনৈতিক সঙ্কট কখনো দেখেননি। তিনি আশা করেন নির্বাচনের পরে অর্থনীতিতে পুনরুদ্ধার হবে। একইভাবে প্রথম সারির একজন ব্যবসায়ী ক্রাইসিস গ্রæপকে বলেছেন, তিনি আশা করেন জানুয়ারির পর রিজার্ভ বাড়বে, যখন নির্বাচন শেষ হয়ে যাবে। প্রতিটি নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক সহিংসতা হয়। এটা একটা ভাইরাল ফ্লুর মতো, যা প্রতি ৫ বছর পর পর আমাদের সামনে আসে। এটাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদেরকে বাঁচতে শিখতে হবে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

চিহ্নিত গোষ্ঠী আবার দখলদারি ও চাঁদাবাজি শুরু করেছে : সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম চরমোনাই

চিহ্নিত গোষ্ঠী আবার দখলদারি ও চাঁদাবাজি শুরু করেছে : সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম চরমোনাই

গায়িকা রুকসানার রহস্যজনক মৃত্যু!

গায়িকা রুকসানার রহস্যজনক মৃত্যু!

যে কোনো মূল্যে লাহোর কর্মসূচি সফল করুন: ইমরান খান

যে কোনো মূল্যে লাহোর কর্মসূচি সফল করুন: ইমরান খান

চৌদ্দগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় সিএনজি চালকসহ নিহত ২

চৌদ্দগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় সিএনজি চালকসহ নিহত ২

যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত ভবনে বিচারককে গুলি করে হত্যা

যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত ভবনে বিচারককে গুলি করে হত্যা

ডিবির সাবেক ডিসি ৭ দিনের রিমান্ডে দলীয় বিবেচনায় শুদ্ধাচার পুরস্কার পান মশিউর

ডিবির সাবেক ডিসি ৭ দিনের রিমান্ডে দলীয় বিবেচনায় শুদ্ধাচার পুরস্কার পান মশিউর

খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে সংঘর্ষ: তিন জেলার মানুষকে শান্ত থাকার আহ্বান সরকারের

খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে সংঘর্ষ: তিন জেলার মানুষকে শান্ত থাকার আহ্বান সরকারের

গরমে যেন শেষ সিলেট !

গরমে যেন শেষ সিলেট !

গল টেস্টে ঘুরে দাঁড়িয়েছে শ্রীলঙ্কা

গল টেস্টে ঘুরে দাঁড়িয়েছে শ্রীলঙ্কা

প্রেতাত্মাদের উসকে দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন হাসিনা

প্রেতাত্মাদের উসকে দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন হাসিনা

ময়মনসিংহে অস্ত্রসহ ডাকাত দলের ছয় সদস্য গ্রেপ্তার

ময়মনসিংহে অস্ত্রসহ ডাকাত দলের ছয় সদস্য গ্রেপ্তার

খাগড়াছড়িতে হামলা, প্রতিবাদে ইবির আদিবাসী শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন

খাগড়াছড়িতে হামলা, প্রতিবাদে ইবির আদিবাসী শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন

সুনামগঞ্জে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নানকে জেলহাজতে প্রেরণ

সুনামগঞ্জে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নানকে জেলহাজতে প্রেরণ

কালীগঞ্জে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আয়ূব হোসেন আটক

কালীগঞ্জে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আয়ূব হোসেন আটক

হাবিপ্রবিতে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে ভিসি নিয়োগের দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন

হাবিপ্রবিতে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে ভিসি নিয়োগের দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন

ফ্যাসিবাদী দোসর মিডিয়া লীগে সংস্কার জরুরী

ফ্যাসিবাদী দোসর মিডিয়া লীগে সংস্কার জরুরী

যৌথবাহিনীর হাতে সিলেট আটক বিপুল পরিমান ভারতীয় পণ্য

যৌথবাহিনীর হাতে সিলেট আটক বিপুল পরিমান ভারতীয় পণ্য

পরাজিত শক্তি এবং সুবিধাবাদীরা সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টিতে লিপ্ত- বিমানবন্দরে সংবর্ধনা কালে যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা মুশাহীদ

পরাজিত শক্তি এবং সুবিধাবাদীরা সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টিতে লিপ্ত- বিমানবন্দরে সংবর্ধনা কালে যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা মুশাহীদ

নোয়াখালীতে জামায়াতের কর্মী সমাবেশে নেতৃবৃন্দ ‘জুলুম-নির্যাতন করে আস্তাকুঁড়ে চলে গেছেন কাদের মির্জা’

নোয়াখালীতে জামায়াতের কর্মী সমাবেশে নেতৃবৃন্দ ‘জুলুম-নির্যাতন করে আস্তাকুঁড়ে চলে গেছেন কাদের মির্জা’

পুলিশের সামনে হামলা বিএনপি ও যুবদল নেতা আহত

পুলিশের সামনে হামলা বিএনপি ও যুবদল নেতা আহত