রয়টার্সের প্রতিবেদন : চুক্তি লঙ্ঘন করে কর সুবিধার কথা গোপন, বাংলাদেশের চাপের মুখে আদানি
২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম
ভারতের বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আদানি পাওয়ারের বিরুদ্ধে কয়েক বিলিয়ন ডলারের চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার।
রয়টার্সের হাতে আসা নথি অনুযায়ী, ওই বিদ্যুৎ চুক্তির আওতায় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ভারত সরকার থেকে কর সুবিধা পেলেও চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে সেই সুবিধা দেয়নি আদানি। গোপন করে গেছে সেই সুবিধা পাওয়ার তথ্যও।
পূর্ব ভারতের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ২০১৭ সালে ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানিটি বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে। তবে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগের নথি এবং দুই পক্ষের মধ্যে চালাচালি হওয়া চিঠিপত্র অনুযায়ী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো ধরনের টেন্ডার ছাড়াই এই চুক্তি অনুমোদন করেছিলেন। আর চুক্তিটিও বাংলাদেশের অন্যান্য কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্পের তুলনায় অনেক বেশি ব্যয়বহুল। তাই এ বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে ফের দরকষাকষি করতে চায় বলে জানিয়েছে ঢাকা। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হলেও আদানি পাওয়ারের বিল পুরোটা পরিশোধ করেনি বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের বিল বাবদ বাংলাদেশের কাছে কয়েকশো মিলিয়ন ডলার পাওনা রয়েছে আদানির। তবে পাওনার সঠিক অঙ্ক নিয়ে দুই পক্ষের মতবিরোধ রয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান রয়টার্সকে বলেছেন, আদানির সরবরাহ ছাড়াই স্থানীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোই দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে সক্ষম। সব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু না থাকলেও স্থানীয় উৎপাদনই পর্যাপ্ত বলে মনে করেন তিনি।
ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণআন্দোলনে হাসিনার পতন হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস। কয়েক মেয়াদে দুই দশকের বেশি সময় বাংলাদেশ শাসন করা হাসিনা ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ মিত্র।
রয়টার্স জানাচ্ছে, আদানির সঙ্গে হওয়া মূল বিদ্যুৎ চুক্তির সঙ্গে ছিল আরেকটি বাড়তি বাস্তবায়ন চুক্তি। সেই চুক্তিতে কর সুবিধা হস্তান্তর বা ভাগাভাগির শর্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাংলাদেশ এখন ২৫ বছর মেয়াদি এই বিদ্যুৎ চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের কথা ভাবছে। নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রসিকিউটররা আদানির বিরুদ্ধে ২৬৫ মিলিয়ন ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগে যে মামলা করেছেন, তা কাজে লাগিয়ে কোম্পানিটিকে চুক্তি পুনর্মূল্যায়নে চাপ দিতে পারবে বলে আশা করছে ঢাকা।
বাংলাদেশে আদানি পাওয়ারের বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়নি। তবে রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে আদানির একজন মুখপাত্র বলেছেন, কোম্পানিটি সব চুক্তিগত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে এবং ঢাকা চুক্তি পর্যালোচনা করছে এমন কোনো ইঙ্গিত তারা পাননি। কর সুবিধা ও অন্যান্য বিষয়ে প্রশ্ন করা হলেও কোম্পানিটি সেসবের উত্তর দেয়নি। আদানি গ্রæপ যুক্তরাষ্ট্রে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোকে ‹ভিত্তিহীন› বলে দাবি করেছে। আদানি পাওয়ারের গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালিত হয় আমদানি করা কয়লা দিয়ে। কেন্দ্রটি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্যই নির্মাণ করা হয়েছিল। কোম্পানিটি বলেছে, এই প্রকল্প ভারতের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হয়েছে। ২০১৯ সালে দিল্লি এই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত বলে ঘোষণা দেয়। এর ফলে কেন্দ্রটি আয়কর অব্যাহতিসহ অন্যান্য কর সুবিধা পায়।
২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ার ও রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি এবং বাস্তবায়ন চুক্তি অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কর-সংক্রান্ত সুবিধার পরিবর্তন দ্রæত বাংলাদেশকে জানানোর এবং সেই সুবিধা বাংলাদেশকেও দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল আদানি পাওয়ারের।
কিন্তু এ সুবিধার কথা জানানো কিংবা সুবিধা ভাগাভাগি-কোনোটাই করেনি আদানি পাওয়ার। ২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এবং ২২ অক্টোবর বিপিডিবির পাঠানো চিঠি থেকে এ তথ্য জানা গেছে। চিঠিগুলোর কপি রয়টার্সের হাতে এসেছে। ওই চিঠিগুলোতে বাংলাদেশকে এসব সুবিধা দিতে অনুরোধ করা হয়েছে কোম্পানিটিকে। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না থাকায় নাম না প্রকাশের শর্তে বিপিডিবির দুজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, তারা আদানি পাওয়ারের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাননি। ওই কর্মকর্তারা জানান, বিপিডিবির হিসাব অনুসারে, কর সুবিধা হস্তান্তর করা হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে বাংলাদেশের প্রায় ০.৩৫ সেন্ট ব্যয় সাশ্রয় হতো।
রয়টার্সের দেখা বাংলাদেশ সরকারের একটি নথির তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৮.১৬ বিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। এই হিসাবে বাংলাদেশের মোট সাশ্রয় হতে পারত প্রায় ২৮.৬ মিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানান, ভবিষ্যতে আদানি পাওয়ারের সঙ্গে আলোচনার সময় এই ব্যয় সাশ্রয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হবে।
তড়িঘড়ি করে চুক্তি
এ বছরের নভেম্বরে ২০১০ সালের একটি আইন বাতিল করে বাংলাদেশ। এ আইন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়াই জ্বালানি চুক্তি অনুমোদনের ক্ষমতা দিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার থিঙ্কট্যাঙ্ক ক্লাইমেট এনার্জি ফাইন্যান্স-এর পরিচালক টিম বাকলে রয়টার্সকে বলেন, টেন্ডার ছাড়া চুক্তি অস্বাভাবিক। টেন্ডারের মাধ্যমে ‘সম্ভাব্য সেরা মূল্য’ নিশ্চিত করা যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি। সেপ্টেম্বরে অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার আমলে স্বাক্ষর করা প্রধান প্রধান জ্বালানি চুক্তিগুলো পর্যালোচনার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করে। পাশাপাশি আদানি পাওয়ারের সঙ্গে করা চুক্তি নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র তৈরির জন্য গঠিত কমিটি ড. ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বলেছে, আদানি গ্রæপের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে আনা অভিযোগের কারণে বাংলাদেশেরও এই বিদ্যুৎ চুক্তি ‹যাচাই› করা উচিত। চুক্তিটি ‹তড়িঘড়ি› করে করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি রয়টার্স। তবে হাসিনার ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় রয়টার্সকে বলেন, আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তি সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না, তবে তিনি নিশ্চিত যে ‹এতে কোনো দুর্নীতি হয়নি›। আদানির চুক্তিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগের জবাবে জয় বলেন, ‹আমি কেবল ধারণা করতে পারি, এই চুক্তির জন্য ভারত সরকার লবিং করেছে›। তবে মোদি প্রশাসন ও ভারত সরকারের অন্য কর্মকর্তারা এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
পাওনা নিয়ে বিরোধ
পাওনা পরিশোধ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বিরোধের জেরে ৩১ অক্টোবর আদানি পাওয়ার গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেকে নামিয়ে আনে। ১ জুলাই একটি চিঠিতে বিপিডিবি ছাড়ের মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ করে আদানি পাওয়ারকে। কোম্পানিটি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। আদানি মে মাস পর্যন্ত বিপিডিবিকে যে ছাড় দিয়েছিল, তাতে প্রায় ১৩ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়। তবে আদানি বলে, পাওনা মেটানোর আগে তারা কোনো নতুন ছাড় বিবেচনা করবে না। আদানি পাওয়ার দাবি করছে, বাংলাদেশের কাছে তাদের পাওনার পরিমাণ ৯০০ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে বিপিডিবি বলছে, এই পাওনার পরিমাণ প্রায় ৬৫০ মিলিয়ন ডলার। ডলার সংকটে ভুগতে থাকা বাংলাদেশ বকেয়া পরিশোধের জন্য পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা জোগাড় করতে পারেনি বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন বিপিডিবি কর্মকর্তারা।
আদানি পাওয়ার বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেকে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বাংলাদেশ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছে। এর কারণ হিসেবে বিপিডিবি চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম জানান, অক্টোবরে ঢাকা আদানি পাওয়ারকে ৯৭ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে। এই বছরে আর কোনো মাসে এত বেশি পরিমাণ পাওনা পরিশোধ করা হয়নি। পাওনা নিয়ে দুপক্ষের এই বিরোধের মূল কারণ বিদ্যুতের মূল্য হিসাব করার পদ্ধতি। ২০১৭ সালের চুক্তি অনুযায়ী, দুটি সূচকের গড়ের ভিত্তিতে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল।
তবে বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ ক্রয় সারাংশের তথ্যানুসারে, গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের দাম বাংলাদেশে সরবরাহ করা অন্যান্য ভারতীয় উৎপাদনকারীদের বিদ্যুতের গড় মূল্যের চেয়ে ৫৫ শতাংশ বেশি। বিপিডিবির তিনটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, চুক্তিতে উল্লেখিত একটি সূচক গত বছর সংশোধিত হওয়ার পর বাংলাদেশ আদানি পাওয়ারকে অন্যান্য বেঞ্চমার্ক (মানদÐ) ব্যবহার করতে চাপ দিচ্ছে, যা বিদ্যুতের দাম আরও কমাবে। তবে আদানি পাওয়ার তাতে রাজি হয়নি জানিয়ে একটি সূত্র বলেছে, দুই পক্ষ শিগগিরই আলোচনায় বসতে যাচ্ছে।
চুক্তি অনুযায়ী, যেকোনো সালিশি কার্যক্রম সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত হবে। তবে বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশ দেওয়া তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবে। তিনি বলেন, যদি প্রমাণিত হয় যে ঘুষ আদানপ্রদান বা অনিয়ম হয়েছে, সেক্ষেত্রে চুক্তি বাতিলের ঘটনা ঘটলে আদালতের আদেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঘণকুয়াশায় ৩ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু
গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে
কনসার্ট মঞ্চে স্বৈরাচার হাসিনার বিচার দাবি
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও ১৪ ফিলিস্তিনি
ঘণকুয়াশায় আরিচা-কাজিরহাট, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ
আওয়ামী লীগ যা করেছে, বিএনপি তার বিপরীত কাজ করে সুন্দর সমাজ গড়বে- কেন্দ্রীয় শ্রমিক দলের নেতা ইয়াকুব চৌধুরী
রোমাঞ্চকর ম্যাচে বার্সাকে হারিয়ে শীর্ষে আতলেটিকো
জেসুসের জোড়া গোলের রাতে আর্সেনালের বড় জয়
বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর
চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ
কেরু চিনিকলে আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন
বিহারিরা কেমন আছে
লক্ষ্মীপুরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে
১৫ নারী ও শিশুকে হস্তান্তর
আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে
মেহেরপুরে বেড়েছে গরম কাপড় বিক্রি
কাশিয়ানীর হাট-বাজার নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব