কোরআনের মহান শিক্ষক জিয়াউল হক কুতুবুদ্দিন
০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৩ এএম
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
তিনি আমাদের প্রতি পিতৃবৎ ছিলেন, পিতৃতান্ত্রিক ছিলেন না। স্নেহ করতেন, ভক্তি জাগাতেন, শ্রদ্ধা আদায় করে নিতে জানতেন। কিন্তু কখনোই নিজের মত চাপিয়ে দিতেন না। অন্যের চিন্তা ও ভিন্নমতকে স্থান দিতে জানতেন। ক্ষমতা বা পার্থিব সুবিধাদির প্রতি তাঁর কোনো মোহ ছিল না। যে সমাজে বেশিরভাগ মানুষ পিতৃতান্ত্রিক, ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের আসন থেকে অধীনের উপর শোষণ ও নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ করতে অভ্যস্ত যে সমাজের মানুষ, সেখানে খুব যৌক্তিক, নমনীয় ও ইনক্লুসিভ (রহপষঁংরাব) মনোভাব ছিল তাঁর। নিজের অধীন মানুষদের প্রতি প্রভুত্বব্যাঞ্জক না, মমতামাখা আচরণ করতেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই তাঁকে ভালো জানতেন, ভালবাসতেন।
২২ মার্চ ২০২৩ জিয়াউল হক কুতুবুদ্দিন ইন্তেকাল করেন। তিন সপ্তাহের ঢাকা সফর শেষে ততদিনে কানাডা ফিরে এসেছি। ফোনে মৃত্যু সংবাদ জানান আব্বা। আমি প্রতিক্রিয়াহীনভাবে শুনেছি। অভ্যাসবশত উচ্চারণ করেছি ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’। কবে জানাজা, কবে কোথায় দাফন, কিছুই জিজ্ঞেস করিনি তখন। সেসব জানার কথা মাথায় আসেনি। ইংরেজিতে মেলাংকোলি (সবষধহপযড়ষু) বা ডিসোলেশন (ফবংড়ষধঃরড়হ) বলে শব্দ আছে, আরবিতে হাজান, বাংলা ভাষায় বিষাদ আছে, দুঃখ-তাপ আছে, এই শব্দগুলোর একটাও আমার শিক্ষককে হারানোর ভাব ধারণ করতে প্রতুল না, ওই অনুভূতিকে প্রকাশ করতে যথেষ্ট না। আমি যেন একটা গভীর শূন্যতার মধ্যে ডুবে গেছি। আমার ভেতরে কোথায় যেন কী একটা খালি হয়ে গেছে। দমবন্ধ করা কোনো অন্ধকারের অতলে হারিয়ে গেছি। কোনো কূল দেখতে পাচ্ছি না, কীভাবে এর থেকে বেরিয়ে আসব, জানি না।
ক্যান্সার হয়েছিল তাঁর, রক্তে ক্যান্সার। আমাদের, ছাত্রদের জানতে দেননি। মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের সদস্যদের থেকে আব্বা সেকথা জানতে পারেন। অসুখ ধরা পড়ার পর খুব বেশি সময়ও পাননি। বছরের শুরুর দিকে ফোন করেছিলাম তাঁকে, আমার মেয়েকে নিয়ে ওমরা করার পরিকল্পনা জানাতে। খুশি হয়েছিলেন। ভালো খবরে, ভালো কাজে, ভালো সংকল্পে তিনি সবসময় খুশি হতেন। দোয়া করতেন। খুব ইতিবাচক মানুষ ছিলেন। কখনো কোনো নেতিবাচক ভাব প্রকাশ করতেন না। ঐ বার কেবল বললেন, ‘আমার জন্য দোয়া করো। আমি চাই যেন আমার বাসায় নিজের বিছানায় শুয়ে আমার মৃত্যু হয়। আর তোমরা আমাকে মাফ করে দিয়ো।’ আমি জানতাম, তাঁর শরীর প্রায়ই ভালো থাকে না। ভেবেছিলাম বয়সের কারণে এসব বলছেন। তিনি যে সত্যিই বিদায় নিচ্ছিলেন, তা বুঝতে পারিনি।
সাড়ে চার বছর প্রবাসে থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ঢাকায় পৌঁছাই। কানাডা থেকে মদিনা হয়ে মক্কায় ওমরা করে দেশে ফিরেছিলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় যেতে না যেতে আমার মেয়ের জ্বর-কাশি-সর্দি। তাকে নিয়ে আমার শিক্ষকের সাথে দেখা করতে যাবার পূর্বপরিকল্পনা থাকলেও উপায় ছিল না। ওই দিকে তাঁরও বেশ কিছুদিন ধরে শরীর বেশ খারাপ। এর মধ্যেই ওমরা ও মদিনা সফর করে এসেছেন তিনি। ১৪ ফেব্রুয়ারি আমি মদিনায় প্রবেশ করি, ওই দিনই ঢাকার উদ্দেশ্যে জেদ্দা ত্যাগ করেন তিনি। এই সফরের ধকলে শরীর আরো দুর্বল হয়ে পড়ে তাঁর। স্বাস্থ্যগত পরিস্থিতির কারণে আরো আগেই ছাত্রদেরসহ বাইরের মানুষের সাথে দেখা করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আমার ঢাকায় পৌঁছানোর কথা আব্বা ফোনে জানান তাঁকে। এই অবস্থাতেও তাঁর বাসায় ডেকে পাঠান আমাকে।
৩ মার্চ সকালে আব্বা ও মেয়েকে নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করতে যাই। বৈঠকখানায় অল্প অপেক্ষা করতেই আসেন তিনি, শরীর কাঁপছিলো। নিজের শক্তিতে হেঁটে আসলেও পাশে একজন ছিলেন, যেন উনি পড়ে না যান। সোফায় বসে আমাকে তাঁর পাশে বসতে বললেন। আমার মেয়েকে তাঁর পাশে বসিয়ে দিলে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের হাতে চুমু দিলেন। ওর পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। খুব বেশি কথা হয়নি সেদিন, তাঁর অবস্থা তেমন ছিল না। টুকটাক কথা হচ্ছিলো, আমার পড়াশোনার খবর, কানাডায় আমাদের পারিবারিক অবস্থার কথা, এইসব। আমার মেয়ের জন্য দোয়া করতে বললে দোয়া পড়ে আবারো মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
‘আগামী বছর দেশে ফিরে এলে দেখা হবে’, আমার এই কথার পিঠে বললেন, ‘আমার শরীর ভালো যাচ্ছে না। আবার তোমাদের সাথে বসতে পারবো কিনা জানি না। আমার জন্য দোয়া করো।’ ‘ইনশাআল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবেন, আমরা আবারও আপনার সাথে বসবো, আপনার থেকে আরো শিখবো’, বলাতে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘যে কোনো পরিস্থিতিতে ভাববে, রাসূলুল্লাহ (দ.) এই অবস্থায় কী ভাবতেন, কী করতেন। রাসূলুল্লাহ (দ.) এর পথ খুব সাদাসিধা পথ। তোমরা যা কিছু শিখেছ, তার আলোকে ওই ভাবনা ভাবলে পথ নিজেই খুঁজে পাবে। আর আমাকে মাফ করে দিয়ো।’ এর পর বিদায় নিই। ওই দুর্বল শরীর নিয়ে আমাদের সাথে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে আসেন, আমরা নিচে নামার সিঁড়িতে যাওয়া পর্যন্ত আমাদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সেটাই যে তাঁর সাথে শেষ দেখা হয়ে থাকবে, ওই কথাই যে শেষ কথা হয়ে দাঁড়াবে, তিনি হয়তো সে কথা ভাবছিলেন। আমি এতটুকুও ভাবিনি।
আমার শিক্ষক আল্লাহকে ভয় করতেন, রাসূলুল্লাহকে (দ.) ভালোবাসতেন। সততা, ন্যায়পরায়ণতা, কর্তব্য ও ধর্মনিষ্ঠার উজ্জ্বল উদাহরণ ছিলেন তিনি। যুগের পর যুগ ধরে আমাদের সে শিক্ষাই দিয়ে গেছেন। আমরা সজ্ঞানে-অবচেতনে তাঁর সে শিক্ষা বয়ে বেড়াই। শিক্ষক হিসেবে তিনি যেভাবে তাঁর ছাত্রদের হক আদায় করেছেন, ছাত্র হিসেবে আমরা তাঁর হক আদায় করতে পারিনি। আমরা কেউ, অন্তত ও বিশেষত আমি তো বটেই, তাঁর মাপের মানুষ হতে পারিনি। ভুলভ্রান্তিতে ভরা জীবনে পার্থিব কামনা-বাসনায় বাঁধা মন নিয়ে তাঁর মাপের হয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি এখনও। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন। জান্নাতে তাঁকে নবী, সত্যবাদী, শহীদ ও সৎকর্মশীলদের সঙ্গী করুন। (সমাপ্ত)
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে মত বিএনপির যুগপৎ সঙ্গীদের
ঢাকায় ‘হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) বিশ্বের নারীদের আদর্শ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
চার ভাগে ফিরবেন ক্রিকেটাররা
চাঁদাবাজদের ক্ষমতায় আসতে দেবেন না: হাসনাত
এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের বরাদ্দ পেল বাফুফে
ইজতেমা মাঠকে যারা খুনের মাঠে পরিণত করেছে তারা সন্ত্রাসী
আসছে ভিভোর এক্স সিরিজের নতুন ফ্ল্যাগশিপ
বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ২ ভারতীয় নাগরিককে স্বদেশে ফেরত
মুন্সীগঞ্জে বিএনপি’র দু পক্ষে সংঘর্ষ,৩ জন গুলিবিদ্ব সহ আহত ১০
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিব-তামিমকে পাওয়া যাবে: ফারুক
ইজতেমা মাঠে হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করুন
কলাপাড়ায় অটোরিকশা উল্টে শিশুর মৃত্যু
আগামীকাল পঞ্চগড়ে বিএনপির জনসমাবেশ
ব্যাক্তিস্বার্থ পরিহার করে, দেশ ও দলের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে: ইলিয়াস পাটোয়ারী
সখিপুরে বিদ্যুৎষ্পৃষ্টে ডিস ব্যবসায়ীর মৃত্যু
যারাই সুযোগ পেয়েছে তারাই দেশের সাথে বেঈমানী করেছে: ডা. মু. তাহের
পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো মৌমাছি ও মধু সম্মেলন
শীতের দিনে ঝিরঝিরে বৃষ্টি স্থবির খুলনা শহুরে জীবন
টেকসই উন্নয়নের কথা মাথায় রেখেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য নীতি করার তাগিদ
লোকসংগীত শিল্পী নিপা আহমেদ সারাহ্ এর একক সঙ্গীত সন্ধ্যা