আরব বসন্ত থেকে বাংলাদেশ: স্বৈরাচার মুক্ত নতুন ব্যবস্থার সন্ধানে
০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম
বু আজিজি। তিউনিসিয়ান ফল বিক্রেতা ছিলেন। ফলের দোকান নিয়ে বসতেন রাস্তার পাশে। উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। চাকরি না পেয়ে ফলের ব্যবসাই ছিল তার চলার একমাত্র অবলম্বন। একদিন তিউনিসিয়ার পুলিশ তার ফলের দোকান গুড়িয়ে দেয় এবং তাকে লাঞ্ছিত করে। প্রতিবাদ স্বরুপ বু আজিজি তার গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। কয়েক দিন হসপিটালে চিকিৎসা নিলেও এক পর্যায়ে সে মারা যায়। বু আজিজির গায়ের আগুন দ্রোহের লেলিহান শিখা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো তিউনিসিয়ায়। ত্রিশ বছরের স্বৈরশাসক তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলীর দুঃশাসনে মানুষ ছিল অতিষ্ঠ। দুর্নীতি,স্বজনপ্রীতি, অর্থনৈতিক দুরাবস্থা এবং বেকারত্ব সমাজকে গ্রাস করেছিল। তরুণদের মধ্যে হতাশা এবং ক্ষোভ ছিল পাহাড় সম। ফলে বিদ্রোহের একটি ক্ষেত্র আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। বু আজিজির গায়ে আগুন জ্বালিয়ে প্রতিবাদ বেন আলীর পতনের চূড়ান্ত পরিনতি ঠিক করে দেয়। জনতার গণঅভ্যুত্থানে এক পর্যায়ে পতন হয় তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলীর।সৌদি আরবে পালিয়ে গিয়ে জনরোষ থেকে রক্ষা পান। দুনিয়া কাঁপানো আরব বসন্তের সূচনা এভাবেই বু আজিজির আত্মত্যাগের মাধ্যমে। এক বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে বু আজিজিই সম্ভবত সবচেয়ে ইনফ্লুয়েন্সিশান রেভ্যুলিউশনারী। পৃথিবী তাঁকে মনে রাখবে।
তিউনিসিয়ার সেই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতে মিশরকে প্রভাবিত করে। মিশরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে জনতা তিউনিসিয়ান স্টাইলে রাজপথে নেমে আসে।সৃষ্টি হয় তাহরির স্কয়ারের। পতন হয় মিশরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের। পরবর্তীতে একে একে এই গণঅভ্যুত্থান লিবিয়া, লেবানন, সিরিয়া সহ আরব বিশ্বের স্বৈরশাসক নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র গুলোর ক্ষমতার মসনদ তসনস করে দেয় এই আরব বসন্তের ঢেউ।
আরব বসন্তে শুধু যে আরব বিশ্বের স্বৈরশাসকের ক্ষমতার শেষ যাত্রা শুরু হয়েছে তাই নয়, পৃথিবীর যেখানেই স্বৈরশাসন, সেখানেই আরব বসন্তের প্রভাব পড়েছে। একই স্টাইলে জনতা বিক্ষোভে শামিল হয়েছে আর স্বৈরাচার পালিয়ে গেছে। আফগানরা বিশ বছরের মার্কিন দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়ে জনগণের বিজয় নিশ্চিত করেছে। প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই পালিয়ে গেছে। দখলদাররা যে যেভাবে পেরেছে, পালিয়েছে।
শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে পরিবারের দুঃশাসনে মানুষ যুগের পরে যুগ ভুগেছে। অর্থনীতি ধ্বসে গিয়ে ছিল। বেকারত্বে বিরক্ত ছিল তরুণ প্রজন্ম। হাম্বানটোডা সমুদ্র বন্দর চীনের কাছে লিজ দিতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। ভারতের তাদেরদারী তো ছিলই। কখনো মাহিন্দা রাজাপাকসে কখনো তার ভাই গোটাবায়া রাজাপাকসে যুগের পরে যুগ স্বৈরাচারী কায়দায় শ্রীলঙ্কা শাসন করে একটি চরম পর্যায়ের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। জনগণ জেগে উঠে।রাজাপাকসে পরিবারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। তীব্র গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে। স্বৈরাচারের দোষর এমপি মন্ত্রীরা জনতার হাতে লাঞ্ছিত হয়। বিপ্লবী জনতা প্রেসিডেন্টশিয়াল পেলেস দখল করে উল্লাসে মেতে উঠে। ফলে শ্রীলক্ষায় পতন হয় রাজাপাকসে যুগের।
পনেরো বছর যাবত বাংলাদেশের জনগণ ভোট দিয়ে সরকার গঠন করতে পারেনি। বিরোধীদের দমন করার জন্য এমন কোনো পথ নেই যা শাসকশ্রেণি গ্রহণ করেনি। গুম খুনের অভয়ারণ্যে পরিনত হয় বাংলাদেশ। আয়নাঘরের মতো নিষ্ঠুরতম টর্সার সেল গড়ে তুলে সরকার। হামলা মামলা জেল জুলুম নিপীড়ন নির্যাতন ছিল নিত্য সঙ্গী। প্রায় একলাখ পঞ্চাশ হাজার নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা মামলা করা হয়। বিডিআর বিদ্রোহ, শাপলা চত্বর, ২৮শে অক্টোবর এগুলো বিশেষ ক্ষত সৃষ্টি করে জাতির জীবনে। ভারতের আধিপত্য এদেশের মানুষের মেনে নেওয়াই যেন ছিল নিয়তি।আইনের শাসন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছিল। একটা পর্যায়ে মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়ে যায়। তরুণরা নেতৃত্ব দেয়,রাজনৈতিক দল গুলোও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ গ্রহণ করে। তারুণ্যের বিদ্রোহে দেশ উত্তাল হয়ে পড়ে। গণহত্যা চালিয়েও রেহাই পায়নি স্বৈরাচার । একটা পর্যায়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় শেখ হাসিনা। এক নতুন যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশের রাজনীতি।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে গেছে। জনগণের সম্মিলিত লড়াইয়ের কাছে ঠিকতে না পেরে। আরব বসন্তের ঢেউ সিরিয়াতেও লেগেছিল অনেক আগেই। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির নানা মারপ্যাচে শেষ পর্যন্ত টিকেই যাচ্ছিলেন বাশার আল আসাদ। রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি সহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন পাওয়ার এতো দিন টিকে ছিলেন বাশার আল আসাদ। সিরিয়া যুদ্ধের সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে রাষ্ট্র হিসেবে মনে হয় তুরস্ককে। প্রায় ত্রিশ লাখ সিরিয়ান শরনার্থীকে আশ্রয় দিয়ে ছিল তুরস্ক। এগুলো সিরিয়ায় ফেরাতে তুরস্কের প্রচেষ্টা তো ছিলই।ফলে নতুন হিসাব কষতে হয়েছে তুরস্ককেও। মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে রাশিয়া- ইরান- তুরস্ক এবং মার্কিন- ইইউ এবং ইস-রাইল এই বলয়ের হিসাব মেলানো কঠিন। কিন্তু মানুষ মুক্তির জন্য লড়াইয়ের রক্তাক্ত পথকেই গ্রহণ করেছে।
বাশার আল আসাদের পিতা হাফিজ আল আসাদ ছিলেন একজন সামরিক অফিসার। তিনিও স্বৈরাচারী কায়দায় সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে উনত্রিশ বছর সিরিয়া শাসন করেছেন।আর বাশার আল আসাদের শাসনের চব্বিশ বছর।পিতা পুত্র মিলে মোট তিপ্পান্ন বছর সিরিয়ায় স্বৈরশাসন কায়েম করে ছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। পালাতে হলো। বাশার আল আসাদের পতনে বিজয় উদযাপন করছে সিরিয়া। রাস্তায়, মসজিদে, পার্কে সিজদায় শুকরিয়া জানাচ্ছে মানুষ। নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন সবার চোখে মুখে। এখানেই হয়তো শেষ নয়,আরও অনেক কিছু বাকী। ফিলিস্তিন এখনও রক্তাক্ত প্রান্তর, মিয়ানমার এখনও রনাঙ্গন। তবুও পরিবর্তনের ঢেউ আচরে পড়ছে তামাম দুনিয়ায়। মুক্তিকামী মানুষ নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছে।
এই যে দেশে দেশে পরিবর্তন এগুলোর সব গুলোতেই আরব বসন্তের একটা প্রভাব রয়েছে,সেটা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ যেভাবেই হোক। বিপ্লব কিংবা গণঅভ্যুত্থান তো ছোঁয়াচে রোগের মতো, এক দেশ থেকে ছড়িয়ে পড়ে অন্য দেশে। আরব বসন্তের বিপ্লবী সূচনা তিউনিসিয়ান তরুণ বু আজিজির গায়ে আগুন জ্বালিয়ে আত্মত্যাগের মাধ্যমে।
তিউনিসিয়ায় যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল সেই পরিবর্তনের ঝড়ে সর্বশেষে বাংলাদেশ এবং সিরিয়া থেকেও স্বৈরাচার দূর হলো। আগামী দিনের নতুন পৃথিবী সেই মানুষটাকেও শ্রদ্ধায়,ভালোবাসায়, সম্মানে মনে রাখুক, যাদের জীবনের আত্মত্যাগ, রক্ত এবং শরীরের ঘাম স্বৈরশাসককে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল।
বিগত এক যুগে তিউনিসিয়া থেকে সিরিয়ায় গণমানুষের মুক্তির সংগ্রামে বিদায় নিয়েছে অনেক নিষ্ঠুরতম স্বৈরাচার শাসক। দীর্ঘদিন স্বৈরাচারের কবলে থাকা দেশ গুলো মুক্তি এবং অধিকারের জন্য লড়াই করে সফলতার মুখ দেখছে। এক নয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে এগুচ্ছে এইসব রাষ্ট্রগুলো।
লেখক: সহ-সভাপতি, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, কেন্দ্রীয় সংসদ।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
নরসিংদী টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ারিং কলেজে তাঁতবোর্ড চেয়ারম্যানসহ ১৫ কর্মকর্তা অবরুদ্ধ
জাবিতে ছাত্র রাজনীতির সংস্কার নিয়ে জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত
টিউলিপ সিদ্দিকের দুর্নীতি নিয়ে যা বললেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী
বেনাপোল সীমান্তে বিজিবি ও বিএসএফের পতাকা বৈঠক
মার্কেটার্স ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত
অগ্রাধিকারমূলক কাজের তালিকা দিলেন উপদেষ্টা মাহফুজ
বাগেরহাটে চাঁদা আনতে গিয়ে নারীকে উত্যক্ত: গনপিটুনীতে নিহত ১
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সুর পাল্টালেন মমতা
সিলেট পর্বের ব্যবস্থাপনায় সন্তুষ্ট দর্শকরা
ডেঙ্গু প্রতিরোধে নিজ আঙিনা পরিস্কার রাখতে হবে: বিভাগীয় কমিশনার মোখতার
বিজিবি’র অভিযানে ডিসেম্বরে মাসে ১৪৭ কোটি ৮৪ লক্ষাধিক টাকার চোরাচালান পণ্যসামগ্রী জব্দ
চতুর্থ প্রজন্মের বেশিরভাগ ব্যাংকের মুনাফায় উল্লম্ফন
‘পতিত সরকারের সময় দেশের টাকা বিদেশে পাচারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন’
খালেদা জিয়ার লন্ডন যাত্রায় সফরসঙ্গী হচ্ছেন যারা
মানিকগঞ্জে ফাঁস দিয়ে গৃহবধূর আত্মহত্যা
কোটালীপাড়ায় আমতলী ইউনিয়ন বিএনপির নবনির্বাচিত সভাপতি তুহিন খান কে এলাকাবাসীর গণসংবর্ধনা
ঈশ্বরগঞ্জে তরুণদের নিয়ে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত
বোরাক রিয়েল এস্টেটের ৪০০ কোটি টাকার আইপিও আবেদন বাতিল করেছে বিএসইসি
চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজে বাস উপহার দিল আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক
জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে সহযোগিতা করবে সরকার: তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা