সাদাকাতুল-ফিত্র বা রোযার ফিদিয়া’র পরিমাণ

Daily Inqilab মুফতী মো: আব্দুল্লাহ্

১২ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:২৫ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১২:২০ পিএম

‘সাদাকাতুল ফিত্র’ : ‘সাদাকা’ মানে দান ‘আল-ফিত্র’ বলতে ‘ফিত্র’ এর দিন তথা ঈদের দিন উদ্দেশ্য। শব্দটি ‘আস্-সাওম’ এর বিপরীতার্থক হয়ে থাকে অর্থাৎ ‘সওম’ মানে রোযা রাখা, পানাহার বন্ধ এবং ‘আল-ফিত্র’ মানে রোযা ভাঙ্গা বা পানাহারের ব্যাপক অনুমতি, রোযা ভঙ্গ করার সুযোগ প্রাপ্তি বা সিয়াম সাধনার কষ্ট হতে মুক্ত হওয়া। আর এই কষ্ট হতে মুক্তির কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কিছু দান করাকেই প্রকারান্তরে সাদাকাতুল-ফিত্র বলা হয়। অন্যভাবে এটিকে আকর গ্রন্থাদির আলোচনায় ‘যাকাতুল-ফিত্র’ ও বলা হয়েছে। ‘যাকাত’ মানে পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধি। একজন যাকাতদাতা যেমন প্রদত্ত যাকাতের মাধ্যমে নিজ সম্পদের পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধি পেয়ে থাকেন ঠিক তদ্রুপ একজন ফিতরাদাতাও ফিত্রা দানের দ্বারা তাঁর পালিত দীর্ঘ একমাসের সিয়াম সাধনার ত্রুটি-বিচ্যুতির ঘাটতিপূরণ ও পরিশুদ্ধি প্রাপ্তির জন্য আল্লাহ্র রাহে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে দান উৎসর্গ করে থাকেন। সাদাকাতুল-ফিত্রার এ দু’টি দিক রোযাদারের নিজের কল্যাণ বিবেচনায় হয়ে থাকে। এর আরেকটি বিবেচ্য কল্যাণ ফিত্রা-গ্রহিতাদের বেলায় গণ্য করা হয়। তা হচ্ছে, এক মাস সিয়াম সাধনার পরে যে আনন্দঘন ঈদ-উৎসব পালিত হবে এবং মহান সত্তার পক্ষ থেকে সকলের জন্য ঈদের সালাতের মাধ্যমে যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হবে সেখানে ও সেদিনে আত্মিক আনন্দের পাশাপাশি জাগতিক বাহ্যিক আনন্দ-খুশিতেও যেন তাঁদেরই সমাজের একটা অংশ গরীব, অসহায় সদস্যরাও যেন আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারে সে জন্য তাদের সাহায্যার্থে ‘সাদাকাতুল-ফিত্র’ নামের এ দান শরীয়তে ওয়াজিব করে দেয়া হয়েছে।
আল্লামা শামী র. এর মতে, সিয়াম সাধনার মাধ্যমে যেমন আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জিত হয়েছে ঠিক তেমনি এ ফিত্রা নামে একটা সাদাকা দানের মাধ্যমে তার দৈহিক পরিশুদ্ধিরও একটা তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার নামই ‘সাদাকাতুল-ফিত্র’। যা কিনা হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর সূত্রে বর্ণিত সংশ্লিষ্ট হাদীসখানা থেকেও বোঝা যাচ্ছে, অর্থাৎÑ
“সিয়ামরত অবস্থায় অনর্থ-অহেতুক ও অশ্লীল কর্মকান্ডের দ্বারা রোযার মধ্যে যে ত্রুটি-বিচ্যুতি সংঘটিত হয়েছে তা থেকে পবিত্রতা অর্জন, ঘাটতি পূরণ ফিত্রা ওয়াজিব হওয়ার পিছনে অন্যতম কারণ। একইভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠির খাবারের একটা ব্যবস্থাও তার অন্যতম আরেকটি কারণ। ফিত্রা কবে থেকে ওয়াজিব হল? কিবলা পরিবর্তনের পর যাকাত ফরয হওয়ার পূর্বে যে বছর শা‘বান মাসে সওম ফরয হয়েছিল ওই বছরেরই রোযার শেষের দিকে ঈদের দুইদিন পূর্বে সাদাকাতুল-ফিত্রও ওয়াজিব হয়েছিল।
ফিতরার পরিমাণ : ‘সাদাকাতুল-ফিত্র’ যদি গম বা আটা দ্বারা আদায় করা হয় সেক্ষেত্রে ইমাম আবূ হানীফার. এর মতে তার পরিমাণ হবে ‘অর্ধ-সা‘। অনুসন্ধান ও সমন্বয় করতে গিয়ে এই অর্ধ-সা‘ বলতে ব্যাপকহারে উপ-মহাদেশের আলেমগণ ১৩৫ তোলা স্থির করেছেন। ১ তোলা সমান = ১১ গ্রাম ৬৬৪ মি. গ্রাম *১৩৫= ১, ৫৭৪. ৬৪০ মি.গ্রাম। অর্থাৎ ১ কেজি, ৫৭৪গ্রাম ও ৬৪০মি. গ্রাম। অন্যভাবে বলা যায় যে, দেড় কেজি ও ৭৪গ্রা. এর চেয়ে একটু বেশি। অর্থাৎ সামান্য কম ১৬০০ গ্রাম বা ১ কেজি ৬০০গ্রাম। এ পমিাণের আটা কিংবা তার মূল্যও আদায় করা যেতে পারে। দারুল উলূম দেওবন্দ এর একজন জুনিয়র উস্তাদ মাওলানা রফ‘আত কাসেমীর সংকলিত ‘মাছায়েলে রোযা’ গ্রন্থে কোন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ব্যতীত এভাবে ব্রাকেটে উল্লেখ করা হয়েছে, “পোনে দো কিলো (এক কিলো ৬৩৩গ্রাম) গম বা আটা”।
উল্লেখ্য, মরহুম খতীব হযরত মাওলানা উবায়দুল হক র. এর জীবদ্দশায় (২০০৬খ্রি.) আমরা সর্বশেষ প্রচলিত কেজি হিসাবের অনুসন্ধান ও সমন্বয়ের সুবিধার্থে পাকিস্তান, মিসর, সৌদিআরব ইত্যাদি দেশের দারুল-ইফতা ও রাষ্ট্রীয়ভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত শরীয়া বোর্ড/কমিটির লিখিত ডকুমেন্টস্ সংগ্রহ করেছিলাম। ওই বছরই খতীব মহোদয়ের সভাপতিত্বে ‘সা‘’/নিছফে-সা‘/ মুদ্দ বা মুদ্দানে, ইরাকী ও হেজাযী পরিমাপকের তুলনা এবং প্রাক্তন সের হিসাব ও বর্তমানকার কেজি হিসাব ইত্যাদি সবকিছু সামনে রেখে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এল ‘নিছফে-সা‘ ১ কেজি ৬২৫গ্রাম; কিংবা ১ কেজি ৬৩৩গ্রাম; কিংবা ১ কেজি ৬৫০গ্রামের চেয়ে কিছু বেশি দাঁড়ায়। জাতীয়ভাবে ফিত্রা আদায়ের সুবিধার্থে সকলের ও সার্বিক আলোচনার পর গৃহীত সিদ্ধান্তে বলা হয়, “নিছফে- সা‘ হল ১ কেজি ৬৫০গ্রাম”। তখন থেকে আজ পর্যন্ত (২০২১খ্রি.) এই একই হার সামনে রেখে তারই ধারাবাহিকতায় আমরা সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকি যে, “জনপ্রতি ফিত্রা হবে: Ñযদি তা গম বা আটা দ্বারা দেয়া হয় সেক্ষেত্রে নিছফে সা‘ তথা ১ কেজি ৬৫০গ্রাম; অপরাপর খেজুর, কিশমিশ, পনির, যব-বার্লি ইত্যাদি দ্বারা দেয়া হলে সেক্ষেত্রে দিতে হবে এক সা‘ তথা ৩ কেজি ৩০০গ্রাম” মুফতী-ইফা।
গম/আটা ব্যতীত অন্যকিছু দ্বারা ফিত্রা আদায়:
গম বা আটার পরিবর্তে কেউ যদি অন্য কোন খাদ্য-খাবারের দ্বারা সাদাকাতুল-ফিত্র আদায় করতে চায় সেক্ষেত্রে তাঁকে এর দ্বিগুণ পরিমাণ দ্বারা আদায় করতে হবে। ফকীহগণ যদিও এমনটি লিখেছেন যে, যে-ক্ষেত্রে খেজুর, কিশমিশ ও যব ব্যতীত অন্য কোন খাদ্য-পণ্যের দ্বারা ফিতরা প্রদান করা হবে সেক্ষেত্রে গম বা আটার মূল্যমান ধর্তব্য হবে। ‘অর্ধ-সা‘ গম বা আটার দামে যে-পরিমাণ খাদ্যপণ্য পাওয়া যাবে সে-পরিমাণ আদায় করলেই যথেষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু হাদীসের বাক্য দ্বারা স্পষ্টত বোঝা যায়, গম বা আটা ব্যতীত অন্য খাদ্যপণ্য যা-ই ফিতরা হিসাবে প্রদান করা হোক সেক্ষেত্রে তা ‘এক সা‘ (১) হওয়া চাই। যেমন হাদীস শরীফে এসেছেÑ “জেনে রেখো! সাদাকাতুল ফিত্র প্রত্যেক মুসলামান পুরুষ বা নারী, মুক্ত-স্বাধীন বা ক্রীতদাস, ছোট বা বড় সকলের ওপর ওয়াজিব Ñতা দুই মুদ্দ (=অর্ধ সা‘) গম/আটা; অথবা গম-আটা ব্যতীত অপর কোন খাদ্য-পণ্য হলে সেক্ষেত্রে ১সা‘ পরিমাণ আদায় করতে হবে”। এ কারণে উত্তম হবে, হয়তো সরাসরি গম বা আটা দ্বারাই আদায় করা চাই অথবা তার দাম বা মূল্যমান নির্ধারণ করে টাকার অংকে তা পরিশোধ করা চাই। আর যদি তা অপর কোন খাদ্য-পণ্যের দ্বারা আদায় করতে চায় সেক্ষেত্রে গম/আটা’র দ্বিগুণ বা ডাবল পরিমাণে আদায় করা চাই”। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফতী সাহেব বলছেন :“(১)গবেষক মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ্ রাহমানী হাদীসটি পেশ করে বলতে চেয়েছেন : ‘গম/আটা ব্যতীত কেউ যদি অন্য খাদ্যপণ্য দ্বারা ফিত্রা আদায় করতে চায় সেক্ষেত্রে যাঁদের গবেষণ সূত্রে বলা হয়েছে যে, ওই সেই ‘অর্ধ সা‘ গমের দামে যতটুকু বা যে-পরিমাণ চাল/ডাল/আলু ইত্যাদি স্থির হয় ততটুকু আদায় করা চাই Ñএমন বক্তব্য বা অভিমত ঠিক নয় বা মান্যযোগ্য নয়। কেননা সরাসরি হাদীস দ্বারা তেমনটি বোঝা যাচ্ছে না; হাদীস দ্বারা বরং স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, “অপর কোন খাদ্য-খাবার, খাদ্যপণ্য দ্বারা ফিত্রা আদায় করতে গেলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই পুরোপুরি ১সা‘ (তথা ৩ কেজি ৩০০গ্রাম)ই আদায় করা চাই। (চলবে)

লেখক: মুফতী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বিশ্ব বাজারে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম

বিশ্ব বাজারে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম

বুশরা বিবির খাবারে ‘টয়লেট ক্লিনার’ মেশানোর অভিযোগ

বুশরা বিবির খাবারে ‘টয়লেট ক্লিনার’ মেশানোর অভিযোগ

মোদির হিন্দুত্বের তাস দক্ষিণ ভারতে ব্যর্থ

মোদির হিন্দুত্বের তাস দক্ষিণ ভারতে ব্যর্থ

মন্দিরে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে তদন্তভিত্তিক বিচারের দাবি

মন্দিরে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে তদন্তভিত্তিক বিচারের দাবি

কুষ্টিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় সাংবাদিকের মৃত্যু

কুষ্টিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় সাংবাদিকের মৃত্যু

ফতুল্লায় ৫ যুবক আটক, ‘ডাকাতির প্রস্তুতি’র অভিযোগ

ফতুল্লায় ৫ যুবক আটক, ‘ডাকাতির প্রস্তুতি’র অভিযোগ

তীব্র তাপদহে বৈরী আবহাওয়া, ভোরে কুয়াশা, মসজিদে মসজিদে বিশেষ দোওয়া অনুষ্ঠিত

তীব্র তাপদহে বৈরী আবহাওয়া, ভোরে কুয়াশা, মসজিদে মসজিদে বিশেষ দোওয়া অনুষ্ঠিত

গাজায় ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে লাগতে পারে ১৪ বছর : জাতিসংঘ

গাজায় ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে লাগতে পারে ১৪ বছর : জাতিসংঘ

মোদির গোলামির জিঞ্জিরে দেশকে আবদ্ধ করেছে সরকার -মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম

মোদির গোলামির জিঞ্জিরে দেশকে আবদ্ধ করেছে সরকার -মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম

ফরিদগঞ্জে বিয়ে না দেওয়ায় মাকে গলা কেটে হত্যা

ফরিদগঞ্জে বিয়ে না দেওয়ায় মাকে গলা কেটে হত্যা

মির্জাপুরে রাজশাহী সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন ১০ যাত্রী আহত

মির্জাপুরে রাজশাহী সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন ১০ যাত্রী আহত

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রশ্নবিদ্ধ তথ্য প্রচারের নিন্দা ডিআরইউর

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রশ্নবিদ্ধ তথ্য প্রচারের নিন্দা ডিআরইউর

দু’সহোদর হাফেজ শ্রমিক হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে -মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ

দু’সহোদর হাফেজ শ্রমিক হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে -মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ

উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীদের কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ দিচ্ছেন অসাধু কর কর্মকর্তারা : সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে

উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীদের কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ দিচ্ছেন অসাধু কর কর্মকর্তারা : সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে

মায়ের দূর সম্পর্কের বোনকে বিয়ে করা প্রসঙ্গে।

মায়ের দূর সম্পর্কের বোনকে বিয়ে করা প্রসঙ্গে।

গরমে অতিষ্ঠ রাবি শিক্ষার্থীরা

গরমে অতিষ্ঠ রাবি শিক্ষার্থীরা

পানির সংকট বাড়ছে

পানির সংকট বাড়ছে

ঋণ না বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে

ঋণ না বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে?

চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাত

চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাত