মিরাজুন্নবী (সা.)’র তাৎপর্য, শিক্ষা ও বিজ্ঞান

Daily Inqilab গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির

০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৩ এএম

ইসলাম ও মানব ইতিহাসে পবিত্র ও তাৎপর্যময় রজনী লাইলাতুল মিরাজ । মানবতার মুক্তির দিশারী ও বিশ্বের সর্বপ্রথম নভোচারী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নবুয়তি জীবনের সবচেয়ে বড় মুজিযা। এটি সংঘটিত হয়েছিল নবুয়াতের দ্বাদশ বছরের ২৬ রজব রাতে। অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা›য়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ৫২ বছর বয়সে, ৬২১ খ্রিষ্টাব্দে। এ রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বন্ধু মুহাম্মদ (সা.)কে জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে বাইতুল মুকাদ্দাস হয়ে সপ্ত আকাশ, আরশে আজিম এবং তদূর্ধ্বে আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী বিশেষ বিশেষ স্থান পরিভ্রমণ করিয়েছিলেন।

কোরআনের ভাষায়, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাহকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই।› (সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত: ১)।

কোরআন ও হাদিসে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে মিরাজের সংক্ষিপ্ত ঘটনা:

২৬ রজব রাত্রি। নবীজী (সা.) উম্মে হানীর ঘরে ছিলেন। এমন সময় জিব্রাইল (আ.) এসে তাকে নিয়ে কাবার হাতিমে চলে গেলেন। সেখানে তার বক্ষ বিদীর্ণ করা হয়। এরপর নবীজীকে (সা.) বোরাকের পিঠে চড়িয়ে মসজিদে আকসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে দেখেন সব নবী-রাসুল তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি সেখানে সবার ইমাম হয়ে দু›রাকাত নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে জিব্রাইল (আ.) তাকে ঊর্ধ্বাকাশে নিয়ে গেলেন। সেখানে আকাশের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন নবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়।

অতঃপর তিনি ‘সিদরাতুল মুনতাহায়› যান যেখানে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে স্বর্ণের প্রজাপতি এবং বিভিন্ন রঙের প্রজাপতি ছোটাছুটি করছিল। আর ফেরেশতারা স্থানটিকে ঘিরে রেখেছিল। সেখানেই তিনি একটি দিগন্তবেষ্টিত সবুজ রঙের ‘রফরফ› দেখতে পান। সে রফরফে চড়ে অবশেষে উচ্চতার সর্বশেষ পর্যায়ে পৌঁছে মহান আল্লাহ তায়ালার দিদার লাভে ধন্য হন। এ ছিল মিরাজের সংক্ষিপ্ত ঘটনা।

*প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক যে, রাসূল (সা.)-এর এ মিরাজ কেন সংঘটিত হয়েছে বা এর তাৎপর্য কী? এ প্রশ্নের উত্তরে ইসলামী চিন্তাবিদদের বিশ্লেষণটা এ রকম, শৈশবকাল থেকেই দুঃখ-কষ্ট, স্বজন হারানোর বেদনা নবীজীর পিছু ছাড়ছিল না। একটার পর একটা লেগেই থাকত। জীবনের এক পর্যায়ে এসে হযরত খাদিজা (রা.) এবং তার একমাত্র আশ্রয়দাতা চাচা আবু তালিবকে হারিয়ে তিনি খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তার এ অসহায়ত্বের সুযোগে কুরাইশদের অত্যাচারের মাত্রাও দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে রাসূল (সা.) হযরত যায়েদকে (রা.) সঙ্গে নিয়ে আশ্রয় লাভের জন্য তায়েফে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে তায়েফবাসীর নির্মম অত্যাচার ও প্রস্তুরাঘাতে জর্জরিত হয়ে বিষণ্ণ চিত্তে ক্লান্তশ্রান্ত দেহে তায়েফ থেকে ফিরে আসেন। এ কঠিন বাস্তবতার সময়ে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবীবকে সান্তনা দেয়ার উদ্দেশ্যে নিজের কাছে নিয়ে যান।

মিরাজের রজনীতে মহানবী (সা.) আল্লাহর দিদার লাভ করতে গিয়ে স্বচক্ষে আরশ কুরসি, লওহে কলম, পুলসিরাত, বেহেশত, দোজখ ইত্যাদি দর্শন করে আইনুল ইয়াকীন অর্জন করেন। এ রজনীতেই মহানবী (সা.) ভবিষ্যৎ ইসলামী রাষ্ট্রের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা লাভ করেন। এর ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই রাসূল (সা.) সেখান থেকে ফিরে মদিনায় হিজরত করে স্বীয় দর্শনলব্ধ জ্ঞান ও আল্লাহর নির্দেশের আলোকে ইসলামের প্রদীপ্ত শিখা জ্বেলে দিলেন। সেই আলোতেই মাত্র তেইশ বছরের মধ্যে সমগ্র বিশ্ব আলোকিত হয়েছিল।

এ ছাড়া মিরাজের রাতে রাসূলকে (সা.) উপঢৌকন হিসেবে তিনটি জিনিস প্রদান করা হয় বলে এ রাতের তাৎপর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এ তিনটি জিনিস হলো- পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, সূরা বাকারার শেষ তিন আয়াত এবং শিরক ছাড়া সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়ার সুসংবাদ।

মিরাজের শিক্ষা: মিরাজের ঘটনা থেকে আমরা কিছু শিক্ষা অর্জন করতে পারি:-
১. মিরাজের প্রথম শিক্ষা মারিফাত সম্পর্কীয়। আমাদের নবী করিম (সা.) আল্লাহর দিদার এবং সান্নিধ্য লাভ করে মারিফাতের শীর্ষে পৌঁছেন। কিন্তু মারিফাতের জ্ঞান অর্জন করে তিনি (তথাকথিত) দেওয়ানা , মাজনুন এমনকি তন্দ্রাগ্রস্তও হলেন না। বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি অব্যাহত রাখার জন্য নিজের বাকি জীবনকেও কোরবান করে দিলেন।

২. আগে মহানবী (সা.) যে কাজ করতেন না মিরাজ থেকে ফিরে এসে তিনি সেই কাজও শুরু করলেন। ফিরে এসে কয়েক দিন পরই তিনি মদিনায় হিজরত করলেন এবং কায়েম করলেন এক কল্যাণধর্মী ইসলামী রাষ্ট্র। মিরাজের রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর হাবীবকে শুধু দীন ইলম নয়, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিও শিক্ষা দিয়েছিলেন।

৩. মিরাজের তৃতীয় শিক্ষা হলো, সমাজ ও সমষ্টিচেতনা। মহানবী (সা.) অনেক ওপরে উঠেও সেখানে থাকেননি। তিনি মাটির পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন শুধু ঘর থেকে বিতাড়িত হতে, বারবার আক্রান্ত হতে, আহত হতে, নিজের দাঁত মোবারক ভাঙতে। এর কারণ তাঁর মধ্যে ব্যক্তিচেতনার চেয়ে সমষ্টিগত চেতনা ছিল বেশি। তিনি একা থাকতে চাননি। দুনিয়ায় ফিরে এসে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করে আমাদের জন্য অনুকরণীয় এক অনুপম আদর্শ রেখে গেছেন।

৪. মিরাজের চতুর্থ শিক্ষা হলো ‘আমালুস সালিহ› বা কল্যাণমূলক কাজ। আল্লাহ রাসূল (সা.) মিরাজ থেকে ফিরে এসে মদিনায় হিজরত করে কল্যাণমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। যুবকদের তিনি তার দিকে আকৃষ্ট করেছিলেন জনকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে।

৫. মিরাজের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বপ্রধান শিক্ষা হলো মুসলমানদের বিজ্ঞানচর্চার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান। মহানবী (সা.) আল্লাহর কুদরতে নভোম-ল বিচরণ করেছেন এবং আমাদের সামনে আলোকবর্তিকা হিসেবে বিরাজমান। আল্লাহ তায়ালা নবীজীকে নভোমন্ডল ভ্রমণের যে ফর্মুলা দিয়েছেন তা হলো মারিফাত ফর্মুলা। ওই ফর্মুলা মানুষের জন্য সম্ভাবনাময়। মানুষকে বুদ্ধি-বিবেচনা-গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞান চর্চা করে এলমে মারিফাত অর্জন করে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই,মিরাজ প্রমাণ করে মানুষ গবেষণা ও বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে যে উপগ্রহ বা চাঁদে যেতে পারে তা নয় বরং গ্রহ, নক্ষত্র জড় জগৎ পার হয়ে সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করে আরো ঊর্ধ্বে যেতে পারে। নভোমন্ডল ও তদূর্ধ্ব ভ্রমণ হবে আমাদের নবীরই সুন্নাত। তাই লাইলাতুল মিরাজের তাৎপর্য ও শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করে কোরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক এগুতে হবে। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সেই আলোকিত বিজ্ঞানময় আমল ও জীবন গঠনের তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: ধর্ম ও সমাজ সচেতন লেখক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপস্থাপক ও চেয়ারম্যান - গাউছিয়া ইসলামিক মিশন, কুমিল্লা।


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বড়দিনের ধর্মীয় ইতিহাস ও তাৎপর্য
ইসলামি অর্থনীতির স্বরূপইসলামি অর্থনীতির স্বরূপ
হাজারো পীর-আউলিয়ার শিরোভূষণ সৈয়দ সুফি ফতেহ আলী ওয়াইসি (র.)
আল-কুরআন তাজকেরায়ে মীলাদ নামায়ে আম্বিয়া (আ:)
ঘুষ : দেয়া-নেয়া দুটিই অপরাধ
আরও

আরও পড়ুন

বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ২ ভারতীয় নাগরিককে স্বদেশে ফেরত

বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ২ ভারতীয় নাগরিককে স্বদেশে ফেরত

মুন্সীগঞ্জে বিএনপি’র দু পক্ষে সংঘর্ষ,৩ জন গুলিবিদ্ব সহ আহত ১০

মুন্সীগঞ্জে বিএনপি’র দু পক্ষে সংঘর্ষ,৩ জন গুলিবিদ্ব সহ আহত ১০

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিব-তামিমকে পাওয়া যাবে: ফারুক

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিব-তামিমকে পাওয়া যাবে: ফারুক

ইজতেমা মাঠে হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করুন

ইজতেমা মাঠে হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করুন

কলাপাড়ায় অটোরিকশা উল্টে শিশুর মৃত্যু

কলাপাড়ায় অটোরিকশা উল্টে শিশুর মৃত্যু

আগামীকাল পঞ্চগড়ে বিএনপির জনসমাবেশ

আগামীকাল পঞ্চগড়ে বিএনপির জনসমাবেশ

ব্যাক্তিস্বার্থ পরিহার করে, দেশ ও দলের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে: ইলিয়াস পাটোয়ারী

ব্যাক্তিস্বার্থ পরিহার করে, দেশ ও দলের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে: ইলিয়াস পাটোয়ারী

সখিপুরে বিদ্যুৎষ্পৃষ্টে ডিস ব্যবসায়ীর মৃত্যু

সখিপুরে বিদ্যুৎষ্পৃষ্টে ডিস ব্যবসায়ীর মৃত্যু

যারাই সুযোগ পেয়েছে তারাই দেশের সাথে বেঈমানী করেছে: ডা. মু. তাহের

যারাই সুযোগ পেয়েছে তারাই দেশের সাথে বেঈমানী করেছে: ডা. মু. তাহের

পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো মৌমাছি ও মধু সম্মেলন

পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো মৌমাছি ও মধু সম্মেলন

শীতের দিনে ঝিরঝিরে বৃষ্টি স্থবির খুলনা শহুরে জীবন

শীতের দিনে ঝিরঝিরে বৃষ্টি স্থবির খুলনা শহুরে জীবন

টেকসই উন্নয়নের কথা মাথায় রেখেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য নীতি করার তাগিদ

টেকসই উন্নয়নের কথা মাথায় রেখেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য নীতি করার তাগিদ

লোকসংগীত শিল্পী নিপা আহমেদ সারাহ্ এর একক সঙ্গীত সন্ধ্যা

লোকসংগীত শিল্পী নিপা আহমেদ সারাহ্ এর একক সঙ্গীত সন্ধ্যা

বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি ও হার্ট ফাউন্ডেশনের কর্মশালা

বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি ও হার্ট ফাউন্ডেশনের কর্মশালা

বাফেদার ৩১তম এজিএম অনুষ্ঠিত

বাফেদার ৩১তম এজিএম অনুষ্ঠিত

পাকিস্তান থেকে যেসব পণ্য নিয়ে এবার এলো জাহাজ

পাকিস্তান থেকে যেসব পণ্য নিয়ে এবার এলো জাহাজ

হারের বৃত্তে সিটি, নেমে গেল ছয়ে

হারের বৃত্তে সিটি, নেমে গেল ছয়ে

ঈশ্বরদীতে দূর্বৃত্তের হামলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আহত

ঈশ্বরদীতে দূর্বৃত্তের হামলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আহত

আখাউড়ায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মেধা বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত

আখাউড়ায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মেধা বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত

অ্যানুয়াল বিজনেস কন্টিনিউয়িটি প্ল্যান ড্রিল ২০২৪ আয়োজন করলো ব্র্যাক ব্যাংক

অ্যানুয়াল বিজনেস কন্টিনিউয়িটি প্ল্যান ড্রিল ২০২৪ আয়োজন করলো ব্র্যাক ব্যাংক