পচা সবজি, ফল ও ময়লার দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে পানি থেকে

ধুঁকে ধুঁকে মরছে বুড়িগঙ্গা নদী

Daily Inqilab ওবায়দুল ইসলাম

১৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৫ এএম

দিন দিন কমেছে নদীর নাব্যতা ও তীরের আয়তন
বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠেছিলো রাজধানী ঢাকা। পৃথিবীর প্রায় সব রাজধানি গড়ে ওঠেছিলো নদীকে কেন্দ্র করে। অতীতে বাণ্যিজিক পথে এ নদীর তীরে ভিড়ানো থাকত পৃথীবির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বাণ্যিজিক জাহাজ যার ইতিহাস এখনো অমলিন রয়েছে, সেই সময়ের নানা দুর্লভ ছবি এখনো সাজানো রয়েছে বুড়িগঙ্গার পাশে অবস্থিত আহসান মঞ্জিল জাদুঘরের দেয়ালে দেয়ালে। সানশৈকতে পরিপূর্ণ এ নদীটি যেন শহরবাসীর ব্যবহারে ধুকে ধুকে মৃত্যুর পথযাত্রী। শিল্পকারখানা, ঢাকা ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, গৃহস্থালী, হাটবাজার ও নৌযানের বর্জ্যসহ শহরের সব ময়লা, আবর্জনা ফেলা হচ্ছে নদীতে, নদীর দুই পাড় দখল করে গড়ে ওঠেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। জাহাজ নির্মাণ শিল্পের কারণে নদীর পাড় দিনে দিনে হচ্ছে সংকোচিত। বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত সদরঘাট, ওয়াইজঘাট, শ্যামবাজার, বাদামতলী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নদীর পাড়ে ফেলা হচ্ছে শ্যামবাজারের পচা সবজি, বাদামতলীর পচা ফল এবং বিভিন্ন হোটেল-দোকানপাটের ময়লা-আবর্জনা। সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি থাকলেও নিয়মবহিভর্‚তভাবে ফেলা হচ্ছে এসব ময়লা। ফলে এসব ময়লা পানির সঙ্গে মিশে সৃষ্টি হচ্ছে দুর্গন্ধ। প্রতি মুহূর্তে নদীর ভেতর ফেলা হচ্ছে পানি দূষণকারী বর্জ্য। এছাড়া দেখা যায়, সদরঘাট ও ওয়াইজঘাটসহ কয়েকটি জায়গায় স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে নদীতে আসছে ঢাকা সিটির ময়লা পানি। এতে নদীর পানি আরো কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত করছে। ফলে বুড়িগঙ্গার বড় অংশেই দেখা মেলে না জলজ প্রাণী বা মাছের। কেবল দেখা মেলে খাওয়ার অনুপযোগী সাকার মাছ, যা অন্যান্য মাছের বাস্তুসংস্থান ধ্বংসের জন্য দায়ী। সাকার মাছের জন্য বুড়িগঙ্গা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অন্য মাছও। এদিকে, দেশের অন্যতম বৃহৎ বুড়িগঙ্গা নদীর উৎসমুখ চুনার থেকে বসিলা হয়ে লালবাগ-লোহারপুল পর্যন্ত আদি বুড়িগঙ্গার পাড় দখল করে নানা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ও শিল্প কারখানার মতো বৃহৎ প্রকল্প ও ব্যাপক আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে। এ নদীর জায়গা দখল করে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও গড়ে উঠছে স্থাপনা। ফলে কমেছে নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা। কমছে পানি প্রবাহও। নদীতে অতিরিক্ত ময়লা ফেলার কারণে তলদেশের নাব্যতা কমেছে, ফলে ভেসে উঠছে চর। বুড়িগঙ্গাকে উদ্ধার করে হাতিরঝিলের আদলে প্রকল্প নেয়া যেতে পারে।
বর্তমান সরকার এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে এখনো সম্ভব বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, বিগত সরকারের আমলে ২০০৯ সালে বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধারে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প হাতে নেয়। তবে ভুল পরিকল্পনার কারণে দৃশ্যমান হয়নি বুড়িগঙ্গার অবস্থা। সেই প্রকল্পের খরচ ১ হাজার ২০০ কোটিতে গিয়ে ঠেকলেও আদতে বুড়িগঙ্গার কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রকল্পটি চালু অবস্থায়ই ২০১৬ সালে ঢাকার চারপাশের চারটি নদীর অবৈধ দখল ঠেকাতে ৮৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবিøউটিএ) আরেকটি প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পটির খরচ বাড়িয়ে এখন ১ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা করা হয়েছে। ঢাকার বুড়িগঙ্গাসহ এর চারপাশের নদীর পানি দূষণমুক্ত করতে ২০০৪ সালে একটি সমীক্ষা করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো)। এর ৬ বছর পর ৯৪৪ কোটি ৯ লাখ ৭ হাজার টাকা ব্যয়ে নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ নদী খনন নামে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। লক্ষ্য ছিলো যমুনা থেকে পানি এনে বুড়িগঙ্গাসহ চারটি নদীর দূষণ রোধ করা। তবে এখনো যমুনার পানি বুড়িগঙ্গায় গড়ায়নি। রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের তথ্য মতে, বুড়িগঙ্গা রক্ষায় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা এরই মধ্যে খরচ করেছে সরকার। এই টাকার বেশিরভাগ দুর্নীতির মাধ্যমে গিলে শেষ করেছে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলা ও মন্ত্রীরা। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, স্যুয়ারেজ লাইনগুলোতে ‘ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’ বসালে অনেক সুফল মিলবে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সূত্রে জানা যায়, গত ৮ নভেম্বর বুড়িগঙ্গা নদীর দখল ও দূষণরোধে আশু ব্যবস্থা নেয়া, দূষণ ও দখলকারীদের জরিমানা এবং রাজধানীর চারদিকে বৃত্তাকার নৌপথ চালু করাসহ সাত দফা দাবিতে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় সোয়ারিঘাটে মানববন্ধন করে সংগঠনটি। তবে এখন পর্যন্ত বাপার এসব দাবি পূরণে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। নদী পারাপারের মাঝি ফজলুল হক বলেন, ‘আমি ২৫ বছর যাবত এখানে নৌকা চালাই। চোখের সামনে এ নদীর অনেক পরিবর্তন দেখেছি। আমি যখন এখানে আসি তখন এনদরি পানি স্বচ্ছ ছিলো, আমরা গোসল করতাম। বর্ষাকালে নদীর স্রোতে হালকা-পাতলা ময়লা ভেসে যেত কিন্তু এখন এতো বেশি ময়লা আর দুইপাশ এতো ছোট হয়েছে যে নদী বলতে কিছু নাই। পানির ব্যাপক গন্ধ, ব্যবহার করা যায় না। মানুষের সচেতনতার অভাবের কারণেই এমন হয়েছে।’ বুড়িগঙ্গার দখল ও দূষণ বিষয়ে বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক অর্থ বিষয়ক সম্পাদক প্রকৌশলী মো. শাহরিয়ার সুলতান বলেন, বুড়িগঙ্গা দূষণের বড় কারণ হলো, নদী তীরের শিল্প কলকারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হয়। বুড়িগঙ্গা নষ্ট হওয়ার আরেকটি কারণ দখল। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশন বুড়িগঙ্গা দখলের জন্য ২৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও স্থাপনাকে দায়ী করে। নদীকে রক্ষা করতে হলে এগুলো উচ্ছেদ করতে হবে। একই সঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের কোনো পয়োবর্জ্য যেন নিষ্কাশন ছাড়া নদীতে না ফেলা হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি যারা নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

 


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

‘মার্চ ফর গাজা’র রোষের শিকার হয়ে দেশে ফিরলেন শতাধিক বাংলাদেশি
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালনের আহ্বান জামায়াতের
রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন ছাড়া কিছু সম্ভব নয়: সিইসির মন্তব্য
পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধন করলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস
প্রবাসীদের জন্য ‘আউট অব কান্ট্রি ভোটিং’ চালু করতে চাই: সিইসি
আরও
X

আরও পড়ুন

হাজীগঞ্জ নিখোঁজ কলেজ ছাত্রের লাশ ডাকাতিয়া নদী থেকে উদ্ধার

হাজীগঞ্জ নিখোঁজ কলেজ ছাত্রের লাশ ডাকাতিয়া নদী থেকে উদ্ধার

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বন্ধের ঘটনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বন্ধের ঘটনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন

‘মার্চ ফর গাজা’র রোষের শিকার হয়ে দেশে ফিরলেন শতাধিক বাংলাদেশি

‘মার্চ ফর গাজা’র রোষের শিকার হয়ে দেশে ফিরলেন শতাধিক বাংলাদেশি

পাকিস্তানে ভয়াবহ বিস্ফোরণ,  নিহত অন্তত ৯ জন

পাকিস্তানে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, নিহত অন্তত ৯ জন

সীমানারেখায় ঝুলছে পদ্মাচরের লাখো মানুষের ভাগ্য

সীমানারেখায় ঝুলছে পদ্মাচরের লাখো মানুষের ভাগ্য

পাকিস্তানে তেলবাহী ট্যাংকারে বিস্ফোরণে দগ্ধ ৬০, নিহত ১

পাকিস্তানে তেলবাহী ট্যাংকারে বিস্ফোরণে দগ্ধ ৬০, নিহত ১

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালনের আহ্বান জামায়াতের

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালনের আহ্বান জামায়াতের

ইয়েমেনে হামলা চালাতে গিয়ে সাগরে ডুবে গেল সর্বাধুনিক মার্কিন যুদ্ধবিমান

ইয়েমেনে হামলা চালাতে গিয়ে সাগরে ডুবে গেল সর্বাধুনিক মার্কিন যুদ্ধবিমান

রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন ছাড়া কিছু সম্ভব নয়: সিইসির মন্তব্য

রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন ছাড়া কিছু সম্ভব নয়: সিইসির মন্তব্য

পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধন করলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস

পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধন করলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস

ভারতে এবার মুসলিম পুলিশ সদস্যের ওপর হামলা

ভারতে এবার মুসলিম পুলিশ সদস্যের ওপর হামলা

বিদেশিনীর প্রেমে মজেছে সৃজিত,ভাঙনের সুর সংসারে!

বিদেশিনীর প্রেমে মজেছে সৃজিত,ভাঙনের সুর সংসারে!

প্রবাসীদের জন্য ‘আউট অব কান্ট্রি ভোটিং’ চালু করতে  চাই: সিইসি

প্রবাসীদের জন্য ‘আউট অব কান্ট্রি ভোটিং’ চালু করতে চাই: সিইসি

গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যের ওপর নির্ভর করবে সংলাপের সাফল্য: আলী রীয়াজ

গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যের ওপর নির্ভর করবে সংলাপের সাফল্য: আলী রীয়াজ

অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংসের পথে পাকুন্দিয়ার আওরঙ্গজেব মসজিদটি

অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংসের পথে পাকুন্দিয়ার আওরঙ্গজেব মসজিদটি

রুদ্ধদ্বার শুনানি, জামিন পাননি খালেদা জিয়ার ভাগনে সাবেক এমপি তুহিন

রুদ্ধদ্বার শুনানি, জামিন পাননি খালেদা জিয়ার ভাগনে সাবেক এমপি তুহিন

উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম, এলজিইডির ৩৬ দপ্তরে দুদকের একযোগে অভিযান

উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম, এলজিইডির ৩৬ দপ্তরে দুদকের একযোগে অভিযান

সাবেক বিচারপতি খায়রুল হকের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে মাগুরায় বিক্ষোভ সমাবেশ

সাবেক বিচারপতি খায়রুল হকের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে মাগুরায় বিক্ষোভ সমাবেশ

অনলাইন ক্যাসিনো বা জুয়া নিয়ে কিছু অজানা তথ্য

অনলাইন ক্যাসিনো বা জুয়া নিয়ে কিছু অজানা তথ্য

বনশ্রীর মেরাদিয়ায় কোরবানির পশুর হাট বন্ধে হাইকোর্টের আদেশ

বনশ্রীর মেরাদিয়ায় কোরবানির পশুর হাট বন্ধে হাইকোর্টের আদেশ