নয়াচীন : যা দেখেছি যা শুনেছি
১৬ মার্চ ২০২৩, ০৬:৫৪ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৪৫ পিএম
আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন যে, এই জাতটা আফিমখোরের জাত। দুনিয়ায় আফিমখোর বললে এক কথায় চীনের লোককে বোঝা যায়। আমি যখন কলিকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়তাম তখন মাঝে মাঝে আমার বন্ধু মি. জহিরুদ্দিনের (যিনি এখন ঢাকায় উকিল) বাড়ি যেতাম। যাবার সময় পথে চীনা পাড়া পার হয়ে যেতে হতো। নাকে কাপড় না দিয়ে যাওয়া যেত না; হয় মদের গন্ধ না হয় অন্য কিছুর দুর্গন্ধ।
চীনে যেয়ে আফিম খাওয়ার নেশাটার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলাম। শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলাম, ব্যাপার কী? সরকারের হুকুম, আফিম খাওয়া চলবে না। আর কার সাধ্য, আফিম খায়! আমার মনে হয়, অত্যাচার করেই আফিম খাওয়া বন্ধ করা হয়েছে। যদি সরকার খবর জানতে পারে যে, কোনো লোক আফিম খায় তা হলে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। সরকারের খবর পেতে কষ্ট হয় না। জনসাধারণই সরকারকে গোপনে খবর দেয়। এমন শোনা গেছে যে, স্বামী আফিম খাওয়া ছাড়তে চায় না, তাই স্ত্রী সরকারকে খবর দিয়াছে যে, আমার স্বামী আফিম খায় এবং খাওয়া ছাড়তে চায় না। ছেলেমেয়ে বাবা-মার বিরুদ্ধে সরকারকে খবর দিয়াছে। এমন অনেক গল্প আমি শুনলাম। তবে একথা সত্য যে, আফিম খাওয়া একবারে বন্ধ হয়েছে কি না বলতে পারি না। তবে শতকরা ৮০ জন লোক যে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে সে সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। এখনও আফিম খাওয়ার বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন চলছে। আমাকে একজন দোভাষী বলেছে, ‘পালাইয়া পালাইয়া এখনও ২/১ জনে খায়, তবে দুই তিন বৎসরের মধ্যে একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে।’
আমাকে আরও বললো, ‘বোঝেন তো, যুগ যুগ ধরে এই অভ্যাস চলে এসেছিল আমাদের দেশে। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদের আফিম দিয়ে ঘুম পাড়াইয়া এই সোনার দেশটাকে শোষণ ও শাসন করেছে। আর এই বিদেশিরা আফিম ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা অর্থ উপার্জন করে নিয়া গিয়াছে। আর আমাদের দেশের গরিব সর্বস্ব বিক্রি করে শুধু আফিম খেয়েছে। আমাদের সরকার ও আমাদের শিক্ষিত সমাজের প্রতিজ্ঞা, একজনও আফিমখোর রাখবো না এই দেশে।’
আর একটা জিনিসের জন্য চীন বিখ্যাত ছিল, সে হলো ডাকাতি। বিরাট বিরাট দল ছিল ডাকাতদের। চিয়াং কাইশেকের সময় দিনে দুপুরে এরা ডাকাতি, খুনখারাবি করতো, কিছুতেই এদের দমন করতে পারে নাই। আমরাও অনেক গল্প শুনেছি এই ডাকাতির। কেমন করে মানুষ ধরে নিয়ে যেত, টাকা দিলে ছেড়ে দিতো। এক কথায় বলা যেত, ‘মগের মুলুক›। কিন্তু নূতন সরকার কায়েম হওয়ার পরে কড়া হাতে এদের দমন করা হয়েছে। গ্রামে গ্রামে দল বেঁধে ডাকাত ধরা শুরু হয়েছে। আর সরকার খুব তৎপর হয়ে গ্রামের লোকদের সাহায্য করছে, আস্তে আস্তে ডাকাতি অনেক কমে গেছে। এখনও মাঝে মাঝে ডাকাতি হয়, তবে খুব কম। এক কথায় জনগণ সাহায্য করলে সকল কিছু করাই সম্ভব। শুধু জুলুম ও আইন করে এই সমস্ত অন্যায় কাজ বন্ধ করা যায় না, এর সাথে সুষ্ঠু কর্মপন্থারও প্রয়োজন। চীন সরকার সেই দিকে নজর দিয়েছে বলে মনে হলো। এই সমস্ত ডাকাতি, চুরি, খুনের প্রধান কারণ হলো বেকার সমস্যা। আপনারা জানেন, ৬০ কোটি লোকের এই দেশে কোটি কোটি লোক বেকার ছিল। তাদের না ছিল জমি, না ছিল চাকরি, না ছিল কাজ। তাই তারা কী করে খাবে?
এই সমস্ত কাজ কিছু লোক করে অভ্যাসের দোষে। আর কিছু লোক করতে বাধ্য হয় অভাবের তাড়নায়। পেটে খাবার না থাকলে, ছেলেমেয়ে সামনে না খেয়ে মরলে, রোগে ঔষধের বন্দোবস্ত করতে না পারলে মানুষ অনেক সময় বাধ্য হয় চুরি করতে, ডাকাতি করতে এবং ছলে বলে কৌশলে অর্থ উপার্জন করে ছেলেমেয়েদের খাওয়াতে। তাই নয়াচীন সরকার প্রধান কাজ হিসেবে গ্রহণ করলো কী করে বেকার সমস্যা দূর করা যায়। বেকার সমস্যা দূর করতে হলে সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার।
চিয়াং কাইশেকের আমলে জমির মালিক জমিদারই ছিল। চাষির জমির ওপর কোনো অধিকার ছিল না। চাষিরা খেতমজুরি করে কোনো মতে জীবনযাপন করতো। চাষের সময় কাজ পেত অনেকে, আবার বহু লোক পেতোও না। আয় খুব কম ছিল। জমিদাররা ইচ্ছামতো কৃষকদের জমি দিতো, আবার ইচ্ছা হলে কেড়ে নিতো। আইন ছিল বড়লোকদের হাতে।
চাষিরা জমির অধিকার চাইলে তাদের গুলি খেয়ে মরতে হতো। ভাগচাষি নামে এক প্রকার প্রজা ছিল, যা আমাদের দেশেও আছে। তবে আমাদের দেশের জমিদাররা যে অত্যাচার করে, তার চেয়ে সহস্র গুণ অত্যাচার করতো চীনের জমিদাররা। আমাদের দেশে দেখা যায় কোনো কোনো প্রজার ৩/৪ বৎসরের খাজনা বাকি আছে, তবুও জমিদাররা অনেক সময় মামলা করে উৎখাত করে না। আজও দেখা যায় আমাদের দেশের জমিদাররা মাঝে মাঝে প্রজার ওপর অত্যাচার করে থাকে।
চীনের অবস্থা আরও ভয়াবহ ছিল। কারণ ‘আইন› বলে কোনো জিনিস ছিল না। আইন জমিদারদের হাতে, তারা ইচ্ছা করলে প্রজাদের ধরে এনে বেত মারতো, না খাওয়াইয়া আটকাইয়া রাখতো। আমাদের দেশেও পূর্বে এই ব্যবস্থা ছিল। যদি কোনো কৃষকের মেয়ে দেখতে ভালো হতো, তবে তো আর উপায় ছিল না। জমিদারের হুকুম তাকে জমিদারের বাড়ি পৌঁছাইয়া দিতে হবে, খাজনার পরিবর্তে। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তার ওপর জমিদার অথবা তার ছেলেরা পাশবিক অত্যাচার করবে এবং কামভাব চরিতার্থ করবে। মৃত্যু পর্যন্ত তার জমিদার বাড়িতে থাকতে হবে ঐ একইভাবে। যদি কোনো মেয়ের বাবা-মা আপত্তি করে তবে তার সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া হবে এবং অমানুষিক অত্যাচার করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিবে।
এই সমস্ত জমিদার কোনো কাজ করতো না। বড় বড় শহরে এদের ভালো ভালো বাড়ি থাকতো, সেখানে আরামে মদ ও মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করা হতো। জমিদাররা অনেক জমি ফেলে রাখতো, কারণ তাদের খাস জমি চাষাবাদ হতো না। এইভাবে কোটি কোটি বিঘা জমি পড়ে থাকতো অনাবাদি হয়ে। আর একদিকে কোটি কোটি লোক কাজের অভাবে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করতো। কেউ চুরি ডাকাতি করতো আর কেউ না খেয়ে শৃগাল কুকুরের মতো রাস্তাঘাটে পড়ে থাকতো। এমনও অনেক শোনা গেছে যে, পেটের দায়ে বাবা মা মেয়েদের দিয়ে ব্যবসা করিয়ে কোনোমতে খাওয়ার বন্দোবস্ত করতো। বছরে বছরে দুর্ভিক্ষ হতো। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বলতে কিছুই ছিল না। কারণ যা উপার্জন করতো তার চেয়ে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি, তাই তা মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।
অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ তখন পরিবর্তন চায়। কারণ চীনের মানুষ কম্যুনিস্ট পার্টিকে ভালোবাসতো না। তাদের কথা শুনলে ভয়ে শিহরিয়া উঠতো। কিন্তু যখন মানুষের আর কোনো উপায় থাকে না, বিচারের আশা আর করতে পারে না, ইনসাফ দেশের থেকে উঠে যায় তখন মানুষ যাহা সম্মুখে পায় তাহাই আঁকড়াইয়া ধরে। চীনের জনগণই তার প্রধান প্রমাণ।
এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য যখন বেআইনি কম্যুনিস্ট পার্টি আবেদন জানালো, তখন মানুষ তার দিকে ছুটে চললো। আর একটা কারণ, চিয়াং কাইশেক তার দেশে বিরোধী দল গঠন করতে দেয় নাই। যারাই তার বিরুদ্ধে অথবা তার সরকারের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করতো তখনই তাদের জেল-জুলুম, ফাঁসি, গুলি, নানা রকমের অত্যাচার সহ্য করতে হতো। অনেকে রাজনীতি ছেড়েছিল, আর অনেকে বাধ্য হয়ে কম্যুনিস্ট দলের মধ্যে আশ্রয় নিয়া চিয়াং কাইশেকের অত্যাচার ও অবিচার খতম করার জন্য সক্রিয় সংগ্রাম শুরু করলো। এই অত্যাচারের বিরদ্ধে যখন কম্যুনিস্ট পার্টি যুদ্ধ ঘোষণা করলো, তখন চিয়াং সরকার সাধারণ মানুষের কোনো সমর্থন তো পেলোই না, উল্টা চিয়াং কাইশেক যাতে পরাজিত হয়, তার জন্য তারা চেষ্টা করতে শুরু করলো।
নয়াচীন সরকার কায়েম হওয়ার পরে তারা প্রথম কাজ শুরু করলেন, ‘লাঙল যার জমি তার’ এই প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে। বড় বড় জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্ত করে গরিব জমিহীন কৃষকের মধ্যে বণ্টন করে দিলো। সত্যিকারের কৃষক জমির মালিক হলো। যে সমস্ত অনাবাদি খাস জমি পড়ে ছিল, তাও ভাগ করে দিলো কৃষকদের মধ্যে। হাজার হাজার বেকার কৃষক জমি পেলো। যখন তারা বুঝতে পারলো জমির মালিক তারা, তাদের পরিশ্রমের ফল জমিদাররা আর ফাঁকি দিয়া নিতে পারবে না, তখন তারা পুরা উদ্যমে চাষাবাদ শুরু করলো। তবে একথা সত্য যে, নতুন চীন সরকার সকলকে সমান করে দেয় নাই, যা আমরা কম্যুনিস্টদের সম্বন্ধে শুনি। এখনও অনেক বড় চাষি জমির মালিক আছে, তারা লোক রেখে চাষাবাদ করে। তবে প্রয়োজনের অধিক যে জমি ছিল তা বাজেয়াপ্ত করে গরিব চাষিদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
নয়াচীনে একখÐ জমি দেখলাম না, যা অনাবাদি অবস্থায় পড়ে আছে। রেল লাইনের পাশে যে গর্তগুলি পড়ে থাকে সেগুলিতেও ফসল করা হয়েছে। যদি কোনো জমি ইচ্ছাকৃতভাবে পড়ে থাকে তাহলে সরকার কঠোর শাস্তি দেয়। জমি যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে তা পুরুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; স্বামী জমি যাহা পাবে, স্ত্রীও সমপরিমাণ জমি পাবে এবং দুজনকেই পরিশ্রম করতে হবে। কারণ, দুজনই জমির মালিক। স্বামী কাজ করবে আর স্ত্রী বসে খাবে এ প্রথা চীনের থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে। আমি ট্রেন থেকে পুরুষ ও মেয়েলোক অনেককেই হাল-চাষ করতে দেখেছি। মেয়েদের অধিকার সম্বন্ধে পরে আলোচনা করবো। জমির ট্যাক্স হিসাবে চাষিরা সরকারকে টাকা দিতেও পারে এবং ফসলের এক অংশও দিতে পারে। ট্যাক্স যে খুব কম, তা নয়। আমার মনে হলো, একটু বেশি।
কৃষক যে জিনিস উৎপাদন করে তার দাম আমাদের দেশের মতো কম হতে পারে না। আমাদের দেশে যখন ধান-পাট চাষির ঘরে থাকে, তখন দাম অল্প হয়। যখন মহাজনদের ঘরে থাকে তখন দাম বাড়তে থাকে। চাষি উৎপাদন খরচও পায় না। আর অন্যান্য জিনিস যা কৃষকের কিনতে হয়, যেমন নুন, তেল, কাপড়, এগুলির দাম এত বেশি থাকে আমাদের দেশে, যে কৃষক যা উৎপাদন করে তা দিয়ে তাদের সংসার চলে না। কিন্তু নয়াচীন একটা সামঞ্জস্য বিধান করেছে, কৃষক যা বিক্রি করে তার দাম দিয়ে ভালোভাবে অল্প দামে তেল, নুন, কাপড় কিনতে পারে। এতে তাদের জমির ফসলের দাম দিয়েই সংসার চালানো সহজ হয়েছে। গরিবদের পাঁচ টাকায় এক মন পাট বিক্রি করে ৪ টাকায় এক সের ডাল-তেল কিনতে হয় না তাদের দেশে। প্রত্যেক এলাকাতে সরকারি দোকান আছে সেখানে সস্তায় সমস্ত জিনিস পাওয়া যায়। কোনো দোকানদার ইচ্ছা করলেই বেশি দাম নিতে পারে না। কারণ যদি লোকে জানতে পায় যে, কোনো দোকানদার বেশি দাম নিচ্ছে তখন তারা সরকারি কর্মচারীদের খবর দিয়ে নিজেরাই ধরাইয়া দেয় এবং মিটিং করে ঠিক করে ঐ দোকানদারের দোকানে কেউই জিনিসপত্র কিনতে পারবে না। এতে চাষিদের যথেষ্ট উপকার হয়েছে। দেশের ভিতর গণজাগরণ এসেছে বলে এটা সম্ভবপর হয়েছে।
এক জায়গায় এক ঘটনা শুনলাম, এক সরকারি কর্মচারী ঘুষ খেয়েছিল, তাকে জনসাধারণ ধরাইয়া দেয়। ঘুষ খাওয়ার অপরাধে তার ফাঁসি হয়েছিল। সেই হতে কর্মচারীদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হয়েছে। কেউই ঘুষ খেতে সাহস পায় না।
এইভাবে চাষিদের জীবনে একটি বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে : যে চাষি সকলের চেয়ে বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারবে, তাকে পুরস্কার দেওয়া হবে। গ্রামে গ্রামে ‘মিউচুয়াল এইড সোসাইটি’ গড়ে উঠেছে। একে অন্যকে সাহায্য করে। গ্রামের গরিব চাষিরা এক হয়ে তাদের চাষাবাদ করে। এতে সকলের মধ্যে একতা গড়ে উঠেছে। ‘প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য, সকলেই সকলের জন্য›-এই নীতির প্রচার খুব হয়েছে এবং কাজও সেইভাবে হতেছে। গ্রামের গরিব চাষিরা একতাবদ্ধ হয়ে চাষাবাদ করাতে মানুষের মধ্যে বিভেদ ভাব দিন দিন দূর হয়ে যেতেছে।
চাষিদের মধ্যে জমি বণ্টন হওয়ায় যথেষ্ট লোক কাজ পেয়েছে। বেকারের সংখ্যাও দিন দিন কম হয়ে যেতেছে। চীন বহু বড় দেশ, সমস্ত দেশটায় চাষাবাদ হতে পারে। সরকার জনগণের সাহায্য নিয়ে হাজামজা নদী, খাল কাটতে শুরু করেছে। প্রত্যেক বৎসর বন্যায় লক্ষ একর জমির ফসল পূর্বে নষ্ট হয়ে যেত; আজ আর সাধারণ বর্ষায় ফসল নষ্ট হতে পারে না। একমাত্র হোয়াংহো নদীতে বন্যায় বৎসরে লক্ষ লক্ষ একর ফসল নষ্ট হতো। সরকার হোয়াংহো নদীতে বাঁধ বাঁধবে বলে জনগণকে ডাক দিলো। লক্ষ লক্ষ লোক পেটে খেয়ে সরকারকে সাহায্য করলো। হোয়াংহোকে বলা হয় চীনের দুঃখ। চীনারা আগে কোনোদিন এই বাঁধ বেঁধে রাখতে পারে নাই। কিন্তু বিপ্লবের পর দেশপ্রেম ও জাতীয় সংহতির দৃঢ়তায় চীনারা অসাধ্য সাধন করেছে। এখন আর হোয়াংহো নদীতে বন্যা হতে পারে না। লোকের এখন আর চিন্তা করতে হয় না। আরামে বৎসরের পর তাদের পরিশ্রমের ফল তারা পায়।
চীনের সরকারের কাজের একটা কায়দা আছে। তারা সকল কাজেই জনগণের সাহায্য চায়। জনগণ বুঝতে পারে এ কাজ তাদেরই মঙ্গলের জন্য, তাই সরকার যখনই ডাক দেয়, লক্ষ লক্ষ লোক তাতে সাড়া দেয়। এক জায়গায় শুনলাম, সরকার ডাক দিলো-›একশত মাইল একটা রাস্তা করতে হবে। তোমাদের যথেষ্ট অসুবিধা হতেছে; সরকারের অত টাকা নাই, তাই তোমাদের নিজেদের কাজ নিজেদের করাই উচিত। প্রত্যেকের আসতে হবে, অন্তত ২ দিন কাজ করে দিতে হবে।› সমস্ত লোক এসে কাজ শুরু করলো, সরকার তাদের খাবার দিলো। নারী পুরুষ নির্বিশেষে ১ মাসের ভিতর সমস্ত রাস্তা করে দিলো। এইভাবে নয়াচীনে হাজার হাজার গঠনমূলক কাজ জনসাধারণ করেছে, কারণ জনসাধারণের আস্থা আছে সরকারের ওপরে এবং মনে করে এ কাজ তাদের নিজেদের। এমন বহু ছোট বড় কাজ এই তিন বৎসরে চীন সরকার করেছে। একদিন যে চীনের দুনিয়ার কাছে খাদ্য ভিক্ষার জন্য হাত পেতে বসে থাকতে হতো, খাদ্যের অভাবে কোটি কোটি লোক মারা যেত, আজ সেই চীন বৎসরের খোরাক উৎপাদন করেও জনসাধারণকে আছুদামাফিক অর্থাৎ তৃপ্তিসহকারে মনের সাধ মিটিয়ে খাওয়াইয়া বিদেশে বহু খাদ্যশস্য চালান দেয়। দরকার হলে অন্য দেশকে বিপদের সময় সাহায্য করে। এর অর্থ, নয়া সরকার সৎ ও দেশপ্রেমিক এবং তাদের কাজ গঠনমূলক।
আমাকে এক সরকারি কর্মচারী বলেছেন, যদি কোনো লোক না খেয়ে কষ্ট পায় অথবা ঔষধের অভাব হয়, তাহলে সেইসমস্ত জায়গার সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য তাদের সাহায্য করা এবং কাজের, খাওয়ার ও ঔষধের বন্দোবস্ত করা। যদি শোনা যায় যে, কোনো এলাকায় কোনো লোক না খেয়ে মারা গেছে, তবে সেই এলাকার সরকারি কর্মচারীদের কৈফিয়ত দিতে হয়। সন্তোষজনক কৈফিয়ত না দিতে পারলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়। প্রত্যেক গ্রামে পঞ্চায়েত প্রথা চালু করা তাদের কাজ। ঐ সমস্ত এলাকায় কেউ অন্যায় করলে তার বিচার করা, সালিশি করে মিটিয়ে দেওয়া পঞ্চায়েতের কাজ। রাস্তাঘাট, স্বাস্থ্য, শিক্ষার দিকে নজর দেওয়াও এই পঞ্চায়েতের কাজ। এই পঞ্চায়েত কমিটির সভ্যদের ইলেকশনে মেম্বার হতে হয়। ছোটখাটো বিচার এরাই করে। তবে বিশেষ ধরনের অন্যায় করলে পিপল্স্ কোর্টে বিচার হয়। আসামির উকিল রাখতে হয় না। সরকার পক্ষ থেকে উকিল দেওয়া হয়। লোকাল ইনকোয়ারির পরে বিচার হয়। মিথ্যা মামলা অথবা মিথ্যা সাক্ষী জোগাড় করতে হয় না।
যে দেশে সরকারের কর্মচারীরা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় ও সেরকম সাক্ষ্য দিতে লোকদের বাধ্য করে তাদের ওপর মানুষের আস্থা থাকবে কী করে? ভয় করতে পারে, কিন্তু সে সরকার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পায় না। এইভাবে গ্রামের কৃষকদের মামলায় আসামি হয়ে জমি বন্ধক দিয়ে, মহাজনদের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে মামলা চালাতে হয় না। কোনো কৃষকের জমি বেচার হুকুম নাই। জমি এক হাত থেকে অন্য হাতে যেতে পারে না। ধরুন, আমাদের গ্রামের অবস্থায় কী হয়? এক গ্রামে একজন কি দু›জন মহাজন বা তালুকদার অথবা জমিদার থাকে, তারা যখন লোকের কোনো বিপদ হয়, বা না খেয়ে থাকে অথবা মেয়ে বিবাহের সময় হয়, মামলা মোকদ্দমায় পড়ে, তখন গ্রামের মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নেয় জমি বন্ধক দিয়ে, কেউবা বাড়ি বন্ধক দিয়ে। দেখা যায়, আস্তে আস্তে গ্রামের বারো আনা জমি এই মহাজনদের হাতে চলে যায়, আর কৃষকরা ভূমিহীন অথবা জমিহীন কৃষকে পরিণত হয়। তারপর একদিন কালের করাল গ্রাসে পড়ে বিনা চিকিৎসায় না খেয়ে মারা যায়।
আর হতভাগাদের ছেলেমেয়েরা কিছুদিন মহাজনের বাড়ি কাজ করে, কিছুদিন ভিক্ষা করে জীবন রক্ষা করে, তারপর একদিন গ্রাম ছেড়ে পেটের তাগিদে অন্য কোথাও চলে যায়। আর ফিরে আসে না। এই যাওয়াই শেষ যাওয়া হয়। বোধ হয়, প্রকৃতির কোলে চিরদিনের জন্য আশ্রয় নেয়। তাদের ছেলেমেয়েগুলি না খেয়ে থাকতে থাকতে একদিন ব্যারাম হয়ে মারা যায়। আমরা বলি অসুখ হয়ে মারা গেছে। কিন্তু না খেতে না খেতে যে ব্যারাম হয়, তারপর মারা যায়, একথা আমাদের দেশে বলে না। কারণ, সরকারের থেকে খবর নিলে জানা যায় যে, না খেয়ে মরে নাই, ব্যারাম হয়ে মারা গেছে। যদি কেউ না খেয়ে মরার খবর দেয় তবে তার কৈফিয়ত দিতে কাজ সারা হয়ে যায়। আর যদি কোনো খবরের কাগজে প্রকাশ হয়, তবে কাগজআলার কাগজটা দেশের নিরাপত্তার নামে বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর বেচারার আমার মতো নিরাপত্তা আইনে জেল খাটতে খাটতে জীবন শেষ হয়ে যায়। আমাদের দেশে মানুষ না খেয়ে মারা গিয়েছে এই খবরটা বন্ধ করার জন্য অথবা প্রতিবাদ করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা হয়। নয়াচীনে এরকম খবর রটলে সরকার এর খোঁজ নেয় কী জন্য লোকটা মারা গেছে। কতদিন না খেয়ে ছিল? জমিজমা কী পরিমাণ আছে? এরকম ঘটনা যেন আর ভবিষ্যতে না হয়। এই না খেয়ে মরার জন্য লোকাল কর্মচারীদের কৈফিয়ত দিতে হয়, আর আমাদের দেশে এই ঘটনা প্রকাশ হওয়ার জন্য কৈফিয়ত দিতে হয়। আপনারা বুঝতে পারবেন যদি আমি একটা ঘটনা বলি। আমাদের পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের জনৈক মন্ত্রী খুলনার দুর্ভিক্ষ এলাকা ভ্রমণ করে বললেন যে, “লোকে না খেয়ে মরছে না, মরছে পুষ্টির অভাবে।” পুষ্টির অভাব হয় কেন? এই কৈফিয়ত কে জিজ্ঞাসা করে? আর করলেই বা উত্তর দেবার জন্য লীগ মন্ত্রীমÐলী বাধ্য হবে কেন? কারণ তারা জানে নিরাপত্তা আইন তাদের হাতে আছে। ইচ্ছা করলে যে কোনো মুহূর্তে বিনা ওয়ারেন্টে যে কোনো লোককে গ্রেপ্তার করে জেলে রাখতে পারে বছরের পর বছর।
যা হোক, নয়াচীন বেকার সমস্যা দূর করতে চেষ্টা করছে। এজন্য তারা নজর দিচ্ছে, কুটিরশিল্পের দিকে। কুটিরশিল্পে সরকারের থেকে সাহায্য করা হয়। হাজার হাজার বেকারকে কাজ দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশের তাঁতিদের মতো লক্ষ লক্ষ তাঁতি কাপড় তৈয়ার করে, সুতা কেটে জীবন ধারণ করে। সরকার তাদের অল্প দামে সুতা দেয়, যাতে তারা কলের কাপড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কাপড় উৎপাদন করতে পারে। আমাদের দেশে বিদেশ থেকে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম সুতা এনে বড় বড় ব্যবসায়ীর মাধ্যমে সুতা বিলি করা হয়, যা কালোবাজারিতে বিক্রি হয়ে গরিব তাঁতিদের কাছে যখন পৌঁছে তখন দাম অনেক পড়ে যায়। তাই কাপড় তৈয়ার করে মিলের কাপড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পারে না। আমাদের সরকার বড় বড় কালোবাজারিদের দিয়ে বিদেশ থেকে কাপড়, সুতা আনায়। আর তা বেশি দামে বিক্রি করা হয় বাজারে। ফলে, একদিকে গরিব জনসাধারণের বেশি দামে কাপড় কিনতে হয়, আর অন্যদিকে তাঁতিরা সুতার অভাবে তাঁতের কাজ ছেড়ে দিয়ে বেকার হয়।
নয়াচীন সরকার কাপড়ের কলগুলিকে হুকুম দিয়েছে সুতা তৈয়ার করতে, সেই সুতা বিলি করা হয় সরকারি কর্মচারীদের মাধ্যমে গরিব তাঁতিদের কাছে। গরিব তাঁতিরা কাপড় তৈয়ার করে সরকারি স্টোরে জমা দেয়। এভাবে লক্ষ লক্ষ বেকার তাঁতি কাজ পাচ্ছে, বিদেশি কাপড় আনতে হচ্ছে না। কাপড়ের মিলগুলিও যথেষ্ট পরিমাণে সুতা তৈয়ার করছে এবং কাপড় তৈয়ার করছে। এদিকে ফ্যাক্টরিগুলিও পুরা উদ্যমে কাজ করছে আর লোকেও কাজ পাচ্ছে। তাঁতি কাপড় তৈয়ার করে আরামে দিন কাটাচ্ছে।
কুটিরশিল্পের অর্থ শুধু কাপড় তৈরি নয়। আরও অনেক কাজ করার জন্য সরকার হুকুম দিয়েছে এবং সাহায্য করছে। যেমন টেবিল, চেয়ার, খাট, হাঁড়ি, পাতিল, কাঁচি, ক্ষুর নানা প্রকারের জিনিস করার জন্য সরকার সাহায্য করে। অনেকে আবার সাবান তৈয়ারও করে। কোনো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসই বিদেশ থেকে আনা হবে না বলে সরকার হুকুমও যেমন দিয়াছে আবার জনগণকে সেসকল জিনিস উৎপাদন করার জন্য সাহায্যও করছে। এছাড়াও সরকার জনগণের সাহায্যে বড় বড় শিল্প গড়ে তুলছে, তাতে হাজার হাজার লোক আজ কাজ পাচ্ছে। দেশে শিল্প গড়ে না তুললে বেকার সমস্যা দূর করা যায় না। তাই নয়া সরকার সেদিকে খুব নজর দিয়েছে বলে মনে হয়। আমি অনেক বড় বড় সরকারি কর্মচারী ও শান্তি কমিটির সম্পাদকের সাথে আলাপ করেছি দোভাষীর মাধ্যমে। সাধারণ লোকের সাথে আলাপ করে যতদূর জানা যায়, তাতে এই মনে হলো যে, বেকার সমস্যা দূর করতে আরও ২/৩ বৎসর সময় লাগবে। তবে সাংহাই ইংরেজি দৈনিক কাগজের সম্পাদকের সাথে আলাপ করে তাঁর কাছ থেকে অনেক খবর পেয়েছিলাম। তিনি আমাকে জানালেন যে, এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫ লক্ষ বেকার আছে, তাদের সরকার টেকনিক্যাল ট্রেনিং দেবার ব্যবস্থা করেছে। কাহারও ছয় মাস লাগবে, কাহারও ১ বৎসর, আর কাহারও ৪ বৎসর লাগবে। এদের ট্রেনিং হওয়ার সাথে সাথে কাজ মিলে যাবে। ট্রেনিংয়ের সময় সরকার এদের এলাউন্স দেয়, যদিও তা যথেষ্ট নয়। তবে কোনোমতে চলে যায়। নতুন রাষ্ট্রÑ অর্থের অভাব, বেকার সমস্যা দূর করতে ও অন্যান্য কাজ করতে সময় লাগবেই তো!
(আমার দেখা নয়াচীন গ্রন্থ থেকে)
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী কে, জানেন?
বাংলাদেশি রোগী পেতে সীমান্ত পর্যন্ত মেট্রো চালু করবে ভারত
হাত ফসকে আইফোন পড়ে গেল মন্দিরের দানবাক্সে, ফেরত দিতে অস্বীকৃতি
কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫
ঢাকার বায়ুমানে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, বিপজ্জনকের কাছাকাছি
উগ্রবাদী সন্ত্রাসী 'সাদ' পন্থীদের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন
বাংলাদেশ সীমান্তে অত্যাধুনিক ড্রোন মোতায়েন ভারতের
নরসিংদীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছাত্রদলকর্মী নিহত
সিনেটে প্রার্থী হতে সরে দাঁড়ালেন লারা ট্রাম্প
আমাদেরকে আর স্বৈরাচার হতে দিয়েন না : পার্থ
মার্চের মধ্যে রাষ্ট্র-সংস্কার কাজ শেষ হবে : ধর্ম উপদেষ্টা
জামালপুরে দুই ইজিবাইকের চাপায় সাংবাদিক নুরুল হকের মৃত্যু
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইনের সামরিক সদর দফতরের দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি
ব্রাজিলে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩২
নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ সিরিয়ায়
ঘনকুয়াশায় ৩ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু
গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে
কনসার্ট মঞ্চে স্বৈরাচার হাসিনার বিচার দাবি
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও ১৪ ফিলিস্তিনি
ঘনকুয়াশায় আরিচা-কাজিরহাট, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ