কুমিল্লার রসমালাই

Daily Inqilab সাদিক মামুন

০৩ জুন ২০২৩, ০৯:১৩ পিএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৩, ০১:০২ এএম

রসমালাই কেনার জন্য প্রতিদিনই উপচে পড়া ভিড় থাকে কুমিল্লা শহরের নামকরা মিষ্টির দোকানগুলোতে। তবে কদর বেশি শহরের মনোনহরপুর এলাকার মাতৃভান্ডারের রসমালাইয়ের। এছাড়াও শহরের ভগবতী পেড়া ভান্ডার, শীতল ভান্ডার, পোড়াবাড়ি, জেনিস, জলযোগ, মালাই, মিঠাই, পিয়াসা ও রেলিসের রসমালাইয়ের চাহিদাও রয়েছে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিদেশি-দেশি অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয় কুমিল্লার রসমালাই দিয়ে। কুমিল্লায় কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর হাইকমিশনার বা প্রতিনিধিরা যখন প্রতিবছর নভেম্বরে ময়নামতি ওয়্যারসিমেট্রেতে আসেন, তখন ঢাকায় ফেরার পথে কুমিল্লার রসমালাই সঙ্গে নিয়ে যান।

কুমিল্লার রসমালাইয়ের স্বাদ নেননি এমন মানুষ পাওয়াই দুষ্কর। দেশের বিভিন্ন স্থানে রসমালাই তৈরি হলেও কুমিল্লার রসমালাই স্বাদে অতুলনীয়। কুমিল্লার রসমালাইয়ের সুনাম কেবল দেশেই নয়, দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও। কালের পরিক্রমায় নতুন প্রজন্মও কুমিল্লার রসমালাইয়ের শতবর্ষের ইতিহাস খুঁজে স্বাদের গভীরে। তবে এ প্রজন্মসহ কুমিল্লাবাসীর জন্য কুমিল্লার রসমালাই নিয়ে রয়েছে সুখবর! বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য বা জিআই পণ্য হিসেবে অনুমোদনের জন্য যে ১৮টি পণ্যের আবেদন করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী রসমালাই। সম্প্রতি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির জন্য কুমিল্লার জেলা প্রশাসক আবেদন করেছেন। আন্তর্জাতিক মেধাসত্ত্ব কর্তৃপক্ষ জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি দিয়ে থাকে।

শতবর্ষেরও বেশি সময়ের ঐতিহ্য নিয়ে স্বাদের জায়গাটি ধরে রেখেছে কুমিল্লার রসমালাই। কৃষ্ণ চন্দ্র দাস প্রথম রসমালাই তৈরি করেন। কুমিল্লায় রসমালাইয়ের আদি উদ্ভাবক ত্রিপুরা রাজ্যের ঘোষ সম্প্রদায়। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ত্রিপুরা থেকে ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকেরা বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে চাহিদা অনুযায়ী এ অঞ্চলের লোকদের বাহারি রকমের মিষ্টি সরবরাহ করতেন। সে সময় রসগোল্লার সঙ্গে মালাইকারির প্রলেপ দেওয়া এক রকম মিষ্টির প্রচলনও ছিল। কেউ কেউ একে ‘মালাই রসগোল্লা’ বলতেন। পরবর্তী সময়ে দুধ জ¦াল দিয়ে খির বানিয়ে তার মধ্যে শুকনো রসগোল্লা ডুবিয়ে তৈরি করা হয় খিরসহ রসগোল্লা। এর নাম দেওয়া হয় ‘খিরভোগ’। ১৯৩০ সালের দিকে এই রসগোল্লার আকার ছোট করে দুধের খিরের মধ্যে ডুবিয়ে পরিবেশন শুরু হয় এবং একপর্যায়ে এর নামকরণ হয় রসমালাই। ওই সময় থেকেই ক্ষণীন্দ্র সেন কুমিল্লার মিষ্টি ব্যবসায় রসমালাই বানিয়ে পরিচিতি পেতে থাকেন। পরবর্তীতে তাঁর সন্তান শংকর সেনগুপ্তের হাত ধরে এটি কুমিল্লায় ব্যাপকভাবে বিকশিত হয় এবং রসমালাইয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশান্তরে। প্রথম দিকে মাটির হাঁড়িতে করে বিক্রি হতো রসমালাই। পরে চালু হয় পলিথিনের ঠোঙা। এরপর আসে প্লাস্টিকের কৌটা, যা এখনো চলছে। বর্তমানে মাতৃভান্ডারের রসমালাইয়ের ব্যবসা পরিচালনা করছেন পাঁচ বছর আগে পরলোকগত শংকর সেনগুপ্তের ছেলে অনির্বাণ সেনগুপ্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এই শিক্ষার্থী কোনো চাকরিতে না গিয়ে বংশপরম্পরায় পরিবারের মিষ্টান্ন ব্যবসায় শামিল হন।

কুমিল্লার রসমালাইয়ের প্রস্তুতপ্রণালী সম্পর্কে কয়েকজন প্রবীণ কারিগরের মুখ থেকে জানা যায়, প্রথমে বিভিন্ন গোয়ালার কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করা হয়। এরপর ওই দুধ চুলার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় জ্বাল দেওয়া হয়। অন্তত দুই ঘণ্টা জ্বাল দেওয়ার পর দুধ ঘন হয়ে মালাইয়ে রূপ নেয়। দুধের ঘনত্ব যত বেশি হবে, রসমালাই তত বেশি সুস্বাদু হবে। ঘন মালাই চুলা থেকে নামিয়ে আলাদা তৈরি করা ছোট ছোট দানা আকারের মিষ্টি বড় গামলায় মেশানো হয়। তারপর কিছুটা ঠান্ডা হলেই পূর্ণতা পায় রসমালাইয়ের। ভালোভাবে তৈরি রসমালাই ফ্রিজবিহীন ৩৬ ঘণ্টা পর্যন্ত রাখা যায়।
শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান মাতৃভান্ডারের স্বত্ত্বাধিকারী অনির্বাণ সেনগুপ্ত জানান, প্রতিদিনই রসমালাইয়ের চাহিদা থাকে বেশি। কিন্তু দুধের জোগান কম হলে, রসমালাইও কম তৈরি হয়। বেশি হলে বেশি পরিমাণে বানানো যায়। মান ও গুণ ধরে রাখার জন্য আমরা সব সময় চেষ্টা করি। আমাদের কোনো শাখা নেই। মহাসড়কের পাশে আমাদের নাম ব্যবহার করে যেসব প্রতিষ্ঠান রসমালাই বিক্রি করছেন, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের প্রবীণ কারিগরদের কাছ থেকে এপ্রজন্মের কারিগররা রসমালাই তৈরির প্রণালী শিখে নিচ্ছেন। আমি মনে করি, কুমিল্লার রসমালাই একদিকে যেমন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি সুস্বাদু মিষ্টি হিসেবে বিদেশিদের কাছেও বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছে।

লেখক: স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক ইনকিলাব, কুমিল্লা।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা

বিষয় : year


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আওয়ামী লীগের বেলাগাম পুঁজিলুণ্ঠন
বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পটভূমিতে এবারের বিজয় দিবস
ইসলামোফোবিয়া
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, যার মর্মমূলে স্বাধীন জাতিসত্তার চেতনা
স্মৃতি রোদ
আরও

আরও পড়ুন

ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার

ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার

ইরানে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে নিহত ১০

ইরানে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে নিহত ১০

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী কে, জানেন?

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী কে, জানেন?

বাংলাদেশি রোগী পেতে সীমান্ত পর্যন্ত মেট্রো চালু করবে ভারত

বাংলাদেশি রোগী পেতে সীমান্ত পর্যন্ত মেট্রো চালু করবে ভারত

হাত ফসকে আইফোন পড়ে গেল মন্দিরের দানবাক্সে, ফেরত দিতে অস্বীকৃতি

হাত ফসকে আইফোন পড়ে গেল মন্দিরের দানবাক্সে, ফেরত দিতে অস্বীকৃতি

কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫

কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫

ঢাকার বায়ুমানে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, বিপজ্জনকের কাছাকাছি

ঢাকার বায়ুমানে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, বিপজ্জনকের কাছাকাছি

উগ্রবাদী সন্ত্রাসী 'সাদ' পন্থীদের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন

উগ্রবাদী সন্ত্রাসী 'সাদ' পন্থীদের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন

বাংলাদেশ সীমান্তে অত্যাধুনিক ড্রোন মোতায়েন ভারতের

বাংলাদেশ সীমান্তে অত্যাধুনিক ড্রোন মোতায়েন ভারতের

নরসিংদীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছাত্রদলকর্মী নিহত

নরসিংদীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছাত্রদলকর্মী নিহত

সিনেটে প্রার্থী হতে সরে দাঁড়ালেন লারা ট্রাম্প

সিনেটে প্রার্থী হতে সরে দাঁড়ালেন লারা ট্রাম্প

আমাদেরকে আর স্বৈরাচার হতে দিয়েন না : পার্থ

আমাদেরকে আর স্বৈরাচার হতে দিয়েন না : পার্থ

মার্চের মধ্যে রাষ্ট্র-সংস্কার কাজ শেষ হবে : ধর্ম উপদেষ্টা

মার্চের মধ্যে রাষ্ট্র-সংস্কার কাজ শেষ হবে : ধর্ম উপদেষ্টা

জামালপুরে দুই ইজিবাইকের চাপায় সাংবাদিক নুরুল হকের মৃত্যু

জামালপুরে দুই ইজিবাইকের চাপায় সাংবাদিক নুরুল হকের মৃত্যু

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইনের সামরিক সদর দফতরের দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইনের সামরিক সদর দফতরের দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি

ব্রাজিলে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩২

ব্রাজিলে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩২

নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ সিরিয়ায়

নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ সিরিয়ায়

ঘনকুয়াশায় ৩ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু

ঘনকুয়াশায় ৩ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু

গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে

গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে

কনসার্ট মঞ্চে স্বৈরাচার হাসিনার বিচার দাবি

কনসার্ট মঞ্চে স্বৈরাচার হাসিনার বিচার দাবি