টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের দাবি ভারতের, প্রতিবাদের ঝড়
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:৪৭ পিএম | আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:৪৭ পিএম
বাংলাদেশের বিখ্যাত টাঙ্গাইলের শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য বলে দাবি করেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। বৃহস্পতিবার (০১ ফেব্রুয়ারি) দেশটির সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের ভেরিফায়েড পেজ থেকে করা একটি পোস্টে এমন দাবি করা হলে সর্বত্র তোলপাড় শুরু হয়।
ওই পোস্টের নিচেই প্রতিবাদের ঝড় তোলেন নেটিজেনরা। এছাড়া ফেসবুকে স্ক্রিনশট শেয়ার করে প্রতিবাদে সরব হয়েছেন দেশ প্রেমিক জনতা। গেল কিছু দিন ধরে ‘ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইন’ এর মাঝে যেন নতুন মাত্রা যোগ করলো ঘটনাটি।
সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত ওই পোস্টে দাবি করা হয়েছে, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি, পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত, একটি ঐতিহ্যগত হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর সূক্ষ্ম গঠন, স্পন্দনশীল রং এবং জটিল জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত—এটি এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।’
প্রসঙ্গত, টাঙ্গাইল তাঁতশিল্প বাংলাদেশের অন্যতম পুরোনো কুটিরশিল্প। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। ঐতিহ্যবাহী এই শাড়ি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলায় তৈরি হয় বলে এর নামকরণও করা হয়েছে জেলার নামেই।
বর্তমানে টাঙ্গাইল শাড়ির নামে এখনও কোনও জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশনস) পেটেন্ট আন্তর্জাতিক স্তরে নথিভুক্ত হয়নি। ফলে কলকাতার ব্যবসায়ীরা এর সুযোগ নিয়ে টাঙ্গাইল শাড়িকে ফুলিয়ার পণ্য বলে চালিয়ে আসছে আরও আগে থেকেই।
এনিয়ে জেষ্ঠ্য সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক মেহেদী হাসান পলাশ প্রতিবাদ জানিয়ে এক পোস্টে লিখেছেন, ছোটবেলায় দেখতাম, মোটা পাড়ের টাঙ্গাইল সুতি শাড়ি পরতো। এরপর আসলো ভারতের প্রিন্ট শাড়ি। অপেক্ষাকৃত পাতলা, দামে সস্তা ও আকর্ষণীয় ডিজাইনের কারণে ভারতীয় প্রিন্টের সুতির শাড়ি বাংলাদেশের বাজার ছেয়ে গেল। এটা এতটাই জনপ্রিয় হল এবং বাজার দখল করল যে একের পর এক বাংলাদেশের ট্র্যাডিশনাল তাঁত কলগুলো বন্ধ হতে শুরু করলো। এসময় কিছু মানুষ ট্রাডিশনাল তাঁত কলে উৎপাদিত মোটা তাঁতের শাড়িতে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে রং, সুতা ও ডিজাইনে নতুনত্ব নিয়ে আসে। ফলে আবার প্রাণ ফিরে আসে বাংলার ঐতিহ্যবাহী তাঁতের শাড়িতে। গ্রামের পাশাপাশি শহুরে নারীদের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই শাড়ি। ফলে ভারতীয় শাড়ি আবার মার খায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী তাঁতের শাড়ির কাছে। এমনকি বাংলাদেশ ছাড়িয়ে ভারতীয় বাজার তৈরি হয় টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। নামের সাথেই এর অরিজিন বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না। কিন্তু এখন ভারত দাবী করছে, সেটি ভারত থেকে এসেছে। আফসোস!
এই তাঁতের শাড়ি নাকি এখন ভারতের পণ্য। এ দুঃখ কোথায় রাখি। দাবি না করাই যেমন বাংলাদেশের তালপট্টি দ্বীপ ভারতের অংশ হয়ে গিয়েছে ঠিক তেমনি টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িও ভারতের পণ্যে পরিণত হয়েছে। কবে জানি টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, বগুড়ার দই, কুমিল্লার রসমালাই, মুক্তাগাছার মন্ডা, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, সিলেটের শীতলপাটির মতো পণ্য ভারতের হয়ে যায়। ডরে বাংলাদেশের নাম নিলাম না ।
আরো আফসোস এ কারণে যে এ নিয়ে দেশে কোন উচ্চবাচ্য নেই। টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের ঐতিহ্য, বাংলাদেশের সংস্কৃতি, বাংলাদেশের ইতিহাস ও কৃষ্টির সাথে জড়িত। তবুও এই দেশের সংস্কৃতি সেবীরা, সুশীল সমাজের লোকেরা, প্রগতিশীলেরা, চেতনাধারীরা, তাঁতি লীগ, তাঁতি দল- সবাই নিরব। অবশ্য এদের সবাইকে সরব হতে দেখতাম যদি এই জিআই মেরিট পাকিস্তান দাবি করত। এতক্ষণ দেশে কী তুলকালাম হত ভাবা কঠিন।
ভারতের এমন দাবির প্রতিক্রিয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে মৃণাল ঘোষ লিখেছেন, কিংকর্তব্যবিমূঢ়! টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বলে ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজে দাবী করা হয়েছে! কি আশ্চর্য! কত বড় মিথ্যাচার!
ভাগ্যিস তারা টাঙ্গাইলকে পশ্চিমবঙ্গের অংশ দাবী করেনি।বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশকে কি ধন্যবাদ জানানো উচিত না প্রতিবাদ জানানো উচিত!?
আয়ুব সিদ্দিকি লিখেছেন, এভাবে জিআই স্বত্ব ছেড়ে দেয়াটা আমাদেরই সমস্যা। টাঙ্গাইল শাড়ি নিলো এবার। এর আগে রসগোল্লা, ফজলি আম, নারকেলের মোয়া, নকশিকাঁথার জিআই স্বত্ব নিয়ে গেছে ভারত। জামদানী এ দেশের হলেও বলা হয় ভারতের। আর সুন্দরবনের মধুর জিআই স্বত্ব তো আরো আগের ব্যাপার। ইলিশ মাছ তো এমনেই যায় কয়েকদিন পর বলা হবে ভারতেরই পন্য ইলিশ। বাংলাদেশ কখনই এসব স্বীকৃতি নিয়ে সিরিয়াস ছিল না, এখনো নাই, কবে হবে জানা নেই। বিশ্ব জানবে এসবের অরিজিন ভারত, পশ্চিম বাংলা। বাংলাদেশ আবার কোন দেশ?
মুইদ হাসান তরিৎ লিখেছেন, টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের, টাঙ্গাইল বাংলাদেশের একটি জেলা। টাঙ্গাইলে আমার জন্ম। আমার দাদি নানি কিংবা তাদের আগের প্রজন্মের মেয়েরা এই শাড়ি পড়েই বড় হয়েছে। আমরা নিজেরাও এর নির্মাণ সাক্ষী। এক দেশের ঐতিহ্য নিজের দেশের নামে চালাবেন না। পারলে নিজেরা কলিকাতা শাড়ি তৈরি করুন।
আলী আকবরের মন্তব্য, এটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফল। টাঙ্গাইলের শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের বলার মধ্যে অন্য কিছু লুকিয়ে আছে। অবশ্য বাংলাদেশ সার্বভৌম দেশ। সুতরাং এসব পায়তারা কোন কাজে দেবে না। টাঙ্গাইলের জামদানী পশ্চিমবঙ্গের এটা সত্যই বলেছেন। ওপারের বঙ্গ তো আমাদেরই ছিলো। অন্যায়ভাবে নিয়েছো তখন। সকল অন্যায়ের জবাব একদিন ফিরিয়ে দেবে এদেশের জনগণ।
মৈত্রী বড়াই লিখেছেন, ছিঃ!!! খুবই দুঃখজনক। টাঙ্গাইল শাড়ির আদি উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলায়। এ শাড়ির নাম অনুসারেই এ জেলার নামকরণ করা হয়। ৪৭ এর দেশ বিভাগের পর এই অঞ্চলের অনেক সনাতন ধর্মের তাঁতী ভারতের নদীয়া ও পূর্ব বর্ধমান জেলায় চলে যায়। বাপ দাদার কাছ থেকে শিখে আসা কাজ নদীয়ায় শুরু করেন তারা। একই ভাবে তৈরি করেন টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি টাঙ্গাইল শাড়ি।
উল্লেখ্য, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে তৎকালীন ভারতবর্ষের টাঙ্গাইলে তাঁত শিল্পের ব্যাপ্তি প্রসারিত হয়। টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতিরা মূলত ঐতিহ্যবাহী মসলিন তাঁত শিল্পীদের বংশধর। তাদের আদি নিবাস ছিল বর্তমান ঢাকা জেলার ধামরাই ও চৌহাট্টায়। তারা দেলদুয়ার, সন্তোষ ও ঘ্রিন্দা এলাকার জমিদারদের আমন্ত্রণে টাঙ্গাইল যায় এবং পরবর্তীতে সেখানে বসবাস শুরু করে।
শুরুতে তারা নকশাবিহীন কাপড় তৈরি করা হলেও ১৯০৬ সালে মহাত্মা গান্ধী স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তৎকালীন পূর্ব বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) এর তাঁত শিল্পের প্রসার লাভ করে। এরপর ১৯২৩-২৪ সালে তাঁতের কাপড়ে নকশা প্রবর্তন করা হয়। ১৯৩১-৩২ সালে শাড়ি তৈরির জন্য জাকুয়ার্ড তাঁত প্রবর্তন করা হয়।
টাঙ্গাইল তাঁতশিল্প এর একক বৈশিষ্ট্যের জন্য বিশ্বজুড়ে সমাদ্ধৃত। টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতিরা বিশেষ দক্ষতার মাধ্যম এ শাড়ি তৈরি করেন। জেলার পাটাইল ইউনিয়নের বসাক সম্প্রদায় সব থেকে পুরোনো সম্প্রদায় যারা এখনও আদি ও ঐতিহ্যগতভাবে সাথে তাঁতের শাড়ি তৈরি করেন। এই শাড়ি তারা বাজিতপুর ও করটিয়া হাটে সপ্তাহে দুই দিন বিক্রি করেন।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ধর্ম যার যার, নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার সবার: তারেক রহমান
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া কাম্য নয় : ইউট্যাব
আগামী সংসদে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের দাবি চরমোনাই পীরের
কোন শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী, চাঁদাবাজ, দখলবাজ ও অনুপ্রবেশকারীর দলে জায়গা হবে না-কেন্দ্রীয় যুব দলের সাধারণ সম্পাদক নুরল ইসলাম নয়ন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাবিতে সমাবেশ
বিগত ৫৩ বছরের জঞ্জাল দূর করে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি
তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আটক ছয়জনের পাঁচজনই ছাত্রলীগের
রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে নিহত ১, থমথমে পরিস্থিতিতে ১৪৪ ধারা জারি, ৭২ ঘন্টার অবরোধের ডাক
বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনো বিপদমুক্ত নয় : তারেক রহমান
নিরাপদ ও নির্ভয়ে উদযাপন হবে শারদীয় দূর্গোদসব এবং দূর্গাপূজা- এসএমপি কমিশনার রেজাউল করিম
মব কিলিং সরকার সমর্থন করে না: উপদেষ্টা নাহিদ
চট্টগ্রামে রাতের আঁধারে বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুর
বলিউডে কারিনা কাপুরের ২৫ বছর
মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে ঢাবি কর্তৃপক্ষ
রাজশাহীতে ট্রেনে বরযাত্রীদের ওপর হামলা
চিহ্নিত গোষ্ঠী আবার দখলদারি ও চাঁদাবাজি শুরু করেছে : সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম চরমোনাই
গায়িকা রুকসানার রহস্যজনক মৃত্যু!
যে কোনো মূল্যে লাহোর কর্মসূচি সফল করুন: ইমরান খান
চৌদ্দগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় সিএনজি চালকসহ নিহত ২
যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত ভবনে বিচারককে গুলি করে হত্যা