‘শোষণমুক্ত জগত গড়ার অঙ্গীকার তার কবিতার ছত্রে ছত্রে স্বতন্ত্র আঙ্গিকশোভায় ভাস্বর’
০২ জুলাই ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ০৮:১৬ এএম
একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি অসীম সাহা সম্প্রতি পরলোকগমন করেন। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে তিনি একটি সুপরিচিত নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহপাঠী হয়েও তার মধ্যে অহংকার-অহমিকা দেখা যায়নি। তার ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারণ। তবে চলতেন একদম সাদাসিধে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গেও তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল অসামান্য। আর এসব সম্ভব হয়েছে তার অসাধারণ সাহিত্যকর্মের কারণে।
সোমবার (১ জুলাই) বাংলা একাডেমিতে বরেণ্য কবি ও বাংলা একাডেমির ফেলো অসীম সাহার স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা কবি কামাল চৌধুরী বলেছেন, অসীম সাহা ছিলেন খাপ না খাওয়া মানুষ। সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি স্বচ্ছন্দ বিচরণ করেছেন। তিনি নিজ বিশ্বাস ও অনুভবের কথা কবিতায় তো বটেই, ব্যক্তিগত উচ্চারণ ও আচরণেও সরাসরি প্রকাশ করতেন।
ড. কামাল নাসের চৌধুরী বলেন, অসীম সাহার লেখনিতে তার সারল্য ও দৃঢ়তা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি (অসীম সাহা) বাংলা কবিতার ধ্রুপদী ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে কবিতায় নিজস্ব মুদ্রা তৈরি করেছেন। স্মরণসভায় স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। তিনি বলেন, অসীম সাহা ছিলেন সমকালীন বাংলা কবিতার তাৎপর্যপূর্ণ কারুকৃৎ। ব্যক্তি মানুষের আর্তি থেকে সমষ্টি মানুষের আর্তনাদ, মুক্তিকামী মেহনতি মানুষের লড়াকু অভিলাষ এবং শোষণমুক্ত জগত গড়ার অঙ্গীকার তার কবিতার ছত্রে ছত্রে স্বতন্ত্র আঙ্গিকশোভায় ভাস্বর হয়েছে।
স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির বরেণ্য চিত্রশিল্পী হাশেম খান। কবি অসীম সাহাকে বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, তিনি কবিতায় যেমন আমাদের মুগ্ধ করেছেন তেমনি তার অনন্য জীবনসাধনায়ও সবাইকে আকৃষ্ট করেছেন। তার সৃষ্টিকে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বাংলা একাডেমির পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. শাহাদাৎ হোসেন নিপুর সঞ্চালনা স্মরণসভা আরও বক্তব্য দেন কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, ড. দিলারা হাফিজ, কবি ফারুক মাহমুদ, কবি আসাদ মান্নান, কবি ইউসুফ রেজা, রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুভাষ সিংহ রায়, প্রকাশক খান মাহবুব, বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. হাসান কবীর ও ড. তপন বাগচী, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রাজীব কুমার সরকার এবং কবি পিয়াস মজিদ।
গত ১৮ জুন বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে অসীমের পথে পাড়ি জমান আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অনন্যসাধারণ প্রতিভা কবি অসীম সাহা। কবি অসীম সাহা পারকিনসন (হাতকাঁপা রোগ), কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। তার স্ত্রী অঞ্জনা সাহাও একজন ভালো মানের কবি। স্ত্রীর কাব্যপ্রতিভার স্ফুরণে অসীম সাহার অবদান ছিল। এছাড়া কবির সংস্পর্শে এসে বাংলা ভাষা, বানান, উচ্চারণ, বাক্যগঠন ও শব্দের বহুমাত্রিক ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করেছেন অসংখ্য অনুজপ্রতীম সহকর্মী। তাদের হৃদয়ে কবি অসীম সাহা বেঁচে থাকবেন সুদীর্ঘ সময় ধরে।
মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৭৫ বছর। তাঁর মৃত্যুতে সাহিত্যাঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। শোক জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খানসহ মন্ত্রিসভার সদস্য, কবি-সাহিত্যিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। ১৯ জুন সকালে শেষবারের মতো কবির নিথর দেহ আনা হয় তাঁর প্রিয় প্রাঙ্গণ বাংলা একাডেমিতে। সেখানে কফিনে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে কবিকে শেষবিদায় জানায় সাহিত্যাঙ্গনের মানুষসহ সর্বস্তরের জনগণ। বেলা ১১টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিমঘর থেকে কবির মরদেহ বাংলা একাডেমিতে আনা হয় এবং রাখা হয় ১২টা পর্যন্ত। এরপর কবির লাশ দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে। কবি তাঁর দেহ মৃত্যুর আগেই এ শিক্ষায়তনকে দান করেছেন।
১৯৪৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনায় মামাবাড়িতে অসীম সাহার জন্ম। তার পৈতৃক নিবাস মাদারীপুর। তাঁর বাবা অখিল বন্ধু সাহা, মা প্রভা রানী সাহা। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তাঁর পিতৃপুরুষের ভিটে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা গ্রামে। তবে বাবার চাকরিসূত্রে মাদারীপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু। তার বাবা অখিল বন্ধু সাহা ছিলেন অধ্যাপক। অসীম সাহা ১৯৬৫ সালে মাধ্যমিক পাস করেন এবং ১৯৬৭ সালে মাদারীপুর নাজিমুদ্দিন মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৯ সালে স্নাতক পাস করে তিনি ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে লেখাপড়া করেন।১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে তার স্নাতকোত্তর পরীক্ষা পিছিয়ে যায় এবং তিনি ১৯৭৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
তাঁর লেখালেখি-জীবনের শুরু ১৯৬৪ সালে। ১৯৬৫ সালে জাতীয় দৈনিকে লেখা ছাপার মধ্য দিয়ে তাঁর লেখালেখির বিকাশ ঘটে। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছড়া, কিশোর কবিতা সাহিত্যের সব শাখায়ই রেখেছেন নান্দনিকতার ছাপ। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩৫। লেখালেখির পাশাপাশি ৪৮ বছর ধরে তিনি দেশের মূলধারার পত্রিকাগুলোয় সাংবাদিকতাও করছিলেন।
সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, কবিতালাপ পুরস্কার, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পুরস্কার, রূপসী বাংলা পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ), কলকাতা আন্তর্জাতিক লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার, আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু স্মারক পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার। তিনি একদা ছিলেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক। তাঁকে ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৯ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন।
অক্টাভিও পাস ও ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা (অনুবাদ ২০১১), কবর খুঁড়ছে ইমাম (২০১১), প্রেমপদাবলি (২০১১), পুরনো দিনের ঘাসফুল (২০১২) (কবিতা), প্রগতিশীল সাহিত্যের ধারা (১৯৭৬), অগ্নিপুরুষ ডিরোজিও (১৯৯০), উদাসীন দিন (উপন্যাস) (১৯৯২), শ্মশানঘাটের মাটির গল্প (১৯৯৫), কিলের চোটে কাঁঠাল পাকে (২০০২), শেয়ালের ডিগবাজি (২০০৭), হেনরি ডিরোজিও (২০১০) ইত্যাদি। কবি অসীম সাহার স্মৃতি রক্ষায় তার কবিতাসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার রচনাবলীর ব্যাপক প্রচার, বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তকে সন্নিবেশিত করে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর দাবি করেছেন কবির সহকর্মী, প্রকাশক ও কবি মাহবুবা লাকী।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
কুষ্টিয়ায় প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলাচল করছে বালুভর্তি ড্রামট্রাক
আমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ২ কোটি টাকা মূল্যের ১৬টি দোকান পুড়ে ছাই
ঘোড়াঘাটে সিসি ক্যামেরার সামনে থেকে দিনের বেলায় মোটরসাইকেল চুরি
ট্রাম্পের জন্য জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব আইন পরিবর্তন কঠিন হতে পারে
লেবাননের নতুন নেতৃত্বে হিজবুল্লাহর প্রভাব কি হ্রাস পাচ্ছে?
টিকটককে ৭৫ দিন সময় দিলেন ট্রাম্প
আদানি পুত্রের বিয়েতে আসছেন টেইলর সুইফট!
বেনজীরের সাভানা ইকো রিসোর্টে এনবিআরের অভিযান, মিলেছে বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকির প্রমাণ
৭ দিনের মধ্যে প্রত্যাহার হবে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা: আইন উপদেষ্টা
পঞ্চগড়ে তারুণ্যের উৎসবে বিনামুল্যে চক্ষু শিবির
আগামীকাল নেত্রকোণা জেলা যুবদলের সভাপতি মরহুম আল আমিন খান পাঠানের মৃত্যুবার্ষিকী
তুরস্কের হোটেলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত ১০, আহত আরও ৩২
কাল উত্তরায় আসছেন ধর্ম উপদেষ্টা ২ দিনব্যাপী ওয়াজ মাহফিল ও হালকায়ে জিকির শুরু কাল
কুলাউড়া উপজেলা ও পৌর বিএনপির আহবায়ক কমিটি ঘোষণা
জয়পুরহাট সীমান্তে বিএসএফের বেড়া, বিজিবির বাধায় কাজ বন্ধ
অনির্বাচিত সরকারের চেয়ে নির্বাচিত সরকার ভালো : মির্জা ফখরুল
ধরা পড়েননি পালানো ওসি, ‘সম্ভবত’ ইন্ডিয়া চলে গেছেন: ডিএমপি কমিশনার
কলাপাড়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্ক্র্যাপ চুরির মামলায় শ্রমিক দলের সভাপতি জেল হাজতে
জয়পুরহাট সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের চেস্টাকালে বিজিবির বাধায় বন্ধ
প্যারিসে অনুষ্ঠিত হলো গহরপুর ওয়েলফেয়ার সোসাইটি ইন ফ্রান্সের পরিচিতি সভা