বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপরে ‘অত্যাচার’- যেসব ভুয়া পোস্ট বিবিসি খুঁজে পেয়েছে
১১ আগস্ট ২০২৪, ০১:০২ পিএম | আপডেট: ১১ আগস্ট ২০২৪, ০১:০২ পিএম
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার পর সহিংসতা চলছিল, এর মধ্যেই বহু ভুয়া পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দাবি করা হয় যে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপরে ব্যাপক অত্যাচার শুরু হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু এবং সেখানে বসবাসকারী ভারতীয়দের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে একটি বিশেষ কমিটি গড়েছে ভারত সরকার। আবার বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় রোববার থেকে হটলাইন চালু করতে চাচ্ছে সরকার।
তবে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরে ‘ব্যাপক অত্যাচার’ হচ্ছে বলে যেসব ভুয়া পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার বেশিরভাগই ভারতীয় বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়েছিল বলে ফ্যাক্ট-চেকাররা নিশ্চিত করেছেন।
কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকেও এধরনের গুজব ছড়ানো হয়েছিল সামাজিক মাধ্যমে, এমনটাও ফ্যাক্ট-চেকাররা বলছেন।
তারা এটাও বলছেন যে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরে কিছু আক্রমণ হয়েছে, বাড়িঘর জ্বালানো হয়েছে। কিন্তু তথ্য যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেছে মুসলমানদের বাড়িঘরও ভাঙচুর করা হয়েছে, জ্বালানো হয়েছে।
এক্ষেত্রে আক্রমণকারীদের লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর, সম্পত্তি। ধর্মীয় পরিচয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গৌণ ছিল, তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের জন্যই তারা আক্রান্ত হয়েছেন।
বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগের যেসব স্থানীয় নেতাকর্মী পালিয়ে ভারতে চলে গেছে অথবা আসার চেষ্টা করছে, তারাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যে হিন্দু আর মুসলমান- উভয় সম্প্রদায়ের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িতেই হামলা হয়েছে।
কিন্তু ভারত থেকে সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টিকে রাজনৈতিক না রেখে সাম্প্রদায়িক রঙ দেয়া হয়েছে বলে মনে করছেন একাধিক ফ্যাক্ট চেকার।
অন্যদিকে, থানাগুলিতে আক্রমণ হওয়ার ফলে পুলিশ ছিল না পুরো বাংলাদেশেই। এই সময়েই সাবেক ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়ি-ঘরে লুট চলে, সহিংসতা শুরু হয়।
তবে বাস্তবে দেখা গেছে, যে সাধারণ নাগরিকদের বাড়িতেও লুট চলেছে, তাদেরও কেউ কেউ সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
চারদিকে যখন একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি চলছিল, সেই সময়ে ভারতের অতি-দক্ষিণ-পন্থী ‘ইনফ্লুয়েন্সর’রা সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভ্রান্তিকর ভিডিও শেয়ার করতে থাকেন, যাতে মনে হয় যে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরে অত্যাচার হচ্ছে।
এ ছাড়া এরকম গুজবও ছড়ানো হয় যে ছাত্র-বিক্ষোভকারীরা ‘ইসলামি কট্টরপন্থী’।
সামাজিক মাধ্যমের ওপরে নজর রাখে ‘ব্র্যান্ডওয়াচ’ অ্যাপ। তারা খুঁজে পেয়েছে যে ৪ আগস্টের পর থেকে ভুয়া কাহিনীগুলো ছড়ানো হয়েছে এমন একটি হ্যাশট্যাগ দিয়ে, যেটি সামাজিক মাধ্যম ‘এক্স’-এ (সাবেক টুইটার) সাত লাখ বার মেনশন হয়েছে।
যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে ট্রেন্ডিং পোস্টগুলো করা হয়েছিল, তার প্রায় সবই ভারতে অবস্থান করছে, এমনটাও জানা গেছে ‘ব্র্যাণ্ডওয়াচ’ থেকে।
বাংলাদেশ ভিত্তিক ফ্যাক্ট-চেকাররাও গত কয়েকদিনের সামাজিক মাধ্যম বিশ্লেষণ করে অনেকটা একইরকম তথ্য পেয়েছেন যে মূলত ভারতের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকেই হিন্দুদের ওপরে আক্রমণের ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ বা ইউল্যাবের অনুমোদনপ্রাপ্ত স্বাধীন তথ্য যাচাই করার উদ্যোগ ‘ফ্যাক্ট ওয়াচ’-এর প্রধান, অধ্যাপক সুমন রহমান বলছিলেন, ‘কিছু ঘটনা ঘটেছে ঠিকই, যেখানে হিন্দুদের বাড়ি আক্রমণ করা হয়েছে। তবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই ওই ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত ব্যক্তি।’
‘কিন্তু এমন একটা আখ্যান তৈরি করা হয়েছে, যাতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছে। এটা একেবারেই ভুল আখ্যান ছড়ানো হয়েছে। যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে এই ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগই ভারতের,’ বলেন তিনি।
আবার ঢাকার ‘দৈনিক আজকের পত্রিকার’ ফ্যাক্ট চেকার রিদওয়ানুল ইসলাম বলছিলেন, ভারতীয় অ্যাকাউন্টগুলো থেকেই বেশিরভাগ ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে।
‘তবে বাংলাদেশের ভেতর থেকেও হিন্দুদের ওপরে আক্রমণের ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে বলে আমাদের অনুসন্ধানে জানতে পারছি।’
হিন্দুদের বাড়ি, মন্দির ‘জ্বালানো’র ভুয়া খবর
সামাজিক মাধ্যমে একটা পোস্ট ভাইরাল হয়েছিল, যাতে দাবি করা হয়েছিল যে ‘হিন্দু ক্রিকেটার’ লিটন দাসের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
অন্য অনেক অ্যাকাউন্ট থেকে সেই পোস্ট শেয়ার করে লেখা হয় যে ‘কট্টর ইসলামপন্থীরা তার বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে’।
কিন্তু যে বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছিল, সেটা যে আসলে বাংলাদেশের জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তার্জার, তা এখন সবার জানা।
আরেকটি ভাইরাল হওয়া পোস্টে দাবি করা হয়েছিল যে ‘বাংলাদেশের ইসলামি জনতা’ একটা মন্দিরে আক্রমণ করেছে।
চট্টগ্রামের ‘নবগ্রহ মন্দির’এর কাছে আগুন লাগানোর ভিডিও ছড়ানো হয়েছিল। তবে দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে মন্দিরে আগুন লাগেনি।
বিবিসি ভেরিফাইয়ের কাছে ছবি এসেছে যে ওই মন্দিরের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে ওই মন্দিরের পিছনে আওয়ামী লীগের একটি কার্যালয়ই আসল লক্ষ্য ছিল বলে মনে হয়েছে।
মন্দিরের কর্মকর্তা স্বপন দাস বিবিসিকে জানিয়েছেন, ওই দলীয় কার্যালয় থেকে চেয়ার-টেবিল বার করে আগুন লাগানো হয়েছিল মন্দিরটির পিছন দিকে। এই ঘটনা ৫ আগস্ট দুপুরের।
অগ্নিকাণ্ডের পরের কয়েকটি ছবিতে দেখা গেছে যে আওয়ামী লীগ নেতাদের ছবিসহ বেশ কিছু পোস্টারও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।
তিনি আরো জানিয়েছেন যে ২৪ ঘণ্টাই মন্দিরে পাহারা দিচ্ছেন মানুষ।
লক্ষ্য আওয়ামী লীগ, হিন্দুরা নয়
আরো দু’টি ভাইরাল হওয়া পোস্টে দেখা গেছে যে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে দাবি করা হয়েছে যে হিন্দুদের ওপরে আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু যাচাই করে দেখা গেছে যাদের ওপরে আক্রমণ করা হয়েছিল, তারা আসলে আওয়ামী লীগের নেতা এবং তারা মুসলমান।
এইসব পোস্টই ভারতীয় দক্ষিণ-পন্থী অ্যাকাউন্টগুলো থেকে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ‘সেভ বাংলাদেশী হিন্দু’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে সেসব শেয়ার করা হয় হিন্দুত্ববাদীদের ‘ভেরিফায়েড’ অ্যাকাউন্ট থেকে।
সম্প্রতি আরো একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দাবি করা হয়েছে যে ‘ইসলামি জনতা’ হিন্দুদের গ্রাম আক্রমণ করেছে এবং একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী পুকুরে সাঁতার কেটে পালানোর চেষ্টা করছে। ভারতীয় ফ্যাক্ট-চেকাররাই খুঁজে বার করেছেন যে ওই ব্যক্তি মুসলমান।
ইউল্যাবের ‘ফ্যাক্ট-ওয়াচ’এর প্রধান, অধ্যাপক সুমন রহমান বলছিলেন, ‘সম্প্রতি দুই নারীকে কিডন্যাপের কাহিনী ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। এর মধ্যে একটি ঘটনা ঢাকার, অন্যটি নোয়াখালির। ঢাকার ঘটনাটি হলো একটি ছাত্রী রাস্তায় ট্র্যাফিক ডিউটি করছিল দীর্ঘক্ষণ। তার মা-বাবাই জোরপূর্বক তাকে বাড়ি নিয়ে যান।’
অধ্যাপক রহমান বলেন, ‘সেই ভিডিওকে বলা হলো যে ওই ছাত্রীকে না কি কিডন্যাপ করা হয়েছে। আর নোয়াখালির ঘটনায় যে নারীকে কয়েকজন ‘গণধর্ষণ’-এর জন্য কিডন্যাপ করা হয়েছে বলা হচ্ছে,আসল ঘটনা হলো ওই হিন্দু নারী সাবেক স্বামীর থেকে আলাদা হয়ে নিজের বাবা-মায়ের কাছে থাকছিলেন।
কিন্তু তার স্বামী কয়েকজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে ওই নারীকে উঠিয়ে নিয়ে যান। এটাকে ‘হিন্দু নারীকে গণধর্ষণের জন্য কিডন্যাপ’ বলে চালানো হয়েছে,’ বলছিলেন তিনি।
দৈনিক আজকের পত্রিকার ফ্যাক্ট-চেকার রিদওয়ানুল ইসলামের কথায়, ‘শুধু যে সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়েছে, তা নয়। কয়েকটি টিভি চ্যানেল এবং পোর্টালও সামাজিক মাধ্যমের ওই সব গুজবের ওপরে ভিত্তি করে সংবাদ প্রতিবেদন পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেছে।’
যে কয়েকটি টিভি চ্যানেল এবং পোর্টালর নাম তিনি নিলেন, সেগুলো সবই পরিচিত হিন্দুত্ববাদী সংবাদ মাধ্যম।
বিবিসি এটাও জানতে পেরেছে যে শুধু ভারত বা বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাজ্যের এক পরিচিত অতি-দক্ষিণপন্থী ইনফ্লুয়েন্সারও এই ধরণের গুজব ছড়িয়েছেন।
টমি রবিনসন নামের ওই ইনফ্লুয়েন্সার যাচাই না করা নানা ভিডিও ছড়িয়ে লিখেছেন যে বাংলাদেশে ‘হিন্দুদের গণহত্যা চলছে’।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
চিরিরবন্দরে আগাম জাতের আলুর ভালো ফলন ও দাম পেয়ে কৃষকেরা খুশি
‘রেমিট্যান্স এ্যাওয়ার্ড-২০২৪’ পেল হংকংয়ে বসবাসরত ১০ বাংলাদেশি নারী
বিডিআর বিদ্রোহ : ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের কমিশন গঠন
মার্কিন সিইও হত্যাকাণ্ড, সামাজিক মাধ্যমে ভুল তথ্যের বিপজ্জনক প্রভাব
ঝিনাইদহে বেসিক জার্নালিজম বিষয়ক প্রশিক্ষণ শেষে সনদ বিতরণ
বছরখানেক সময় পেলে সংস্কার কাজগুলো করে যাব : উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
সান্ধ্য আইন বাতিলের দাবি ইবি ছাত্র ইউনিয়নে
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী সরকারের পুনরাবৃত্তি করবে না আশাবাদ রিজভীর
আফগানিস্তানে ফের দূতাবাস চালু করছে সৌদি
হাজারো বিঘা জমিতে পুকুর খনন: ছোট হয়ে যাচ্ছে সালথা-নগরকান্দার মানচিত্র!
প্রতিবাদ সমাবেশ ও স্মারকলিপি প্রদান, সাদপন্থীদের নিষিদ্ধের দাবি
শুধু মুর্শিদাবাদ-মালদহ নয়, শিলিগুড়িও লক্ষ্যবস্তু
হাসিনাকে ফেরত আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন
আসাদের পতন, নিজের বেঁচে থাকার গল্প বললেন এক সিরিয়ান শরণার্থী
গভীর রাতে শীতার্ত মানুষের পাশে বিএনপি নেতা আমিনুল হক
বঙ্গতে আসছে 'ফ্যামিলি ফিউড বাংলাদেশ'
সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ সম্পন্ন
পানামা খাল দখলের হুমকি ট্রাম্পের, ভর্ৎসনা পানামার প্রেসিডেন্টের
কুমিল্লায় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হেনস্তার ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা