ইন্টারপোলের রেড নোটিশের মাধ্যমে কি শেখ হাসিনাকে ফেরত আনা সম্ভব?
১২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫৭ এএম | আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫৭ এএম
শেখ হাসিনাসহ জুলাই-আগস্টের গণহত্যার জড়িতদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করতে যাচ্ছে সরকার।
গত রবিবার (১০ নভেম্বর) সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পুরাতন ভবনের সংস্কারকাজ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।
এর আগে, গত অক্টোবরে শেখ হাসিনাসহ পলাতকদের গ্রেফতার করে আগামী ১৮ই নভেম্বরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
ইন্টারপোলে রেড নোটিশ দিয়ে শেখ হাসিনাসহ পলাতকদের কবে ফেরত চাইবে বাংলাদেশ, কিংবা ভারতে পলাতকদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরত আনা সম্ভব কি না এখন সেই প্রশ্ন উঠেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “ফরমালি আমাদের পক্ষ থেকে ওয়ারেন্ট ইস্যু চলে গেছে বাংলাদেশ পুলিশের সদর দপ্তরে।”
গত মাসেই ভারত সরকার নিশ্চিত করে জানিয়েছে যে শেখ হাসিনা তাদের দেশেই অবস্থান করছে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলা’য় অভিযুক্ত বা ফেরার আসামি ও বন্দিদের একে অপরের কাছে হস্তান্তরের জন্য একটি চুক্তি আছে ২০১৩ সাল থেকেই।
তাহলে বাংলাদেশ কেন সেই চুক্তি অনুযায়ী ফেরত না চেয়ে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাচ্ছে সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
রেড নোটিশ জারি করে কীভাবে ফেরত আনা যায়?
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউর তাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনাসহ পলাতক আসামিদের ফেরত আনতে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, ইন্টারপোল আসামিদের অবস্থান সম্পর্কে জানার পর সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা বলেন, রেড এলার্ট মানে অমুক লোক, এর বিরুদ্ধে আমাদের এখানে মামলা বা ওয়ারেন্ট আছে। ওই আসামি যে দেশে আছে সেই দেশের পুলিশ বিভাগকে ওই আসামির ওপর নজর রাখতে বলবে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর তথ্য বলছে এখন পর্যন্ত ইন্টারপোলের মাধ্যমে ১৭ জন অভিযুক্ত আসামিকে বাংলাদেশে ফেরত আনা গেছে।
এক্ষেত্রে ইন্টারপোল যদি সহযোগিতা করে থাকে তাহলে শেখ হাসিনাসহ পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের দেশে ফেরত আনা সম্ভব কি না এমন প্রশ্নে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা নুরুল হুদা কিছুটা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেছেন, ফেরত পাঠানোর বিষয়টা শুধু রেড নোটিশের মাধ্যমেই সম্ভব হয় না। সেটা সেই দেশের জুডিশিয়াল অথরিটিরও বিষয় রয়েছে।
রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ফেরত আনা সম্ভব?
ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে তাদের রেড নোটিশের তালিকায় বর্তমানে ৬৪ জন বাংলাদেশির নাম রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি অপরাধ ও বিভিন্ন হত্যা মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি।
এর আগে ২০১৫ সালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছিল।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ বিভিন্ন মামলার তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রথমে ইন্টারপোল ওই বছরের ২ জুলাই তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছিল। পরে এ নিয়ে আইনি লড়াইয়ে নামেন তারেক রহমানের আইনজীবীরা।
পরে শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ ইন্টারপোলের ৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রেড নোটিশের তালিকা থেকে তারেক রহমানের নাম প্রত্যাহারের আদেশ দেয় ইন্টারপোল কমিশন।
বর্তমানে ইন্টারপোলের তালিকায় যে ৬৪ জনের নাম রয়েছে তার মধ্যে তারেক রহমানের নাম নেই।
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ইন্টারপোলে কাউকে রেড এলার্ট দিলেই যে তাকে দেশে ফেরত আনা যাবে বিষয়টি একদমই তেমন নয়।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা বলেন, যার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা তাকে যে দেশে নেওয়া হবে সেই দেশের পরিস্থিতি কেমন। কিংবা রাজনৈতিক কোনো কারণ আছে কি না সেগুলোও বিচার বিশ্লেষণ করা হয়। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক কাউকে ফৌজদারি অপরাধে আটক দেখিয়ে আনা খুব একটা সহজ নয়।
এর আগে ২০১৩ সালে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে আবুল কালাম আযাদকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু বিচার শুরু হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান। তাকে ফেরত আনতে রেড এলার্ট জারি করেছিল ইন্টারপোল। ইন্টারপোলের তালিকায় এখন যে ৬৪ জনের নাম আছে সেখানে আবুল কালাম আযাদের নামও দেখা গেছে। কিন্তু তাকে এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি।
ইন্টারপোল কীভাবে কাজ করে?
ইন্টারপোল বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন হলো এমন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা যেটি সারা বিশ্বের পুলিশ এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞদের একটি নেটওয়ার্কে সংযুক্ত ও সমন্বয় করে। এর প্রধান কাজ অপরাধীদের ধরতে আন্তর্জাতিক পুলিশকে সহায়তা করা। যেন বিশ্বের সব পুলিশ অপরাধের বিরুদ্ধে এক হয়ে কাজ করতে পারে।
যদি একটি দেশের আসামি সেখানে অপরাধ করার পর অন্য দেশে চলে যায়, তখন সেই আসামিকে ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা লাগে। সংস্থাটি অপরাধের তদন্ত, ফরেনসিক ডেটা বিশ্লেষণ সেইসাথে পলাতকদের খুঁজে করতে সহায়তা করে।
এক্ষেত্রে ওই দেশকে সন্দেহভাজন অপরাধীর যাবতীয় তথ্য দিয়ে রেড নোটিশ জারির জন্য আবেদন করতে হয়। তবে ইন্টারপোল কোনো আসামিকে ধরিয়ে দেওয়ার আবেদন পেলেই তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে পারে না বলে জানিয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা।
তিনি বলেন, যদি কোন দেশ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য ইন্টারপোল সদর দপ্তরে আবেদন জানায় তাকে ওই অভিযুক্তের অপরাধ বিষয়ক যাবতীয় কাগজপত্র, মামলা কপি ইত্যাদি সংগ্রহ করে ইন্টারপোলের কাছে দিতে হয়।
ইন্টারপোল সেই কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে যে তার বিরুদ্ধে কোনো নোটিশ জারি করা হবে কি হবে না। এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া না হওয়া তাদের কাছে মুখ্য নয়৷ ইন্টারপোল কারও বিরুদ্ধে একবার রেড নোটিশ জারি করলে সেটি সংস্থাটির সদস্যভুক্ত ১৯৪টি দেশের কাছে পাঠানো হয়।
মূলত ইন্টারপোলের এমন একটি ডাটাবেস রয়েছে যেখানে অপরাধীদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য যেমন: অপরাধীর ছবি বা স্কেচ, ক্রিমিনাল প্রোফাইল, ক্রিমিনাল রেকর্ড, চুরির রেকর্ড, চুরি যাওয়া পাসপোর্ট, যানবাহন, এবং জালিয়াতির তথ্য ইত্যাদি পাওয়া যায়।
দুর্নীতি, যুদ্ধাপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, মানব-পাচার, অস্ত্রপচার, মাদক পাচার, সাইবার ক্রাইম, মানি লন্ডারিং, শিশু সহিংসতাসহ ১৭ ক্যাটাগরির অপরাধ তদন্তে ইন্টারপোল তার সদস্য দেশগুলোকে সহায়তা দিয়ে থাকে।
রেড নোটিশ নাকি প্রত্যর্পণ চুক্তি?
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলা’য় অভিযুক্ত বা ফেরার আসামি ও বন্দিদের একে অপরের কাছে হস্তান্তরের জন্য একটি চুক্তি আছে ২০১৩ সাল থেকেই।
চুক্তি অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তির নামে মামলা বা অভিযোগ দায়ের হয় বা তিনি দোষী সাব্যস্ত হন অথবা দেশের আদালতের কর্তৃক প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ করার জন্য তাকে ফেরত চাওয়া হয় তাহলে তাকে ফেরত দেবে বাংলাদেশ ও ভারত।
এই চুক্তিতে বলা হয়েছে যে অপরাধটি ‘রাজনৈতিক প্রকৃতির’ হলে যে কোনো দেশ প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তবে চুক্তি অনুযায়ী হত্যা, নরহত্যা বা অপরাধমূলক হত্যা, আক্রমণ, বিস্ফোরণের কারণ, জীবন বিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বিস্ফোরক পদার্থ বা অস্ত্র তৈরি বা নিজের কাছে রাখাসহ বেশ কিছু অপরাধকে রাজনৈতিক বলার সুযোগ নেই।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিটি ২০১৩ সালে করা হলেও ২০১৬ সালে মূল চুক্তিটি সংশোধন করা হয়। সংশোধনের সময় এমন একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছিল সেটি হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে বেশ সহজ করে তুলেছিল।
সংশোধিত চুক্তির ১০ এর (৩) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো অভিযুক্তের হস্তান্তর চাওয়ার সময় অনুরোধকারী দেশকে সেই সব অভিযোগের পক্ষে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ না করলেও চলবে শুধু সংশ্লিষ্ট আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা পেশ করলেই সেটিকে বৈধ অনুরোধ হিসেবে ধরা হবে।
শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় ভারতের সাথে বন্দি বিনিময় চুক্তি থাকার পরও শেখ হাসিনাকে সেই চুক্তি অনুযায়ী না চেয়ে ইন্টারপোলের সহযোগিতা কেন চাওয়া হচ্ছে?
এমন প্রশ্নে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, প্রত্যর্পণ চুক্তি অনেক বড় ব্যাপার। আর ইন্টারপোলের মাধ্যমে দ্রুত কাউকে ফেরত পাওয়া সম্ভব। শেখ হাসিনাকে ফেরানোর জন্য যত প্রক্রিয়া আছে সব প্রক্রিয়াই ফলো করবে সরকার।
তবে কূটনীতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় কোনো দেশ যদি কোনো আসামিকে ফেরত দিতে না চায় তাহলে যে কোনো কারণ দেখিয়ে আবেদন নাকচ করে দিতে পারে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বলেন, মোটা দাগে বললে প্রত্যর্পণ চুক্তি বাস্তবায়ন করার বিষয়টি শুধু আইনি বিষয় নয়, রাজনৈতিকও বটে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমান সম্পর্কের জায়গা থেকে শেখ হাসিনাকে চুক্তি কিংবা ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরত পাওয়ার বিষয়টি অনেকটা জটিল। তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে জাতীয় স্মৃতিসৌধে-ডিআইজি ঢাকা রেঞ্জ
লজিটেক নিয়ে এলো সাশ্রয়ী মূল্যের এম১৯৬ ব্লুটুথ মাউস
রাষ্ট্র গঠনে তারেক রহমানের ৩১দফা প্রচারে রামপালে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত
বিসিসিএমইএ আগাম নির্বাচনের সিদ্ধান্ত
‘ফিন্যান্স ডিরেক্টর অফ দ্য ইয়ার ২০২৪' হিসেবে স্বীকৃত পেলেন ব্র্যাকের সিএফও তুষার ভৌমিক
টেকনোলজি লিডারশিপে উৎকর্ষের জন্য সি-সুইট অ্যাওয়ার্ড পেলেন বিএটি বাংলাদেশের সারজিল সারওয়ার
আন্তর্জাতিক শিক্ষাক্রমের প্রতি বাংলাদেশি অভিভাবকদের আগ্রহ বাড়ছে
ইবি শিক্ষার্থীকে হেনস্তার অভিযোগে গোল্ডেন লাইনের আটক
গণঅভ্যুত্থানের বিশ্বাসের সঙ্গে বেঈমানি করলে প্রধান উপদেষ্টাকেও ছাড় নয়
সচেতনতা হাজার হাজার শিশুকে বাঁচাতে পারে অন্ধত্ব থেকে: কর্মশালায় বক্তারা
হত্যা মামলার আসামি হয়েও ধরাছোয়ার বাইরে পুলিশ কর্মকর্তারা
৫ আগস্টের পর থেকে আমরা কথা বলার অধিকার ফিরে পেয়েছি -আবুল হোসেন আজাদ
গণ-অভ্যুত্থানের বিশ্বাসের সাথে বেঈমানি করলে কাউকেই ছাড়া দেয়া হবে না - রাজশাহীতে সারজিস আলম
বুদ্ধিজীবী হত্যার রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি- এড. মুয়াযযম হোসাইন হেলাল
মানিকগঞ্জে ডিএফএ'র নতুন কমিটির সভাপতি ইলিয়াস, সম্পাদক আলাউদ্দিন
পশ্চিমবঙ্গের একই জেলায় ‘বাবরি মসজিদ’ ও রাম মন্দির গড়তে চায় তৃণমূল-বিজেপি
মুসলিম উম্মাহর ঐক্য কামনা চেয়ে মৌলভীবাজারে শেষ হলো তাবলীগের তিন দিনের জেলা ইজতেমা
ফুটবলার থেকে জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট, কে এই মিখাইল কাভেলাশভিলি?
তিন খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, ১৮ বছর বাদে মিথ্যা স্বীকার
রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে সর্বস্তরের মানুষের ঢল