ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

নাটোরের কাঁচাগোল্লা

Daily Inqilab মো. আজিজুল হক টুকু

০৩ জুন ২০২৩, ০৯:১৮ পিএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৩, ০১:০২ এএম

নাটোরের ঐতিহ্যম-িত উপাদানগুলোর মাঝে সব চাইতে শীর্ষে রয়েছে নাটোরের ‘কাঁচাগোল্লা’। কাঁচাগোল্লা এক সুস্বাদু মিষ্টান্নের নাম। কাঁচা নয় আবার আকারে গোলও নয় তবুও নাম দেয়া হয়েছে কাঁচাগোল্লা।

কাঁচাগোল্লার নামকরণ ও কাঁচাগোল্লা সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে নাটোরে একটি গল্প প্রচলিত আছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাণী ভবানী মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করতেন। তার প্রাসাদে লালবাজারের মিষ্টির দোকানি মধুসূদন পাল নিয়মিত মিষ্টি সরবরাহ করতেন। মধুসূদন পালের দোকানে ১৫-২০ জন কর্মচারী কাজ করতেন। হঠাৎ একদিন ঐ দোকানের সব কর্মচারী অসুস্থ হয়ে পড়লে দোকানে রাখা দুই মণ ছানা নিয়ে মধুসূদন পাল পড়লেন বিপাকে। নষ্ট হয়ে যেতে পারে ভেবে মধুসূদন ছানাগুলো জ্বাল দেয়া চিনির রসে ভিজিয়ে দেন। এরপর একটু চেখে দেখেন দারুণ স্বাদ হয়েছে। ঐদিন রাণীর পেয়াদা মিষ্টি নিতে আসলে সাতপাঁচ না ভেবেই তিনি ঐ রসে ভেজানো ছানাগুলোই মিষ্টান্ন হিসেবে প্রাসাদে পাঠিয়ে দেন। নতুন ধরনের এই মিষ্টি খেয়ে রাণীর খুব পছন্দ হলো। মিষ্টিটির নাম জানার জন্য প্রাসাদে মধুসূদনের ডাক পড়লো। মধুসূদন মিষ্টির নাম না বলে মিষ্টি তৈরির কারণ ও পদ্ধতি রাণী ভবানীকে জানালেন। ছানাকে গোলাকার করে তেলে ভেজে চিনির রসে ডুবিয়ে তৈরি করা হয় রসগোল্লা। কিন্তু নতুন মিষ্টিতে ছানাকে তেলে ভাজা হয়নি, কাঁচা ছানাই চিনির রসে ভেজানো হয়েছিল। একারণে এর নাম হলো ‘কাঁচাগোল্লা’।

ছানা ও চিনির পাশাপাশি কাঁচাগোল্লায় মশলা হিসেবে এলাচ দেয়া হয়। এতে কাঁচাগোল্লায় সৃষ্টি হয় অনুপম স্বাদ ও মনমাতানো সুগন্ধ। প্রায় আড়াইশ’ বছর ধরে নাটোরের কাঁচাগোল্লা দেশ-বিদেশের বহু মানুষের রসনায় তৃপ্তি যুগিয়ে আসছে।

কাঁচাগোল্লার স্বাদ রসগোল্লা, পানিতোয়া, এমনকি সন্দেশকেও হার মানিয়ে দেয়। এতে রয়েছে কাঁচা ছানার অকৃত্রিম সুগন্ধ, যা অন্য কোনো মিষ্টিতে পাওয়া যায় না। মধুসূদন পাল তার দোকানে নিয়মিতভাবেই এই মিষ্টি বানাতে থাকেন আর কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি ধীরে ধীরে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মুধুসূদন পালের দোকানে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন মণ ছানার কাঁচাগোল্লা তৈরি হতে লাগলো। সে সময় ঢোল বাজিয়ে কাঁচাগোল্লার প্রচারণা চালানো হতো।

রাণী ভবানীর আমল থেকে তথা ১৭৬০ সাল থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত সুনাম ও সুখ্যাতি ধরে রেখেছে নাটোরের ‘কাঁচাগোল্লা’। এ কাঁচাগোল্লা নাটোর-রাজশাহী অঞ্চল ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় যেত, এমনকি তা ইংল্যান্ডের রাজ পরিবারেও পৌঁছে গিয়েছিল বলে জানা যায়। তৎকালীন রাজশাহী গেজেট পত্রিকাতেও নাটোরের কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতির কথা লেখা হয়েছিল।

কলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতেও সেই সময় কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছিল। কলকাতা এবং নাটোর শহর একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এবং তৎকালেএই দুই শহরের মাঝে সার্বক্ষণিক ঘণিষ্ঠ যোগাযোগ থাকায় নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ভারত, ইংল্যান্ডসহ তৎকালীন বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই কাঁচাগোল্লা পায় আন্তর্জাতিক পরিচিতি। ১৮৪০ সালে দিঘাপতিয়ার রাজা প্রসন্ন নাথ রায় কৃষ্ণ উৎসবে আসা ভক্তদের কাঁচাগোল্লা দিয়েই আপ্যায়িত করেন। তখন প্রতি সের কাঁচাগোল্লার দাম ছিল তিন আনা।

নাটোর শহরের জলযোগ মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্তাধিকারী জয়দেব কুমার ঘোষ জানান, আগে দেশি গরুর দুধের ছানা দিয়ে কাঁচাগোল্লা তৈরি করা হতো। তাতে ননির পরিমাণ থাকতো বেশি। তাই তার স্বাদ এবং সুগন্ধ ছিল অতুলনীয়।

বর্তমানে আর দেশি গাভীর দুধ দিয়ে পোশায় না। অস্ট্রেলিয়ান গাভীর দুধ দিয়ে কাঁচাগোল্লা তৈরি করা হয়। ননি কম থাকায় বিদেশি গাভীর দুধের ছানায় তৈরি কাঁচাগোল্লার স্বাদ এবং গন্ধও তুলনামূলক কম। আর গরুর খাদ্য দ্রব্যের দাম বাড়ার সাথে সাথে চিনি, দুধ, জ্বালানি, কারিগরের বেতন সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় ১ কেজি কাঁচাগোল্লা তৈরি করতে মোটামোটি ৫শ’ টাকার মতো খরচ হয়ে যায়, যার কারণে প্রতি কেজি কাঁচাগোল্লা কমপক্ষে ৫শ’ ২০ টাকা থেকে সাড়ে ৫শ’ টাকা দামে বিক্রি করতে হয়। জয়দেব কুমার ঘোষ আরোও বলেন, তার দোকান থেকে প্রবাসীরা সৌদি আরব, ইতালী, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে যাওয়ার সময় প্রত্যেকে ৫-৮ কেজি পরিমাণ কাঁচাগোল্লা সঙ্গে নিয়ে যায়।

নাটোরের জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভূঞা বলেন, নাটোরের কাঁচাগোল্লাকে জিআই পণ্য হিসেবে গণ্য করা ও স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য নাটোরের জেলা প্রশাসন থেকে চলতি ২০২৩ সালের ২৯ মার্চ শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্যাটেন্ট ডিজাইন অফিসে আবেদন করা হয়েছে।
নাটোরের বিশিষ্ট সমাজসেবী ও সংবাদকর্মী মনজুর সাব্বির মনে করেন, কাঁচাগোল্লা নাটোরের ঐতিহ্য ও প্রসিদ্ধির অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। তাই এর গুণগত মান ঠিক রাখা এবং এর ব্যাপক প্রচারণা ও বিক্রয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকলের আরো বেশি ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।

লেখক: নাটোর জেলা সংবাদদাতা, দৈনিক ইনকিলাব।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা

বিষয় : year


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা