সিপাহী- জনতার বিপ্লব: ৭ নভেম্বর থেকে ৫ আগস্ট

Daily Inqilab মেহেদী হাসান পলাশ

০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০১ পিএম | আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০১ পিএম



আজ ঐতিহাসিক সাত নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের জনগণ মিলে এক ঐতিহাসিক বিপ্লব সংঘটিত করে, যে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করতে শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও প্রকৃতপক্ষে সাত দফা গোলামী চুক্তি, ৩০ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তি দেশের মানুষকে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদনের আনন্দকে ফিকে করে দেয়। এছাড়াও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুঃশাসন, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, লুটপাট এবং এসবের ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে দেয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় সহযোগিতা করলেও ভারত কখনোই বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় তা চায়নি। তার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে কোন শক্তিশালী সেনাবাহিনী থাকুক, কোন দৃঢ় ও স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি থাকুক- এটা ভারত চাইনি। আর তা নিশ্চিত করতে প্রবাসী সরকারের সাথে একটি সাত দফা গোপন চুক্তি করে। এই সাত দফা গোলামি চুক্তির মাধ্যমে সেনাবাহিনীর থেকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে রক্ষী বাহিনীর সৃষ্টি, জেনারেল উবানের তৈরি পঞ্চম বাহিনী দেশের মধ্যে এক ভয়াবহ অরাজকতা সৃষ্টি করে। কী ছিল সেই স্বাদ দফা গোপন চুক্তি?
'১। ভারতীয় সমরবিদদের তত্ত্বাবধানে আধা সামরিক বাহিনী গঠন করা হইবে। গুরুত্বের দিক হইতে এবং অস্ত্রশস্ত্রে ও সংখ্যায় এই বাহিনী বাংলাদেশের মূল সামরিক বাহিনী হইতে বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ হইবে (যথারক্ষী বাহিনী)।

২। ভারত হইতে সমরোপকরণ অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করিতে হইবে এবং ভারতীয় সমরবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী তাহা করিতে হইবে।

৩। ভারতীয় পরামর্শেই বাংলাদেশের বহিঃবাণিজ্য কর্মসূচী নির্ধারণ করিতে হইবে।

৪। বাংলাদেশের বাৎসরিক ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ভারতীয় পরিকল্পনার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ হইতে হইবে।

৫। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির অনুরূপ হইতে হইবে।

৬। ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিগুলি ভারতীয় সম্মতি ব্যতীত বাতিল করা যাইবে না।

৭। ডিসেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ভারত যে কোন সময় যে কোন সংখ্যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে পারিবে এবং বাধাদানকারী শক্তিকে চুরমার করিয়া অগ্রসর হইতে পারিবে।'
(জাতীয় রাজনীতি: ৪৫-৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৪২০।)

অন্যদিকে তাদেরই আরেকটি গ্রুপ জাসদ বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সেক্টরকে দুর্বল করতে অফিসারবিহীন সেনাবাহিনী গড়ার লক্ষ্যে ভেতরে ভেতরে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গড়ে তোলার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল।

দেশ পরিচালনায় শেখ মুজিবের মত এক বিশাল মহীরুহের চরম ব্যর্থতায় বাংলাদেশ তখন প্রায় একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কতিপয় মিড লেভেলের অফিসার কর্তৃক এক সেনা অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হন শেখ মুজিবুর রহমান। এ সময় তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা বিদেশে থাকায় এই হত্যাকাণ্ড থেকে রক্ষা পান। মুজিব পরবর্তীকালে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার নতুন রূপে রাষ্ট্রপরিচালনা করতে শুরু করে। শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত অনেক নেতাকেই আটক করে জেলে নেয়া হয় যাদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, আবুল হাসানাত মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন (অব.) মোহাম্মদ মনসুর আলী অন্যতম। ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর জেলখানায় আরেকটি হত্যাকাণ্ডে জেলখানায় উক্ত চার নেতা নিহত হন। এর আগের দিন অর্থাৎ ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিলের নেতৃত্বে আরেকটি সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এই অভ্যুত্থানে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে তাকে গৃহবন্দী করা হয়। এই অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের জনগণ শংকিত হয়ে ওঠে যে, পুনরায় ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তি বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণ নিতে চলেছে। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশে সংঘটিত হয় সিপাহী জনতার বিপ্লব।

সিপাহী জনতার বিপ্লবে দুইটি দিক রয়েছে। একটি দিক হচ্ছে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অফিসারবিহীন সেনাবাহিনী তৈরি করা এবং সেই লক্ষ্যে বিপুল সংখ্যক সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা। অন্যদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিক, জুনিয়র অফিসার কর্তৃক বন্দি সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বভার প্রদান এবং তার নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর চেইন অফ কমান্ড প্রতিষ্ঠা করা ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষা করা।

কর্নেল অব. তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য একজন জনপ্রিয় নেতৃত্ব বা মুখের প্রয়োজন ছিল। মুক্তিযোদ্ধা হলেও অবসরপ্রাপ্ত হওয়ায় কর্নেল তাহেরের পক্ষে সেই নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা, ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতার ঘোষণা, জেড ফোর্স এর কমান্ডার এবং দুইটি সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে এবং অসংখ্য সাম্মুখ সমরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও যোগ্য অফিসার হিসেবে সকলের মাঝে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। এছাড়াও দেশবাসীর মাঝেও একই কারণে জেনারেল জিয়াউর রহমানের দারুন পজিটিভ ইমেজ ছিল। কর্নেল তাহের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদেরকে বিভ্রান্ত করে দলে টানতে জিয়াউর রহমানের নাম ব্যবহার করেন এবং তাদেরকে বলেন, জেনারেল জিয়া তাদের সাথে আছেন। যা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। কর্নেল তাহের চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানোর পরক্ষণেই জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে তাকে দিয়ে টেলিভিশনে ভাষণ দিয়ে দেশবাসীকে এই অভ্যুত্থানের পক্ষে নিয়ে আসা। মূলত জেনারেল জিয়ার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে এই ভাষণ দিয়ে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অভ্যুত্থানকে টেকসই করে এবং তাকে দিয়ে তাদের ১২ দফা দাবি পূরণ করে জেনারেল জিয়াকে সরিয়ে দেয়া। জেনারেল জিয়া কোনভাবেই কর্নেল তাহেরের এই কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না।

কর্নেল তাহের তার লক্ষ্য পূরণে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদেরকে সেনানিবাসে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করতে পাঠান। কিন্তু এরই মধ্যে সেনানিবাসে অবস্থানকারী টু ফিল্ড আর্টিলারির জুনিয়র অফিসার, জেসিও ও সাধারণ সৈনিকেরা বন্দী জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে তাদের সদর দপ্তরে নিয়ে আসে। এ সময় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করে জিয়াউর রহমানকে তার বাড়িতে না পেয়ে টু ফিল্ড আর্টিলারি হেডকোয়ার্টারে গিয়ে জিয়াউর রহমানকে কর্নেল তাহেরের সালাম দিয়ে তাদের সাথে তাকে কর্নেল তাহেরের কাছে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন রেডিওতে ভাষণ দেওয়ার জন্য। কিন্তু সে সময় উপস্থিত জুনিয়র অফিসার, জেসিও ও অন্যান্য সেনা সদস্যগণ জিয়াউর রহমানকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের সাথে না যেতে অনুরোধ করেন এবং তিনি সেখানে গেলে তার জীবন বিপন্ন হতে পারে এটাও জানান। ফলে জিয়াউর রহমান তাদের সাথে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়ে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা তাহেরকে জিয়াউর রহমানের অভিমত জানান। কর্নেল তাহের রাগান্বিত ও বিষণ্নিত হয়ে জানান, 'পাখি খাঁচা ছাড়া হয়ে গেছে'। অর্থাৎ জিয়াউর রহমানকে তারা তোতা পাখির মত ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন।

এরপর জিয়াউর রহমান তার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব ও জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। বাংলাদেশ সব ধরনের ষড়যন্ত্রমুক্ত হয়। এই বিপ্লবের নেতৃত্বে জিয়াউর রহমানকে দেখে দেশবাসী আশ্বস্ত হয় এবং জুনিয়র অফিসার ও সৈনিকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ একসাথে রাস্তায় নেমে আসে স্বাধীনতার আনন্দে। মুক্ত বাংলাদেশে দ্বারা ট্যাংকের উপর চড়ে বসে আনন্দ মিছিল করে। এভাবেই ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে সিপাহী জনতার এক বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ আধিপত্যবাদী ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার চেতনা মর্যাদা ও অহংকারে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। তবে এর মধ্যেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা 'সিপাহী-সিপাহী ভাই ভাই, জেসিও ছাড়া র‍্যাংক নাই'। 'সিপাহী -সিপাহী ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই' স্লোগান দিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে ফেলে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশের একটি আদালত প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে এই খুনিদেরকে জাতীয় নায়ক ঘোষণা করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে দেশপ্রেমিক অফিসারদেরকে ধ্বংস করতে একই ধরনের আরেকটি নিষ্ঠুর পরিকল্পনা দেশবাসী পিলখানায় লক্ষ্য করেছে ২০০৯ সালে। এই হত্যাকাণ্ডের সাথেও ভারতের সম্পৃক্ততার ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে।

এই সিপাহী জনতার বিপ্লবের ৫০ বছর পর বাংলাদেশে একই ধরনের আরেকটি বিপ্লব সংঘটিত হয়। এটিও সিপাহী- জনতার বিপ্লব, সৈনিক- ছাত্র-জনতার বিপ্লব। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এই বিপ্লব সংঘটিত হয়। শেখ হাসিনা তার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরিচালিত ফ্যাসিবাদী শাসনের ১৫ বছরে গুম, খুন, আয়না ঘর, সন্ত্রাস, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার হরণ, লাগামহীন দুর্নীতি, লুটপাট, টাকা পাচার, নির্বাচন বিহীনভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিদেশী প্রভুদের সন্তুষ্ট করার জন্য দেশের স্বার্থ বিদেশিদের কাছে বিকিয়ে দেয়। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদার সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বিষয়াবলী ভারতীয়করণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ভারতের প্লেটে কেকের মতো তুলে পরিবেশন করে শেখ হাসিনা সরকার। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, কূটনৈতিক ও প্রতিরক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যখন ভারতের একটি ছায়া উপনিবেশে পরিণত হতে চলেছিল, সেই সময় বাংলাদেশকে রক্ষা করতে আবাবিল পাখির মত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভ্যন্তর থেকে নেমে আসে কিছু ছাত্র। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে তারা রাস্তায় নামলেও ধীরে ধীরে গোটা সংস্কারের নামে পুরো বাংলাদেশটা সংস্কারের লক্ষ্যে ফ্যাসিবাদের পতনের এক দফা আন্দোলনের ডাক দেয়। বিগত ১৫ বছরে বিরোধী দলগুলোর আহুত একের পর এক আন্দোলন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়ে যেভাবে দমন করেছে, ঠিক একই কায়দায় ছাত্রদের এই আন্দোলন দমনের কৌশল বেছে নিয়েছিল। কিন্তু এই ছাত্ররা ছিল দুর্দমনীয়, অদম্য। তারা 'একটা গুলি খেলে একটাই যায়, বাকিডি যায় না।' এই আতঙ্কে শেখ হাসিনার খুনি বাহিনী একের পর এক ভুল করতে থাকে। সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, গণ অধিকার ফোরাম, গণতন্ত্র মঞ্চ, মাদ্রাসা ছাত্ররা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রভৃতি ছাত্রদের এই আন্দোলনে কৌশলে সামিল হয়। তারা নিজেদের দলীয় পরিচয় এবং দলীয় পরিচিত নেতাদের ব্যবহার না করে স্বল্প পরিচিত নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের বিপুল পরিমাণে এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করে। পেশাজীবী বিভিন্ন সংগঠনের নেতারাও এই আন্দোলনে ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ায়। ফলে বাধ্য হয়ে শেখ হাসিনা কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনীকে আন্দোলন দমাতে রাস্তায় নামায়। কিন্তু মাঠে নামা সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসার, জেসিও ও সাধারণ সৈনিকেরা এই আন্দোলনে ছাত্র জনতার আন্দোলন দমনের পরিবর্তে তাদের পাশে দাঁড়ায় এবং তাদের উপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে ছাত্র- জনতার আন্দোলন রূপ নেয় ছাত্র-সেনা- জনতার আন্দোলনে। সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসাররা যারা শেখ হাসিনার সুবিধাভোগী ও প্রবল অনুগত ছিলেন, তারা জুনিয়র অফিসার ও সৈনিকদের এই অবস্থানে কার্যত অসহায় হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছাত্র- জনতা ও তার সৈনিকদের মনোভাব উপলব্ধি করে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থকে রক্ষা করতে আন্দোলনকারীদের উপর শেখ হাসিনার গুলি চালানোর নির্দেশ উপেক্ষা করেন। ফলে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না। শেখ হাসিনা তার লেসপেন্সার ও সহযোগীদের না জানিয়েই ভারতে পালিয়ে যান। লক্ষ লক্ষ ছাত্র জনতা ও সৈনিক মুক্তির আনন্দে সারা দেশের রাজপথে নেমে আসে। তারা মুহূর্তেই সারা দেশ থেকে ফ্যাসিবাদের প্রতিটি আইকন ধ্বংস করে দেয়। ছাত্র-জনতা ফুল দিয়ে সেনাসদস্যদের অভিবাদন জানায়। সেনাসদস্যরাও ছাত্র-জনতাকে আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ারের উপরে উঠে বিজয়ের অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ করে দেয়। ঠিক যেন ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পুনর্চিত্রায়ন। একই বিপ্লব যেন ৫০ বছর পর পুনর্দৃশ্যায়ন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনাবাহিনী দুইবার ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে দেশের সার্বভৌমত্বকে মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখতে বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিক ভূমিকা পালন করেছে। তাদের এই অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা-সৈনিকের এই এই বিপ্লব, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের ধারাবাহিকতা। ১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ৭ নভেম্বরের বিপ্লব যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে না পারতো তাহলে আজকের এই ৫ আগস্ট ২০২৪ এর বিপ্লব হয়তো জাতি অবলোকন করতে পারত না। একটি বিপ্লব আরেকটি বিপ্লবের ধারাবাহিকতা। তাই একটি বিপ্লব আরেকটি বিপ্লবকে অস্বীকার করে বা পাশ কাটিয়ে মহীয়ান হতে পারে না। তাই আজকের বিপ্লবীরা সেদিনের বিপ্লবীদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবেন সেটাই দেশবাসীর কাম্য। একই সাথে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর পরবর্তীকালে সেনাবাহিনী ও জনগণ একসাথে মিলে যেভাবে দেশকে রক্ষা করেছে, ভারতীয় রাহুর গ্রাস থেকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে রক্ষা করেছে, ঠিক একইভাবে ৫ আগস্ট বিপ্লব পরবর্তী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, মর্যাদা ও স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলতা, দেশপ্রেম ও সততার পরিচয় দেবেন এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

 


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেবে জাতীয় সনদ: আলী রীয়াজ
শিক্ষার্থীদের নতুন বিশ্ব গড়তে স্বপ্ন দেখার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে যৌথ বাহিনী মাঠে নামছে
আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ হারিয়েছে টিউলিপ
শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব: দুদক
আরও
X
  

আরও পড়ুন

মানবিক করিডোরের নামে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না, যা দেশের জন্য হুমকি স্বরুপ : আমিনুল হক

মানবিক করিডোরের নামে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না, যা দেশের জন্য হুমকি স্বরুপ : আমিনুল হক

ই-কমার্সকে দারিদ্র্য বিমোচনের কম্পোনেন্ট করতে চাই : ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব

ই-কমার্সকে দারিদ্র্য বিমোচনের কম্পোনেন্ট করতে চাই : ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব

ব্রাহ্মণপাড়ায় একই বিদ্যালয়ের তিন কিশোর নিখোঁজ

ব্রাহ্মণপাড়ায় একই বিদ্যালয়ের তিন কিশোর নিখোঁজ

শওকত ওসমানের ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণসভা

শওকত ওসমানের ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণসভা

বাংলাদেশিদের ভাগ্য নির্ধারণ কাল  বিতর্কিত কর্মকর্তার কাছে প্রশাসন অসহায়

বাংলাদেশিদের ভাগ্য নির্ধারণ কাল  বিতর্কিত কর্মকর্তার কাছে প্রশাসন অসহায়

ময়মনসিংহে সেনাবাহিনী নিয়ে রেলওয়ের উচ্ছেদ অভিযান, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা

ময়মনসিংহে সেনাবাহিনী নিয়ে রেলওয়ের উচ্ছেদ অভিযান, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা

যশোরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস উল্টে খাদে, ১০ যাত্রী আহত

যশোরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস উল্টে খাদে, ১০ যাত্রী আহত

রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে পূজা পরিষদের রতন ও  তপনের বিরুদ্ধে যশোর আদালতে মামলা

রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে পূজা পরিষদের রতন ও তপনের বিরুদ্ধে যশোর আদালতে মামলা

তারেক রহমানের ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঢাকা জেলা যুবদলের লিফলেট বিতরণ

তারেক রহমানের ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঢাকা জেলা যুবদলের লিফলেট বিতরণ

শিবগঞ্জ পৌরসভার বাজেট ঘোষণা

শিবগঞ্জ পৌরসভার বাজেট ঘোষণা

কমলনগরে পানিতে ডুবে এক শিশুর মৃত্যু

কমলনগরে পানিতে ডুবে এক শিশুর মৃত্যু

আনচেলত্তিকে মানতে পারছেন না ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট

আনচেলত্তিকে মানতে পারছেন না ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট

সাশ্রয়ী মূল্যে বাংলাদেশের বাজারে আসছে অপো ‘এ৫এক্স’

সাশ্রয়ী মূল্যে বাংলাদেশের বাজারে আসছে অপো ‘এ৫এক্স’

ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেবে জাতীয় সনদ: আলী রীয়াজ

ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেবে জাতীয় সনদ: আলী রীয়াজ

লালমোহন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কবীর পাটোয়ারী ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী পালিত

লালমোহন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কবীর পাটোয়ারী ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী পালিত

চাঁদপুরে মাকে হত্যার দায়ে ছেলের যাবজ্জীবন

চাঁদপুরে মাকে হত্যার দায়ে ছেলের যাবজ্জীবন

বগুড়ায় সমবেত কন্ঠে জাতীয় সংগীতানুষ্ঠানে হামলা আহত ৭

বগুড়ায় সমবেত কন্ঠে জাতীয় সংগীতানুষ্ঠানে হামলা আহত ৭

মেহেরপুরের বুড়িপোতা সীমান্তে প্রায় কোটি টাকার স্বর্ণের বার সহ আটক ২

মেহেরপুরের বুড়িপোতা সীমান্তে প্রায় কোটি টাকার স্বর্ণের বার সহ আটক ২

হামলার ঘটনায় জড়িত থাকায় ছেলেকে পুলিশে দিলেন কুমিল্লার এক বিএনপি নেতা

হামলার ঘটনায় জড়িত থাকায় ছেলেকে পুলিশে দিলেন কুমিল্লার এক বিএনপি নেতা

শিক্ষার্থীদের নতুন বিশ্ব গড়তে স্বপ্ন দেখার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

শিক্ষার্থীদের নতুন বিশ্ব গড়তে স্বপ্ন দেখার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার