জামায়াতের সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব পলাতক ফ্যাসিবাদকে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেবে
১১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৪ এএম
রাষ্ট্র সংস্কারে সেক্টর অনুযায়ী আলাদা আলাদা ১০টি প্রস্তাবনা তুলে ধরেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। গতকাল দুপুরে রাজধানীর গুলশানে হোটেল ওয়েস্টিনে আয়োজিত ‘রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনা’- শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানসহ দলটির সিনিয়র নেতারা।
উক্ত প্রস্তাবনায় জামাত দশটি খাতে মোট ৪১টি প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে। খাতগুলো হলো:
● আইন ও বিচার বিভাগের সংস্কার।
● সংসদ বিষয়ক সংস্কার।
● নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার।
● আইনশৃঙ্খলা সংস্কার।
● জনপ্রশাসন সংস্কার।
● দুর্নীতি।
● সংবিধান সংস্কার।
● শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংস্কার।
● পররাষ্ট্র বিষয়ক সংস্কার ও
● ধর্ম মন্ত্রণালয় সংস্কার।
তবে এই সংস্কার প্রস্তাবে অর্থনৈতিক, কৃষি, শিল্প-বাণিজ্য, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, আইসিটি এবং ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা তথা প্রতিরক্ষা খাত বিষয়ক কোন প্রস্তাবনা জামায়াত রাখেনি। এমনকি বিগত সরকারের আমলে এবং বর্তমান সময়েও জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী সবচেয়ে আলোচিত দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কোনো প্রস্তাব দেয়া হয়নি। এগুলো ইচ্ছাকৃত নাকি ভুল তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে জামায়াতের এই সকল প্রস্তাবনায় বেশ কিছু নতুনত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি দেশের জন্য কল্যাণকর এবং দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে এমন বেশ কিছু ইতিবাচক প্রস্তাব রয়েছে। এসব নিয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনার আগ্রহ রইল।
আজকের আলোচ্য বিষয়, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে জামায়াতে ইসলামী প্রথমেই যে প্রস্তাব রেখেছে তা নিয়ে। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা (Proportional Representation-PR) চালু করতে হবে। বাংলাদেশের নির্বাচন, সরকার গঠন, সরকারের প্রকৃতি ও স্থায়িত্ব ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার সাথে এই প্রস্তাবটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে সম্পৃক্ত।
অনুষ্ঠানে 'আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসুক সেটা আপনারা চান কিনা' সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেছেন, 'আওয়ামী লীগ জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল, তবে তারা নির্বাচন চায়নি। যারা নির্বাচন চায় না তাদের উপর নির্বাচন চাপিয়ে দেয়া একটা জুলুমের শামিল। এটাও একটা বৈষম্য।' জামায়াতের আমির এই প্রশ্নের সরাসরি কোন জবাব না দিলেও তিনি যা বলেছেন তা থেকে উত্তর বের করা খুব কঠিন নয়। কিন্তু তার এই অবস্থান রাষ্ট্র সংস্কারে দেয়া নির্বাচন ব্যবস্থা এর সংস্কারে প্রপশনাল রিপ্রেজেন্টেটিভের ধারণার সাথে কন্ট্রাডিক্ট করে। প্রপশনাল রিপ্রেজেন্টেটিভ বা সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব এমন একটি ধারণা যাতে, রাজনৈতিক দলগুলো আসন ভিত্তিক প্রার্থী না দিয়ে দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। জনগণ দলীয় মার্কায় ভোট প্রদান করবে। এতে যে দল নির্বাচনে মোট কাস্টিং ভোটের যত শতাংশ ভোট পাবে জাতীয় সংসদের মোট আসনের তত শতাংশ প্রতিনিধিত্ব তারা পাবেন। অর্থাৎ যদি কোন দল মোট ভোটের দশ শতাংশ পান তাহলে তিনি বর্তমান ব্যবস্থায় ৩০০ আসনের সংসদে ৩০টি আসন পাবেন। জামাতের এই প্রস্তাব বাংলাদেশ পরাজিত ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেবে বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা।
কেননা, ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেলেও আওয়ামী লীগ এখনও বাংলাদেশের অনেক মানুষের কাছে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় ভাটা নামলেও এই সংখ্যা ২৫ শতাংশের নিচে নামবে বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন না। সেই ক্ষেত্রে প্রপশনাল রিপ্রেজেন্টেটিভ বা সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব অনুসারে আওয়ামী লীগ কমপক্ষে ৭৫ টি আসন পাবে সব সময়। অর্থাৎ বর্তমান সময়ে গণহত্যা, গুম, খুন, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার এবং আগস্ট বিপ্লবে আন্দোলনকারীদের উপরে ভয়াবহ জুলুম নিপীড়নের প্রতিক্রিয়ায় যখন দেশব্যাপী প্রবল আওয়ামী লীগ বিরোধী চেতনা দেশের মানুষের মধ্যে সক্রিয় রয়েছে, এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে ভোট চাওয়ার মত প্রার্থী সব আসনে আওয়ামী লীগ খুঁজে পাবে কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বা আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা সর্বত্র মাঠে গিয়ে জনগণের কাছে ভোট চাইবার মত নৈতিক অবস্থানে রয়েছে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই অবস্থায় যদি দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয় তাহলে আওয়ামী লীগ শুধু মার্কার ভোটে অর্থাৎ দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ভোটে আগামী সংসদে ৭০-৭৫ টি আসন পেয়ে জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল হতে পারে। অর্থাৎ ফ্যাসিবাদকে পুনরায় রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দিতে পারে জামায়াতের এই প্রস্তাব।
অবশ্য জামায়াত যদি এই ধারণা করে থাকে যে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করবে না বা করতে পারবেনা- এমন পরিস্থিতির যদি সৃষ্টি হয় তাহলে আওয়ামী লীগের ভোট তাদের প্রতীকে পড়তে পারে বা বিএনপি ঠেকাতে আওয়ামী লীগ দাঁড়িপাল্লা মার্কায় ভোট দিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের ভোটের রেশিও অনেক বেড়ে যাবে যাতে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের হিসেবে আগামী নির্বাচনে জামায়াত আওয়ামী লীগের সমর্থনে বা ভোটে সরকার গঠন করতে পারবে বা সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবে, তাহলে সেটি জামায়াতের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার অভাব বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
কেননা অতীতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত যুগপৎ ভাবে বিএনপি বিরোধী আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটিয়ে অঘোষিত সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে মাত্র তিনটি আসনে জয়লাভ করেছিল। সেই নির্বাচনে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রায় সবাই পরাজিত হয়েছিল। যেখানে তার পূর্ববর্তী নির্বাচন ও পরবর্তী নির্বাচন বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ ভাবে অংশগ্রহণ করে যথাক্রমে ১৭ ও ১৮ টি আসনে জয়লাভ করেছিল। এতে প্রমাণিত হয় আন্দোলনের স্বার্থে ব্যবহার করলেও ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের ভোট দাঁড়িপাল্লা মার্কায় পড়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
জামায়াতের এ ধরনের একটি ভুলের কারণেই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতাসীন হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে বিএনপি এককভাবে ১৪০টি আসনে বিজয়ী হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় ১৫১ টি আসন না পাওয়ায় জামায়াতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। এই সুযোগে জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দেয়ার শর্ত হিসেবে তৎকালীন সাংবিধানিক প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি করে। সরকার গঠনের জন্য বাধ্য হয়ে বিএনপি জামাতের এই শর্ত মেনে নেয় এবং তাদের দলীয় গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে প্রেসিডেনশিয়াল সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে পার্লামেন্টারি সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে। একই সাথে সংবিধান পরিবর্তন করে বাংলাদেশের সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এই সিস্টেমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার পথ সুগম হয়। কেননা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, প্রেসিডেনশিয়াল সরকার ব্যবস্থায় খালেদা জিয়া বনাম শেখ হাসিনা সরাসরি নির্বাচন হলে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী বা ভারত বিরোধী সকল ভোট ধানের শীষে আসতো। এতে শেখ হাসিনার পক্ষে খালেদা জিয়াকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট হওয়া কখনোই সম্ভব হতো না। তাছাড়া নির্বাচনী মাঠে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার রেকর্ডেও বেগম খালেদা জিয়া এগিয়ে ছিলেন সব সময়।
এছাড়াও জামায়াতের এই সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সরকারের স্থায়িত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। যা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। একই সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আধিপত্যবাদী শক্তির নাক গলানোর সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে। কেননা বাংলাদেশের বিগত কয়েকটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ভোটের প্রবণতা পর্যবেক্ষণ করে এ ধারণা করা যায় যে, খুব জনপ্রিয়তা ধরে রেখেও নির্বাচনে গেলে বাংলাদেশে কোন একক দলের পক্ষে মোট ভোটের ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পাওয়া সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের হিসেবে বিএনপি, আওয়ামী লীগ বা অন্য কোন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জয়লাভ করলেও তাদের পক্ষে ১২০টির বেশি আসনে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। ফলে বিজয়ী দল সবসময়ই সরকার গঠনে জামায়াত, জাতীয় পার্টির মত ছোট দলগুলোর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। এতে নির্বাচিত সরকারের স্থায়িত্ব ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব পড়বে। সাংবিধানিক সংস্কারের মত বিষয়গুলো খুবই চ্যালেঞ্জের মুখে পতিত হবে, যা দেশের গণতন্ত্র ও নিরাপত্তার জন্য কখনোই কল্যাণকর হতে পারে না।
এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট সকলকে গণতন্ত্র বিরোধী ও ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনর্বাসনের সুযোগ সৃষ্টিকারী সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব সিস্টেমের ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরী।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
৪৩ বছর পর কুয়েতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী
আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করি, হাসিনার ভরসা ভারতে: দুলু
আপনাদের রান্নাঘরের বিষয়ে জিজ্ঞেস করিনা, আমাদের রান্নাঘরে উকি মারবেননা -ডা. শফিকুর রহমান
মন্ত্রিসভায় বড় রদবদল, কানাডায় কি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন ট্রুডো?
পাকিস্তান থেকে যেসব পণ্য নিয়ে এবার এলো জাহাজ
ভারতের সেবাদাসী হাসিনাকে পুনর্বাসনে এবার জঙ্গি মিশনে তারা!
মাহফুজকে উপদেষ্টা থেকে বাদ দেওয়া উচিত? যা বললেন ড. জাহেদ
৬ বছরের মধ্যেই চীনের হাতে হাজার পরমাণু বোমা! উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্রের
বিগত সময়ে দলীয় স্বার্থ উদ্ধারে বড় ধরনের অপরাধ করেছে পুলিশ, এ জন্য আমরা লজ্জিত: আইজিপি
ব্রাহ্মণপাড়ায় পাঁচ দিনেও খোঁজ মিলেনি নিখোঁজ সোহাগের
কসবায় পাহাড় কাটার অপরাধে ২ জনের অর্থদণ্ড
নরসিংদীতে মাকে কুপিয়ে হত্যা, ছেলে গ্রেপ্তার
চট্টগ্রামকে বিদায় করে টিকে রইল খুলনা
পলাতক ১৯ বাংলাদেশি নাবিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
ফ্রিজে রাখা বাসি ভাতে উপকার দ্বিগুণ!
আ.লীগ দেশটাকে গোরস্থানে পরিণত করেছিল : জামায়াত আমির
সেনবাগে মর্মান্তিক মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় ভাগ্নে নিহত : মামা আহত
কুষ্টিয়ায় সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় গৃহবধুকে নির্যাতন
রাজশাহীর বাগমারায় পুকুর থেকে ভ্যান চালকের লাশ উদ্ধার
‘জনশক্তি’ নামে কোনও রাজনৈতিক দল নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি : জাতীয় নাগরিক কমিটি