মাদারীপুরের একাধিক যুবক মাফিয়াদের কাছে জিম্মি
০৫ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম | আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
মুক্তিপণ দিয়েও মিলছে না মুক্তি
স্বপ্ন ছোঁয়ার আশায় অনেকেই পাড়ি জমাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। তবে তাদের অনেকের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। ইউরোপ নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়া ও তিউনেশিয়ার বিভিন্ন বন্দি শিবিরে আটকে চালানো হয় নির্যাতন। এরপর লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করা হয়। তবুও অনেকের মুক্তি মিলে না। তবে জেলা পুলিশ বলছে মামলা হলেও দালালদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে আইনগত ব্যবস্থা।
সরেজমিন জানা গেছে, মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম এলাকার শুভ বাগচি (২২)। ৮ মাস আগে ভাগ্য বদলের আসায় পাড়ি জমিয়েছিল ইটালির উদ্দেশ্যে। বর্তমানের পরিবারের সাথে যোগাযোগ নেই। বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তাও জানে না পরিবারের লোকজন। একই গ্রামের রবিন মল্লিক ৫ মাস আগে ইটালি যাওয়ার জন্য বাড়ি ছাড়ে। কিন্তু তারও কোনো সন্ধান নেই। কালকিনি উপজেলার পূর্ব আলীপুর গ্রামের জুবায়ের হাওলাদারকে ইউরোপে নেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আটকে রাখা হয়েছে তিউনেশিয়ায়। দফায় দফায় নির্যাতন করে আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা। শুধু শুভ, রবিন, জুবায়েরই নয়। লিবিয়া ও তিউনেশিয়ার বিভিন্ন বন্দি শিবিরে আটক রয়েছে শতশত বাংলাদেশি। তিউনেশিয়ার একটি বন্দি শিবিরে রয়েছে আরো অর্ধশত বাংলাদেশি। মাদারীপুরের পূর্ব আলীপুর গ্রামের জুবায়েরসহ বন্দিরা মুক্তির আকুতি জানিয়ে এই প্রতিবেদকের কাছে একটি ভিডিও পাঠিয়েছেন। সেই বন্দিরা নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন।
ভিডিও বার্তায় মো. ইয়াকুব নামে এক বন্দি ব্যক্তি জানান, তার বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলায়। তাকে ১০ লাখ টাকায় ইটালি নেয়ার প্রলোভন দেখায়। প্রলোভনে পড়লে তাকে ভিজিট ভিসায় নাইজার হয়ে ইটালি নেয়ার মৌখিক চুক্তি করে। প্রথমে দুবাই তারপর ইথিওপিয়া তারপর নাইজার নেয়। এ পর্যন্ত বিমানেই নেয়া হয়। এরপর তিনদিন সড়কপথে সেখান থেকে মরুভ‚মি পাড় হয়ে আলজেরিয়া নেয়। সেখানে আলজেরিয়ান পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এরপর এক মাস জেলখাটে ইয়াকুব। জেলের ভেতরেও অমানবিক নির্যাতের শিকার হন। আলজেরিয়া আসার জেল থেকে মুক্তি পেলে দালালচক্র আরো ৫ লাখ টাকা নেয়। এরপর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাদের তিউনেশিয়া নেয়া হয়। এরপর সেখানে বসেই তাদের টাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করে আরো ৫ লাখ টাকা আদায় করা হয়। তালাবদ্ধ একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। সেখানে ঠিকমতো খাবার দেয়া হতো না। তাদের সাথে ৩৪ জনের একটি দল ছিলো বলে জানান ইয়াকুব।
তিনি ভিডিও বার্তায় দাবি করেন, ভিজিট ভিসায় নেয়ার কথা থাকলেও তিউনেশিয়া থেকে তাদের অবৈধভাবে সাগরপথে বোটে করে ইটালি নেয়ার প্রস্তাব করে এবং আরো ৭ লাখ টাকা দাবি করেন। অবৈধপথে যেতে এবং টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। তাদের বিড়ির আগুন দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থান ঝলসে দেয়। আঙ্গুলের নখ টেলে তুলে ফেলে। আঙ্গুলের মাথা কেটে ফেলা হয়। এই নির্যাতের সাথে জাহিদ, হোসেন, সাইফুল, মফিজ নামে বাংলাদেশি দালাল জড়িত। এদের মধ্যে মফিজের বাড়ি মাদারীপুর। মফিজই সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করে বলেও জানান তিনি।
ভিডিও বার্তায় নির্যাতেন শিকার মাদারীপুরের আলীপুরের বাসিন্দা জুবায়ের হাওলাদার বলেন, এই দেখেন আমারে বিড়ির আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলেছে। এসময় ভিডিওতে নির্যাতনের ক্ষত দেখানো হয়। তিনি সরকারের কাছে বন্দি থেকে মুক্তি পেতে আকুতি জানিয়েছেন। নির্যাতনের শিকার ইয়াকুব বলেন, আমার সর্বশেষ সম্বল ২ শতাংশ জমি ছিলো। সেটা বিক্রি করে ওদের টাকা দিয়েছি। এখন আমার বউ বাচ্চা শ্বশুড় বাড়ি থাকে। বসবাসের ভিটাটুকুও নেই। দফায় দফায় নির্যাতন করে ১৭ লাখ টাকা আদায়। এরমধ্যে আমরা আলজেরিয়া ও তিউনেশিয়ার জেলে ৬৪ দিন ছিলাম। সেখানে থেকে ছাড়া পেয়ে আমরা দালাল মফিজের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আমাদের কাছে আরো ৭ লাখ টাকা দাবি করেন। আমরা এতো টাকা কোথায় পাবো? দালালরা ইটালি নেয়ার নাম করে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে নেয়। এরপর নির্যাতন করতো বলেও জানান তিনি।
ভিডিও বার্তায় তিনি আরো বলেন, দালাল জাহিদ, হোসেন, সাইফুল, মফিজ হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আদায় করে। তাদের পক্ষ থেকে তাদের পরিবারের লোকজন টাকা গ্রহণ করে থাকে। তিনি এসময় সরকারের কাছে দালালদের বিচার দাবি করেন এবং দালালদের স্বজনদেরও বিচারের আওতায় আনার দাবি করেন।
তিনি বলেন, দালালরা যেহেতু দেশের বাইরে তাদের ধরা যাচ্ছে না। তবে দালালদের পক্ষ হয়ে যারা টাকা গ্রহণ করছে তাদের ধরা হোক। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হোক। শুধু শুভ, রবিন, জুবায়ের নয়। অবৈধপথে ইতালি যাবার সময় লিবিয়া, তিউনেশিয়া, দুবাই, আলজেরিয়া, মরক্ক, নাইজেরিয়া তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে বন্দি রয়েছে শতশত বাংলাদেশি। তবে কতজন বন্দি আছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান স্থানীয় প্রশাসনের কাছে নেই। স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, লিবিয়ার মাফিয়াদের হাতে জিম্মি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম এলাকার অর্ধশত যুবক। তাদের নির্যাতন করে দালালরা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। ভিটেমাটি বিক্রি করে টাকা দিয়েও মিলছে না মুক্তি।
শুধু আমগ্রাম নয় মাদারীপুর সদর উপজেলার বালিয়া গ্রামের মতলেব ফকিরের ছেরে শাকিব ফকির, বাদশা হাওলাদারের ছেলে হাসান হাওলাদার, সালাম হাওলাদারের ছেলে নুর আলম হাওলাদার, জব্বার হাওলাদারের ছেলে বেল্লাল হাওলাদার, মোক্তার মোল্লার ছেলে জসিম মোল্লা, এনামুল হাওলাদারের ছেলে নয়ন হাওলাদার, সামচু সরদারের ছেলে হৃদয় সরদার, সেকেনদার আলী সরদারের ছেলে সাইফুল সরদার, গোলাম ফারুক সরদারের ছেলে মোস্তাফিজুর সরদার, আমির লাল ফকিরের ছেলে শাহীন ফকির, দুলাল মোল্লার ছেলে আরমান মোল্লাসহ অর্ধশত যুবক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার পাঁচখোলা গ্রামে স্বপন কয়েক মাস আগে ভাগ্য ফেরাতে অবৈধপথে ইতালি যাবার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়েন। লিবিয়া পৌঁছে ধরা পড়েন মাফিয়াদের হাতে। মুক্তিপণ হিসেবে মাফিয়ারা দাবি করেন ৩০ লাখ টাকা। স্বামীকে বাঁচাতে ভিটেমাটি বিক্রি করে দফায় দফায় ২০ লাখ টাকা এনে তুলে দেন দেলোয়ার সরদার নামে এক দালালদের হাতে। তবে দেশে ফেরা এখনও অনিশ্চিত স্বপনের।
স্বজনদের অভিযোগ, প্রলোভন দেখিয়ে রাজৈরের আমগ্রাম এলাকার আরিফ ও মমরাজ বেপারী নামে দুই দালাল বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
মাফিয়াদের হাতে জিম্মি শুভ বাগচীর মামা অপূর্ব বৈদ্য বলেন, ‘ধাপে ধাপে দালাল মমরাজ বেপারী ২২ লাখ টাকা নিয়েছে। জমি বিক্রি করে টাকা দিয়েছি। এখন আর টাকা দেয়ার উপায় নেই। আমার ভাগনে এক সপ্তাহ ধরে কেমন আছে, তাও জানি না।’
লিবিয়ায় বন্দি রবিনের মা বলেন, ‘আমার ছেলেকে মাফিয়ারা জিম্মি করে রেখেছে। তারা বিভিন্ন কৌশলে লাখ লাখ টাকা নিয়েছে। মারতে মারতে শরীরে পচন ধরেছে। কিন্তু আমার ছেলেকে মুক্তি দিচ্ছে না। এজন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।’
বিষয়টি নিয়ে মাদারীপুরের অতিরিক্তি পুলিশ সুপার ও জেলা পুলিশের মুখপাত্র কামরুল ইসলাম বলেন, ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের ফেরত আনার বিষয় সংশ্লিষ্ট দূতাবাসে পত্র প্রেরণ করা হবে।’
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেন ট্রাম্প
ভোটের অধিকার রক্ষায় জনপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে : সিইসি
অস্ত্র মামলায় মামুন খালাস
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে আলোচনা সভা
ইনু-মেনন-সালমান-আনিসদের রিমান্ড, নতুন করে গ্রেপ্তার মন্ত্রী-এমপিসহ ১৬ জন
দলীয় নেতাদের একযোগে কাজ করার আহ্বান এবি পার্টির
হত্যা মামলায় মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ৫ দিনের রিমান্ডে
হজ ও ওমরাহ যাত্রীদের জন্য বিশেষ নির্দেশনা
আমদানি মূল্য পরিশোধের সময় বাড়াল কেন্দ্রীয় ব্যাংক
বকেয়া পরিশোধে জুন পর্যন্ত সময় বাড়লো আদানি
অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রত্যাহার ব্রিটিশ এমপিদের
দিল্লি ফ্যাসিবাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে : রিজভী
বেক্সিমকোর ১৬টি কারখানার ছাটাইকৃত শ্রমিকদের চাকরি ফিরে পাওয়ার সিদ্ধান্ত ২৭ জানুয়ারি
যুদ্ধবিরতির কয়েক মিনিট আগেও ইসরায়েলের হামলা গাজায় বিলম্বিত সময়ের মধ্যে নিহত ১৯
আমেরিকার স্বর্ণযুগ শুরু হচ্ছে
প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন, সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম
সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের মাঝে ছাত্রদল নেতার শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ
এবার মেডিকেলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় উত্তীর্ণদের ফল স্থগিত
চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এলডিপি মহাসচিবের বৈঠক
সরিষাবাড়ী ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে কম্বল বিতরণ