পাহাড়-পর্বতের সৃষ্টিরহস্য
৩১ মে ২০২৩, ০৮:৩১ পিএম | আপডেট: ০১ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
পৃথিবীর বুকে সব থেকে উঁচু আর ভারী স্থাপনার নাম পর্বত। তারই অনুজ পাহাড়। ঢেউ খেলানো সারিবদ্ধ পর্বতের মিছিল কোথাও আকাশের নীলে মিশেছে। কোথাও লালিমার কোলে হারিয়েছে। সাদা, কালো, ঘোলাটে কত রঙয়ের পাহাড়। কত আকৃতির পর্বত। এরা প্রভুর বিস্ময়কর সৃষ্টি। অপার শক্তিমত্তার মহা নিদর্শন। প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার। ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক। তাই আল্লাহতায়ালা এসবের প্রতি দৃষ্টি দিতে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘(তারা কি দৃষ্টিপাত করে না) পর্বতমালার প্রতি কীভাবে তা দৃঢ়ভাবে স্থাপন করা হয়েছে?’ (সুরা গাশিয়া : ১৯)
এ নিবন্ধে ‘পাহাড়-পর্বতের সৃষ্টিরহস্য’ নিয়ে কিছু আলোকপাতের প্রয়াস চালানো হয়েছেÑ
পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষাকারী : পৃথিবী সূর্যের চারদিকে উপবৃত্তাকার পথে অবিরাম ঘুরছে। যাকে বলে বার্ষিকগতি। এই ঘূর্ণনের বেগ বিজ্ঞানীদের হিসাব মতে ঘন্টায় ১০,৭০০ কি:মি: প্রায়। আবার পৃথিবী নিজ অক্ষেও ঘুরছে অবিরত। যাকে বলে আহ্নিকগতি। তার বেগ ঘন্টায় ১৬৭০ কি:মি: প্রায়। সুতরাং পাহাড়-পর্বত না থাকলে পৃথিবী তার ভারসাম্য হারাত। জলে ভাসা খালি পাত্রের মতো নড়াচড়া করত। ধ্বংস হতো সবকিছু। সামান্য ভূমিকম্পে তা আঁচ করা যায়। আল্লাহতায়ালা জমিনের ওজন ঠিক রাখতে, নড়াচড়া বন্ধ করতে এতে স্থাপন করেছেন এসব ভারী স্থাপনা। পেরেকের মতো গেঁথে দিয়ে শক্ত করেছেন পৃথিবীকে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি জমিনের ওপর সুদৃঢ় পর্বতমালা সৃষ্টি করেছি, যাতে তাদের নিয়ে পৃথিবী ঝুঁকে না পড়ে...।’ (সুরা আম্বিয়া : ৩১)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি কি পর্বতগুলোকে পেরেকস্বরূপ সৃষ্টি করিনি?’ (সুরা নাবা : ৭) হাদিস শরিফে এসেছে, নবী করিম সা. ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহতায়ালা জমিন সৃষ্টি করলে তা নড়াচড়া শুরু করে। অত:পর এর ওপর পর্বতমালা স্থাপন করলে স্থিতিশীলতা আসে।’ (জামে তিরমিজি : ৩২৯১)
নদী-নালার উৎপত্তিস্থল : পৃথিবীর প্রধান প্রধান যত নদী আছে সবগুলোর উৎস প্রায় কোনো পর্বত কিংবা পাহাড়। মিষ্টি পানির স্বচ্ছ ঝরনাধারা পাহাড়েরই অবদান। সমুদ্রের পানি মেঘ হয়ে বর্ষিত হয় পাহাড়ে, বরফ হয়ে আটকা পড়ে পর্বতে আর তা হতে গ্রীষ্মের তাপদাহে বরফখন্ড গলে গলে ক্ষয়ে ক্ষয়ে জন্ম নেয় নদ-নদী, যা আবহমান কাল ধরে পৃথিবীর সব প্রাণি আর উদ্ভিদের পিপাসা নিবারণ করে বয়ে চলছে। কখনো কখনো পাহাড়-পর্বতের পাথরখন্ড ফেটেও নদী-নালা উৎপত্তি লাভ করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর নিশ্চয় পাথরের মধ্যে কিছু এমন রয়েছে, যা থেকে নহর উৎসারিত হয়। আর কিছু রয়েছে যা চূর্ণ হয়। ফলে তা থেকে পানি বের হয়।’ (সুরা বাকারা : ৭৪)
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি : পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়নি এমন মানুষ খোঁজে পাওয়া যাবে না। কবি, সাহিত্যিক, গায়ক, পর্যটক, রঙশিল্পী সবার ভাষা, কলম, কিংবা আল্পনায় পাহাড়ি রূপের বাহারি বর্ণনা এসেছে। বিভিন্ন রঙ আর আকৃতির পর্বতমালা ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর নানা প্রান্তজুড়ে। তুরস্কের ‘রেইনবো’, ইরানের ‘আলাদগর’ কিংবা চীনের ‘ড্যানজিয়া’ পর্বতমালার সৌন্দর্য যে কারো হৃদয় কাড়বে। সাত রঙয়ের আস্ত রঙধনু যেন আছড়ে পড়েছে পর্বতের গায়। এদের বলা হয় ‘রঙধনুর পাহাড়’ বা সাত রঙয়ের পর্বতমালা। প্রভুর কী কুদরত ক্যারিশমা! তাঁকে চেনা-জানার কত কী রেখেছেন প্রকৃতির ভাঁজে ভাঁজে। ভাবলেই তাঁর অস্তিত্বের অনুভব পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি কি দেখো না! ...পাহাড়ে আছে বিভিন্ন বর্ণের গিরপথ বা খন্ডÑ সাদা, লাল আর নিকষ কালোর সমাহার?’ (সুরা ফাতির : ২৭)
এ ছাড়াও গাছপালা ফুলফলসহ প্রাকৃতিক নানা নয়নাভিরাম দৃশ্যের দেখা মেলে পাহাড়গুলোতে। কোরআন তার বর্ণনা দিয়েছে এভাবে, ‘পৃথিবীকে করেছি সুবিস্তৃত এবং এতে সংস্থাপিত করেছি পর্বতমালা আর উদ্গত করেছি যাবতীয় সুদৃশ্য উদ্ভিদরাজি।’ (সুরা কাফ : ৭)
মানুষ ও প্রাণিদের আবাস্থল : মানব ইতিহারের সূচনাকাল থেকেই মানুষ পাহাড়ে বসবাস করে আসছে। শ্রীলঙ্কার ‘আদম পাহাড়’ তারই প্রমাণ বহন করে। ওপরে ঘর বানিয়ে কিংবা পাহাড় কেটে গর্ত করে বসবাসের প্রচলন আদিকাল থেকেই রয়েছে। আদ, সামুদসহ বেশ কিছু জাতি বা ব্যক্তিবর্গের পাহাড়ে বসবাসের কথা কোরআনে উল্লেখ হয়েছে। সামুদ জাতি প্রসঙ্গে এসেছে, ‘তারা পাহাড় কেটে গৃহ নির্মাণ করত নিরাপদ বসবাসের জন্য।’ (সুরা আল হিজর : ৮২)
সে ধারা আজও অব্যাহত আছে। পৃথিবীর ৭০টি দেশের প্রায় ৩৭০ মিলিয়ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এখনো পাহাড়ে বসবাস করে। বাংলাদেশের প্রায় ২৬টি ভাষাভাষীর ৪৫টি জাতিসত্তার ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, যাদের সংখ্যা প্রায় ১ মিলিয়ন যা মোট জনসংখ্যার ০১ ভাগÑ পাহাড়ে বসবাস করে। এছাড়াও পশুপাখি, কীটপতঙ্গ ও গর্তে বসবাস করা অনেক প্রাণির অভয়ারণ্য এই স্থাপনাগুলো। সুরা নাহলের ৬৮ নম্বর আয়াতে, আল্লাহতায়ালা কর্তৃক মৌমাছিদের পাহাড়ে মৌচাক বানানোর নির্দেশর কথা এসেছে। জিন জাতির আবস্থল হিসাবেও পাহাড়গুলো ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মদিনার ‘ওয়াদি আল জিন বা জিনের পাহাড় তন্মধ্যে বিখ্যাত।
সম্পদের আধার : আল্লাহতায়ালা পাহাড়গুলোতে বহু মূল্যবান প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ রেখে দিয়েছেন। বিচিত্র শিলাখন্ড, পাথর, কয়লা, লোহা, তামা, রুপা, স্বর্ণ ও লিথিয়ামের মতো দামি পদার্থসহ পারমানবিক শক্তির অন্যতম উৎস ইউরেনিয়ামেরও যথেষ্ট মজুদ এতে রয়েছে। গাছপালা, ফুলফল, তৃণলতা, শাকসবজি, উন্নত মসলাদিসহ রকমারি ফসলে পরিপূর্ণ পাহাড়ের ভূমি। কোরআনে এসেছে, ‘জমিনের উপরভাগে তিনি পর্বতমালা স্থাপন করেছেন এবং তাতে বরকত দিয়েছেন। (ফুসসিলাত : ১০)
এছাড়াও বেশকিছু আয়াতে পাহাড়ি প্রকৃতির বর্ণনা এসেছে। সুরা নাজিয়াতের ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এসব তোমাদের ও তোমাদের চতুষ্পদ জীবজন্তুগুলোর জীবনোপকরণের জন্য।’
ইবাদাতের নীরব ক্ষেত্র : দ্বীন রক্ষা ও দুনিয়ার কোলাহল থেকে মুক্ত হয়ে ইবাদাতের জন্য পাহাড়-পর্বত একটি নিরাপদ ও নীরব ক্ষেত্র। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত অত্যন্ত চমকপ্রদ ঘটনা ‘আসহাবে কাহাফ’ বা গুহাবাসীর ঘটনা। তারা তাদের ঈমান রক্ষার জন্যই মূলত পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। হজরত মুসা আলাইহিস সালাম তুর পর্বতে চল্লিশ দিন তাওরাত লাভের জন্য নীরবে সাধনা চালিয়ে ছিলেন। নবুয়ত প্রাপ্তির আগে আমাদের প্রিয়নবী সা. হেরা পর্বতের নিরিবিলি গুহায় একাকি ইবাদত করতেন ও ধ্যানমগ্ন থাকতেন। পরিশেষে নবুয়ত পেয়ে কোরআনের বাণী বুকে ধরে ঘরে ফিরেছিলেন। ফেতনার মুহুর্তে ঈমান-আমল রক্ষা করার শ্রেষ্ঠতম স্থান হলো পাহাড়-পর্বত।
নবীজি সা. বলেন, ‘মানুষের ওপর এমন এক যুগ আসবে, যখন মুসলিমের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হবে ভেঁড়া-ছাগল; তা নিয়েই পর্বতশিখরে ও পানির জায়গাতে চলে যাবে; ফিতনা থেকে নিজ দ্বীন নিয়ে পলায়ন করবে।’ (সহিহ বুখারি : ৩৬০০)
আল্লাহর আনুগত্যকারী : এরা আল্লাহর আনুগত্যকারী সৃষ্টি। সর্বদা তাঁকে সেজদা করে । (সুরা হজ : ১৮)
হজরত দাউদ আ.-এর সঙ্গে এরা সকাল-বিকাল আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করত। (সুরা ছোয়াদ : ১৮)
আল্লাহর ভয় এদের মাঝেও রয়েছে। তাই পর্বতচূড়া থেকে কখনো কখনো পাথরখন্ড খসে পড়ে জমিনের বুকে। (সুরা বাকারা : ৭৪)
যতদিন আল্লাহর নির্দেশ থাকবে পৃথিবীকে সুরক্ষা দেয়ার ততদিনই তা দিয়ে যাবে। যখন পৃথিবী ধ্বংসের ডাক আসবে তখন পর্বতগুলো মাটি থেকে পৃথক হয়ে দৌড়াতে শুরু করবে। প্রবল কম্পন তুলবে পৃথিবীর বুকে। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে অস্তিত্ব হারাবে নিজে। হবে ধুনিত রঙিন পশমের মতো। উৎক্ষিপ্ত ধুলোবালি কিংবা মরীচিকা সদৃশ। (আল কোরআন)
লেখক: কবি ও কলামিস্ট
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ভবিষ্যতে পুতিনের সাথে সরাসরি কথা বলতে চান শলৎজ
বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর ২২০০ সহিংসতা নিয়ে ভারতের তথ্য বিভ্রান্তিকর : প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং
ছিনতাইকারীর হাতে খুন হন হাফেজ কামরুল
ধামরাইয়ে ২টি ড্রেজার মেশিন জব্দ
রাবিতে অপরাধে জড়িত ৬ শিক্ষার্থী স্থায়ী বহিষ্কার, শাস্তি পেল মোট ৩৩ জন
রাণীশংকৈলে ফিল্মি স্টাইলে দোকান চুরি, ১৮ ঘন্টা অতিবাহিত হলেও চোর ধরতে ব্যর্থ পুলিশ
মাগুরার শালিখায় অজ্ঞাত বৃদ্ধার লাশ উদ্ধার
আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করি আর হাসিনার ভরসা ভারতে -দুলু
বাংলাদেশের গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে কমিশন
২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে মত বিএনপির যুগপৎ সঙ্গীদের
ঢাকায় ‘হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) বিশ্বের নারীদের আদর্শ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
চার ভাগে ফিরবেন ক্রিকেটাররা
চাঁদাবাজদের ক্ষমতায় আসতে দেবেন না: হাসনাত
এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের বরাদ্দ পেল বাফুফে
ইজতেমা মাঠকে যারা খুনের মাঠে পরিণত করেছে তারা সন্ত্রাসী
আসছে ভিভোর এক্স সিরিজের নতুন ফ্ল্যাগশিপ
বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ২ ভারতীয় নাগরিককে স্বদেশে ফেরত
মুন্সীগঞ্জে বিএনপি’র দু পক্ষে সংঘর্ষ,৩ জন গুলিবিদ্ব সহ আহত ১০
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিব-তামিমকে পাওয়া যাবে: ফারুক
ইজতেমা মাঠে হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করুন