রমাযান : অবধারিত রহমতের ধারা
২৬ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:১৪ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৫:৩৬ এএম
আল্লাহর অবারিত রহমতের বারতা নিয়ে প্রতি বছরই রমযান আসে। এবারও ঐ যে এলো রমাযান। রমযান যখন আসে তখন আমাদের মধ্যে দুই শ্রেনীর মানুষ খুব খুশি হয়। এক, মু’মিন-মুসলমান। কারণ তারা রমযানে অঝোর ধারায় বর্ষিত রহমতের বৃষ্টিতে অবগাহন করবে বা আল্লাহর বিশেষ রহমত দ্বারা নিজেদের সিক্ত করার জন্য রমযানের জন্য অপেক্ষা করছে। দুই, অবৈধ মজুতদার, মুনাফাখোর ও কালোবাজারীরা। মুনাফা লুটার অপার সুযোগ নিয়ে আসছে, তাই অর্ধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কি খুশি কি আনন্দ তাদের আকাশে ও বাতাসে। প্রথম শ্রেনীর আল্লাহর বান্দারা এ মাসে মানবতার প্রতি আরো বেশী করে দায়িত্বশীলতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তারা ভুল কর্মনীতি পরিহার করে সঠিক কর্মনীতি অবলম্বনের করেন। রমযানের অবারিত রহমতের বারিধারায় নিজেদের সিক্ত করতে কোন ভুল করেন না। তারা নিজেদেরকে এ মাসে মানবতার উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত করেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা সংযম প্রদর্শনের অনুশীলনে লিপ্ত হয়।
আর দ্বিতীয় শ্রেনীর মানবরূপী পশুগুলোর লোভের জিভটি এ মাসে এসে আরো লম্বা হয়। তারা দুনিয়ার স্বার্থ, স্বাদ ও আরাম আয়েশের কারণে রমযানকে এক বিরাট সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। দু’হাতে মুনাফা লুটার জন্য রমযানে বেপরোয়া হয়ে উঠে। মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লুণ্ঠনের জন্য কালোবাজারী ও খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণ করে। প্রবৃত্তির লালসার মোকাবেলা করার পরিবর্তে এরা তার সামনে নতজানু হয়। পার্থিব লোভ-লালসার জন্য আল্লাহর দেয়া অপার রহমতের সুযোগ-সুবিধাকে পরিত্যাগ করে দুনিয়ার লালসাকে চরিতার্থ করার জন্য সম্মানিত রোযাদারদেরকে কষ্ট দেয়। এ ধরণের লোভ-লালসার অধিকারী ব্যক্তিদেরকে আল্লাহ তা’আলা অত্যন্ত ঘৃণিত প্রাণীর সাথে তুলনা করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আমি চাইলে ঐ আয়াতগুলোর সাহায্যে তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করতাম কিন্তু সে তো দুনিয়ার প্রতিই ঝুঁকে রইল এবং নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করলো। কাজেই তার অবস্থা হয়ে গেলো কুকুরের মতো, তার উপর আক্রমণ করলেও সে জিভ ঝুলিয়ে রাখে আর আক্রমণ না করলেও জিভ ঝুলিয়ে রাখে। যারা আমার আয়াতকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে তাদের দৃষ্টান্ত এটাই। তুমি এ কাহিনী তাদেরকে শুনাতে থাকো, হয়তো তারা কিছু চিন্তা-ভাবনা করবে।” (আরাফ-১৭৬)
কুকুর হলো, উগ্র লালসা ও অতৃপ্ত কামনার এক প্রাণী। তার এই লালসা ও কামনার জন্য জিভটি সর্বদা ঝুলে থাকে এবং এ ঝুলন্ত জিভ থেকে অনবরত লালসার লালা টপকে পড়তে থাকে। চলাফেরার পথে তার নাক সব সময় মাটি শুকতে থাকে, হয়তো কোথাও কোন খাবারের গন্ধ পাওয়া যাবে এ আশায়। তার গায়ে কেউ কোন পাথর ছুঁড়ে মারলেও তার ভুল ভাঙ্গবে না। বরং তার মনে সন্দেহ জাগে, যে জিনিসটি তাকে মারা হয়েছে সেটি হয়তো কোন হাড় বা রুটির টুকরা হবে। পেট পূজারী লোভী কুকুর একবার লাফিয়ে দৌড়ে গিয়ে সেই নিক্ষিপ্ত পাথরটিও কামড়ে ধরে। পথিক তার দিকে দৃষ্টি না দিলেও দেখা যাবে সে লোভ-লালসার প্রতিমূর্তি হয়ে বিরাট আশায় বুক বেঁধে জিভ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। সে তার পেটের দৃষ্টি দিয়ে সারা দুনিয়াকে দেখে। কোথাও যদি কোন বড় ধরণের মরা গরু পড়ে থাকে, কয়েকটি কুকুরের পেট ভরার জন্য সেটি যতেষ্ঠ হলেও একটি কুকুর তার মধ্যে থেকে কেবলমাত্র তার নিজের অংশটি নিয়েও ক্ষান্ত হবে না বরং সেই সম্পূর্ণ লাশটি নিজের একার জন্যে আগলে রাখার চেষ্টা করবে এবং অন্য কাউকে তাঁর ধারের কাছেও ঘেঁষতে দেবে না। শকুন বা অন্য যে কোন প্রাণী কাছে এলে, সেগুলোর প্রতি সে তেড়ে যায়।
পেটের লালসার পর যদি দ্বিতীয় কোন বস্তু তার উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে তাহলে সেটি হচ্ছে যৌন লালসা। সারা শরীরের মধ্যে কেবলমাত্র লজ্জাস্থানটিই তার কাছে আকর্ষনীয় এবং সেটিরই সে ঘ্রাণ নিতে ও তাকেই চাটতে থাকে। কাজেই এখানে এ উপমা দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ কথাটি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা যে, দুনিয়া পূজারী ব্যক্তি যখন জ্ঞান ও ঈমানের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে প্রবৃত্তির অন্ধ লালসার কাছে আত্মসমর্পণ করে এগিয়ে চলতে থাকে তার অবস্থা পেট ও যৌনাঙ্গ সর্বস্ব কুকুরের মতো হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
সত্যিই আমাদের কিছু কিছু মুনাফাখোর ও কালোবাজারীদের অবস্থা ঠিক এই নিকৃষ্ট জীবটির মতোই। তার লোভের জিভটি সবসময় ঝুলে থাকে এবং ঝুলন্ত জীভ থেকে অনবরত লালসার লালা টপকে পড়তে থাকে। এদের উগ্র লালসার আগুন ও অতৃপ্ত কামনার কারণে সাধারণ মানুষ সবসময় চরম যন্ত্রণা পোহাতে হয়।
একেবারেই নূন্যতম মানবিক বিবেক যদি থাকতো তাহলে সারা বৎসর তার কামনা বাসনা চরিতার্থ করলেও, অন্তত রমযান এলে রোযাদারদের সম্মানে, রমযানের সম্মানে তারা দ্রব্যমূল্যের দাম স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখতে পারতো।
কিন্তু সেই নূন্যতম মানবিক মূল্যবোধটুকুও তার উগ্র লালসার কাছে পরাজিত হয়। পেট পূজারী লোভী জীবটির মতো এসমস্ত মুনাফাখোরেরা পেটের দৃষ্টি দিয়ে সারা দুনিয়াকে দেখে। তার কাছে এ সমস্ত রমযানের মর্যাদা বা ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশ একান্তই বৃথা। কারণ এরা লোভ-লালসার প্রতিমূর্তিতে পরিণত হয়। এজন্য ভালো কি মন্দ, সর্বাবস্থায়, সব জায়গায় এবং সব সময় তারা মুনাফা খুঁজতে থাকে। তার এই অত্যাধিক লোভের কারণে কত শত মানুষ কষ্টের শিকার হলো, কি পরিমাণ সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টি হলো এবং দেশের অর্থনীতির উপর কি পরিমাণ বিরূপ প্রভাব পড়লো এগুলো চিন্তা করার সময় তার থাকে না। দেশ গোল্লায় গেলেও তাদেরকে অবৈধ মজুদকরণ, কালোবাজারী, মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লুটকরণ ও খাদ্যে ভেজাল মিশ্রিত করতেই হবে। তারা এতটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে যে, অনেক শক্তিশালী সরকারকেও তাদের কাছে অসহায়ত্ব বরণ বা আত্মসমর্পণ করতে দেখা যায়। তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস করার মতো যেন কেউ নেই।
যে কোন অবস্থায় যে কোন মানুষকে কষ্ট দেয়া হারাম। কিন্তু রোযাদারকে কষ্ট দেয়া আরো মারাত্মক। এসমস্ত দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধিকারী কালোবাজারী, খাদ্যে ভেজাল মিশ্রিতকারী ও অবৈধ মজুতদারী লোকেরা যদি রোযাদার হন তাহলে তাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রোযা তোমাদের কি শিখায়? প্রকৃত রোযাদার তার কোন ভাইকে কখনো কষ্ট দিতে পারেন না। তার ভেতরে সকলের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হওয়ার কথা। কিন্তু এরপরও যদি কোন মুসলিম ভাই কালোবাজারী, মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা ও খাদ্যে ভেজাল মিশ্রিত করেন, তবে বুঝতে হবে তার রোযা শুধু শুধুই ক্ষুধা থাকা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। আর যারা রোযা রাখেন না তাদের ব্যাপারটি আল্লাহর হাতে সোপর্দ করা ছাড়া আর কি-ই বা থাকতে পারে। তবে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য উল্লেখিত নিকৃষ্ট জীবের স্বভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করা প্রয়োজন।
পৃথিবীর দেশে দেশে দেখা যায় যে, রমযান মাস এলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর বিশেষ মূল্যহ্রাস করা হয়। তারা সারা বৎসর মুনাফা করলেও এ মাসে এসে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখে অথবা কমিয়ে দেয়। তারা এ-ও জানে যে, এ মাসে সে যেই পরিমাণ ছাড় দিবে তা ৭০ গুণ বাড়িয়ে আল্লাহ তাকে দান করবেন। আল্লাহর এই বিশেষ পুরস্কারের প্রতি সম্মান জানাতে তারা কখনো কার্পণ্য করে না। রমযান তাদেরকে দয়াপরবশ করে তুলে। ব্যতিক্রম শুধু এই উপমহাদেশ। উদোর পরিপুষ্ট করার জন্য তারা রমযানকে বিশেষ সুযোগ মনে করে। রোযাদারকে কষ্ট দেয়ার এই মহা অন্যায় থেকে আমাদের সরকারও রেহাই পাবেন না। কারণ অবৈধ কালোবাজারী, মাত্রাতিরিক্ত মুনাফাখোর ও খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণকারীদের হাত থেকে দেশের মানুষকে উদ্ধার ও রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
কোনক্রমেই এ দায়িত্ব থেকে সরকার নিজেকে অব্যাহতি দিতে পারেন না। দায়িত্ব অবহেলার কারণে অবশ্যই অবৈধ কালোবাজারী ও ভেজাল মিশ্রিতকারীদের সাথে আল্লাহর কাঠগড়ায় তাদেরকেও দাঁড়াতে হবে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, তারা এতটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে যে, অনেক শক্তিশালী সরকারকেও তাদের কাছে অসহায়ত্ব বরণ বা আত্মসমর্পণ করতে দেখা যায়। তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস করার মতো কেউ নেই।
কিন্তু সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অবশ্যই তা সম্ভব। তবে এই অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করার জন্য অবশ্যই আল্লাহর দেয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মানুষের চিকিৎসা করতে হবে। সরকারের জন্য সেটি খুবই সহজ। সেই প্রেসক্রিপশন হলো, মানুষের মধ্যে নৈতিকতার বিকাশ সাধন করা।
নৈতিকতার বিকাশ সাধনের জন্য আল্লাহর অন্যান্য বিধানগুলোর সাথে সাথে রমযানকে প্রশিক্ষণের মাস হিসেবে বিশেষভাবে তদারকি করতে হবে। কারণ রমযান হলো মানুষের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টির কার্যকরী একটি প্রতিষ্ঠান। মনে রাখা প্রয়োজন, তাকওয়াই হলো সকল উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি।
তাকওয়া ছাড়া আর যতো কর্মসূচী গ্রহণ করা হোক না কেন, সমাজ পরিবর্তন হবে না। পরিবর্তন হবে না কালোবাজারীসহ অন্যান্য সামাজিক অপরাধ।
লেখক: শিক্ষাবিদ, গবেষক
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করি আর হাসিনার ভরসা ভারতে -দুলু
বাংলাদেশের গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে কমিশন
২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে মত বিএনপির যুগপৎ সঙ্গীদের
ঢাকায় ‘হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) বিশ্বের নারীদের আদর্শ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
চার ভাগে ফিরবেন ক্রিকেটাররা
চাঁদাবাজদের ক্ষমতায় আসতে দেবেন না: হাসনাত
এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের বরাদ্দ পেল বাফুফে
ইজতেমা মাঠকে যারা খুনের মাঠে পরিণত করেছে তারা সন্ত্রাসী
আসছে ভিভোর এক্স সিরিজের নতুন ফ্ল্যাগশিপ
বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ২ ভারতীয় নাগরিককে স্বদেশে ফেরত
মুন্সীগঞ্জে বিএনপি’র দু পক্ষে সংঘর্ষ,৩ জন গুলিবিদ্ব সহ আহত ১০
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিব-তামিমকে পাওয়া যাবে: ফারুক
ইজতেমা মাঠে হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করুন
কলাপাড়ায় অটোরিকশা উল্টে শিশুর মৃত্যু
আগামীকাল পঞ্চগড়ে বিএনপির জনসমাবেশ
ব্যাক্তিস্বার্থ পরিহার করে, দেশ ও দলের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে: ইলিয়াস পাটোয়ারী
সখিপুরে বিদ্যুৎষ্পৃষ্টে ডিস ব্যবসায়ীর মৃত্যু
যারাই সুযোগ পেয়েছে তারাই দেশের সাথে বেঈমানী করেছে: ডা. মু. তাহের
পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো মৌমাছি ও মধু সম্মেলন
শীতের দিনে ঝিরঝিরে বৃষ্টি স্থবির খুলনা শহুরে জীবন