সেহ্রি খাওয়ার গুরুত্ব ও উপকারিতা
২৬ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:১১ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৪:০৮ এএম
চান্দ্রবর্ষের মাসগুলোর মধ্যে মাহে রমযান অত্যন্ত পবিত্রতম ও তাৎপর্যম-িত মাস। এ মাসের প্রতিটি আমল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তন্মধ্যে প্রধানতম আমল হলো মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা তথা রোযা পালন করা। আর রোযার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো সেহ্রি। সেহ্রি খাওয়ার গুরুত্ব ও উপকারিতা সম্পর্কে বিভিন্ন রেওয়ায়েত থেকে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (স.) নিজে সেহ্রি খেতেন এবং অন্যদেরকেও সেহ্রি খেতে উৎসাহিত করেছেন।
‘সেহ্রি’ শব্দটি আরবি ‘সাহর’ বা ‘সুহুর’ শব্দ থেকে উৎকলিত। যার অর্থ রাতের শেষাংশ। আবার সেহ্রি উর্দু ভাষাতেও ব্যবহৃত হওয়া একটি শব্দ যা পরবর্তীতে বাংলা ভাষাতেও প্রচলিত হয়ে গেছে। এর শাব্দিক অর্থ ঘুম থেকে জেগে ওঠা, নিদ্রাভঙ্গ, রাত্রি জাগরণ ইত্যাদি। মুসলমানগণ আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের আশায় রোযা রাখার উদ্দেশ্যে রাতের শেষ অংশের নির্দিষ্ট সময়ে পানাহার এবং খাবার গ্রহণ করে থাকেন আর এই খাবার গ্রহণ এবং পানাহার পর্বই হলো সেহ্রি। এক কথায় রোযার উদ্দেশ্যে ভোর রাতের খাবারকে আরবিতে সুহুর বা সাহর বলা হয়।উপবাস থাকার জন্য শেষ রাতে পানাহার করাকেই সেহ্রি নামে অভিহিত করা হয়। আর ইসলামের দৃষ্টিতে রোযার নিয়্যতে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার নাম রোযা। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (স.) বলেছেন, ‘আমাদের ও আহলে কিতাবের রোযার মাঝে পার্থক্য হলো সেহ্রি খাওয়া। (সহিহ্ মুসলিম: ১০৯৬)
সেহ্রি খাওয়ার সময়সীমা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা পানাহার করো, যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রাত পর্যন্ত রোযা পূর্ণ করো। (সূরা আল বাকারা: ১৮৭)
ইসলামি শরিয়াহ্ মতে, ক্ষুধা না থাকলেও অল্প পরিমাণে হলেও সেহ্রি খাওয়া উচিত। সামান্য একটু পানি পান করাকেও সেহ্রি হিসেবে গণ্য করা হয়। হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবি (স.) বলেছেন, সেহ্রি খাওয়ার মাঝে রয়েছে অনেক বরকত। একে পরিত্যাগ করো না, যদিও এক ঢোক পানির মাধ্যমে হয়। যারা সেহ্রি খায়, তাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহ্র দয়া ও ফেরেশতাদের দোয়া।( মুসনাদে আহমদ: ১১১০১)
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবি (স.) বলেছেন, সেহ্রি খাওয়ার মাধ্যমে দিনের রোযা পূর্ণ করার জন্য সাহায্য নাও এবং দুপুরে ঘুমের মাধ্যমে রাতের নামাযের জন্য সাহায্য নাও।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ্ : ১৬৯৩)
সারাদিন রোযার উদ্দেশ্যে উপবাস থাকার জন্য শেষ রাতে পানাহার জরুরী। এতে করে পানাহার থেকে বিরত থাকার পরিমাণের মাত্রা হ্রাস করা হয়। শেষ রাতে না খেয়ে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানের কারণে শরীর অত্যধিক দুর্বল হয়ে পড়বে। রোযার মাধ্যমে মানুষকে এতো বেশি দুর্বল করা আল্লাহ্র উদ্দেশ্য নয়। এ কারণেই আল্লাহ্ তায়ালা দিনে আহার-পানাহার নিষিদ্ধ করেছেন। তাই রাত্রে প্রয়োজনীয় খাবার খাওয়া খুবই যুক্তিসঙ্গত। সেহ্রি গ্রহণ করা সুন্নত। রাসূল (স.) শেষ রাতে পানাহার করতেন এবং সুব্হে সাদিক থেকে রোযা রাখতেন। সেহ্রি খাওয়ার মধ্যে যথেষ্ট সওয়াব, কল্যাণ ও বরকত রয়েছে। (সহিহ্ মুসলিম: ২৬০৩)
সেহ্রি খাওয়াতে বরকত থাকার বিষয়টি অতি সুস্পষ্ট। কারণ এতে রাসূলুল্লাহ্ (স.) এর সুন্নাতের অনুসরণ করা হয় এবং সেহ্রি খাওয়াতে রোযাদার সারাদিন শক্তিশালী থাকে। রাসূলুল্লাহ্ (স.) এর সুন্নাত হলো ফজরের কিছু পূর্বে সেহ্রি খাওয়া অর্থাৎ দেরীতে খাওয়া। রাসূলুল্লাহ্ (স.) বলেন, শেষ রাতের খাদ্য গ্রহণ করো তাতে বরকত রয়েছে। (বুখারী ও মুসলিম)
হালাল হওয়ার শর্তে সেহ্রি খাবারের কোনো হিসেব নেই। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। নবি (স.) বলেছেন, তিন ব্যক্তির খাবার গ্রহণের কোনো হিসাব হবে না শর্ত হলো খাবার হালাল হতে হবে। ব্যক্তি ৩ জন হলেন- ১. রোযাদার, ২. সেহ্রি গ্রহণকারী ও ৩. মুজাহিদ। (তাবরানি শরিফ, আল মু’জামুল কাবির: ১২০১২)
সেহ্রি খাওয়া ফরজ বা ওয়াজিব নয় বরং সুন্নাত (সুন্নাতে মুয়াক্কাদা)। কোনো কারণে সেহ্রি খেতে না পারলে সিয়াম পালনে কোনো ধরনের অসুবিধা বা আপত্তি নেই। কেউ যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে সেহ্রি খাওয়া থেকে বিরত থাকে তবুও সে রোযার নিয়্যত করে তা পালন করতে পারেন। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে সেহ্রি না খাওয়া অনুচিত।
তাইতো মহানবি (স.) বলেন, আমাদের ও ইয়াহুদি-নাসারাদের রোযার পার্থক্য হলো সেহ্রি খাওয়া। (সহিহ্ মুসলিম: ২৬০৪) নবি করিম (সা.) সব সময় রোযা পালনের উদ্দেশ্যে সেহ্রি খেতেন। সেইসাথে তিনি তাঁর প্রিয় উম্মতকেও সেহ্রি খেতে উৎসাহিত করেছেন।
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবি করিম (সা.) বলেছেন, তোমরা সেহ্রি খাও। কেননা, সেহ্রিতে বরকত রয়েছে। (সহিহ্ বুখারি: ১৭৮৯) সেহ্রি খাওয়ার মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সুন্নাতের উপর আমল করা হয়। সেহ্রি খাওয়ার মধ্যে অফুরন্ত রহমত, বরকত, নিয়ামত ও কল্যাণ আছে।
সেহ্রি খাওয়ার মাধ্যমে রোযা রাখার শক্তি অর্জিত হয়। সেহ্রি খেলে রোযাদার সহজে দুর্বল ও মনোবলহীন হয়ে পড়েন না, সারাদিন দীর্ঘ সময়ের উপবাস বা অনাহারে থাকলেও কর্মঠ থাকার প্রাণশক্তি আসে এবং সিয়াম পালন সহ্যসীমার মধ্যে থাকে। রমযান মাসে রোযাদার ব্যক্তি যদি নিয়মিত সেহ্রি না খান, তাহলে অত্যন্ত ক্লান্ত-শ্রান্ত-অবসন্ন হয়ে পড়বেন। ফলে পরের দিন রোযা রাখার সাহস হারিয়ে ফেলবেন এবং কাহিল হয়ে পড়তে পারেন। দৈনন্দিন ইবাদতেও অলসতা কাজ করতে পারে। অতিরিক্ত ক্ষুধায় কর্মশক্তি লোপ পাবে। পক্ষান্তরে ওই রোযাদার ব্যক্তি যদি শেষরাতে পরিমাণমতো সেহ্রি খেয়ে পুরো দিন না খেয়ে থাকার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন, তবে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে মজবুত থাকেন এবং অতিশয় ক্ষুধায় তেমন কষ্ট পাবেন না। এখানে সেহ্রি খাওয়ার গুরুত্ব ও উপকারিতা খুঁজে পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ্ (স.) সেহ্রি ও ইফতারের সীমা নির্ধারণ করে উম্মতের জন্য রোযা পালন সহজ করে দিয়েছেন।
রমযান মাসে সেহ্রি যথাসম্ভব দেরি করে খাওয়া ভালো। তবে সুব্হে সাদিকের আগে রাতের শেষভাগে সেহ্রি খাওয়া মুস্তাহাব বা পছন্দনীয়। তবে যদি নিদ্রা বা অন্য কোনো কারণে কেউ সেহ্রি খেতে না পারেন এমতাবস্থায়ও রোযা রাখা দুরস্ত আছে। এতে তার রোযার কোনো ক্ষতি হবে না। সেহ্রি না খাওয়ার কারণে রোযা ছেড়ে দেওয়া অত্যন্ত গুণাহের কাজ। যতক্ষণ পর্যন্ত সুব্হে সাদিক না হয় অর্থাৎ পূর্ব দিগন্তে সাদা বর্ণ না দেখা যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত সেহ্রি খাওয়া দুরস্ত আছে। সেহ্রি খাওয়ার সময়সীমা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে কারিমায় আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা পানাহার করো, যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিস্কার দেখা যায়। অতঃপর রাত পর্যন্ত রোযা পূর্ণ করো।’ (সূরা বাকারা: ১৮৭)
সেহ্রি খাওয়ার সুন্নত সময় হলো একেবারে শেষ সময়ে অর্থাৎ সুব্হে সাদিকের নিকটতম পূর্ব সময়ে। হযরত যায়েদ বিন সাবিত (রা.) বলেন, আমরা আল্লাহ্র রাসূল (স.) এর সঙ্গে সেহরি খেতাম। অতঃপর তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, সেহ্রি ও নামাজের (ফজরের)মধ্যে কী পরিমাণ সময় ছিল? তিনি উত্তরে বললেন, পঞ্চাশ আয়াত তিলাওয়াতের সময়।’ মোটকথা সেহ্রি দেরিতে খাওয়া উত্তম। সেহ্রিতে যে কোনো খাবার খাওয়া যেতে পারে।
তবে সেহ্রিতে খেজুর খাওয়া খুবই উত্তম। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। নবি (স.) বলেছেন, ‘মু’মিনের উত্তম সেহ্রি খেজুর।’ (সুনানে আবু দাউদ: ২৩৪৫)
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করি আর হাসিনার ভরসা ভারতে -দুলু
বাংলাদেশের গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে কমিশন
২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে মত বিএনপির যুগপৎ সঙ্গীদের
ঢাকায় ‘হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) বিশ্বের নারীদের আদর্শ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
চার ভাগে ফিরবেন ক্রিকেটাররা
চাঁদাবাজদের ক্ষমতায় আসতে দেবেন না: হাসনাত
এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের বরাদ্দ পেল বাফুফে
ইজতেমা মাঠকে যারা খুনের মাঠে পরিণত করেছে তারা সন্ত্রাসী
আসছে ভিভোর এক্স সিরিজের নতুন ফ্ল্যাগশিপ
বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ২ ভারতীয় নাগরিককে স্বদেশে ফেরত
মুন্সীগঞ্জে বিএনপি’র দু পক্ষে সংঘর্ষ,৩ জন গুলিবিদ্ব সহ আহত ১০
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিব-তামিমকে পাওয়া যাবে: ফারুক
ইজতেমা মাঠে হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করুন
কলাপাড়ায় অটোরিকশা উল্টে শিশুর মৃত্যু
আগামীকাল পঞ্চগড়ে বিএনপির জনসমাবেশ
ব্যাক্তিস্বার্থ পরিহার করে, দেশ ও দলের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে: ইলিয়াস পাটোয়ারী
সখিপুরে বিদ্যুৎষ্পৃষ্টে ডিস ব্যবসায়ীর মৃত্যু
যারাই সুযোগ পেয়েছে তারাই দেশের সাথে বেঈমানী করেছে: ডা. মু. তাহের
পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো মৌমাছি ও মধু সম্মেলন
শীতের দিনে ঝিরঝিরে বৃষ্টি স্থবির খুলনা শহুরে জীবন