নাটোরের কাঁচাগোল্লা
০৩ জুন ২০২৩, ০৯:১৮ পিএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৩, ০১:০২ এএম
নাটোরের ঐতিহ্যম-িত উপাদানগুলোর মাঝে সব চাইতে শীর্ষে রয়েছে নাটোরের ‘কাঁচাগোল্লা’। কাঁচাগোল্লা এক সুস্বাদু মিষ্টান্নের নাম। কাঁচা নয় আবার আকারে গোলও নয় তবুও নাম দেয়া হয়েছে কাঁচাগোল্লা।
কাঁচাগোল্লার নামকরণ ও কাঁচাগোল্লা সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে নাটোরে একটি গল্প প্রচলিত আছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাণী ভবানী মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করতেন। তার প্রাসাদে লালবাজারের মিষ্টির দোকানি মধুসূদন পাল নিয়মিত মিষ্টি সরবরাহ করতেন। মধুসূদন পালের দোকানে ১৫-২০ জন কর্মচারী কাজ করতেন। হঠাৎ একদিন ঐ দোকানের সব কর্মচারী অসুস্থ হয়ে পড়লে দোকানে রাখা দুই মণ ছানা নিয়ে মধুসূদন পাল পড়লেন বিপাকে। নষ্ট হয়ে যেতে পারে ভেবে মধুসূদন ছানাগুলো জ্বাল দেয়া চিনির রসে ভিজিয়ে দেন। এরপর একটু চেখে দেখেন দারুণ স্বাদ হয়েছে। ঐদিন রাণীর পেয়াদা মিষ্টি নিতে আসলে সাতপাঁচ না ভেবেই তিনি ঐ রসে ভেজানো ছানাগুলোই মিষ্টান্ন হিসেবে প্রাসাদে পাঠিয়ে দেন। নতুন ধরনের এই মিষ্টি খেয়ে রাণীর খুব পছন্দ হলো। মিষ্টিটির নাম জানার জন্য প্রাসাদে মধুসূদনের ডাক পড়লো। মধুসূদন মিষ্টির নাম না বলে মিষ্টি তৈরির কারণ ও পদ্ধতি রাণী ভবানীকে জানালেন। ছানাকে গোলাকার করে তেলে ভেজে চিনির রসে ডুবিয়ে তৈরি করা হয় রসগোল্লা। কিন্তু নতুন মিষ্টিতে ছানাকে তেলে ভাজা হয়নি, কাঁচা ছানাই চিনির রসে ভেজানো হয়েছিল। একারণে এর নাম হলো ‘কাঁচাগোল্লা’।
ছানা ও চিনির পাশাপাশি কাঁচাগোল্লায় মশলা হিসেবে এলাচ দেয়া হয়। এতে কাঁচাগোল্লায় সৃষ্টি হয় অনুপম স্বাদ ও মনমাতানো সুগন্ধ। প্রায় আড়াইশ’ বছর ধরে নাটোরের কাঁচাগোল্লা দেশ-বিদেশের বহু মানুষের রসনায় তৃপ্তি যুগিয়ে আসছে।
কাঁচাগোল্লার স্বাদ রসগোল্লা, পানিতোয়া, এমনকি সন্দেশকেও হার মানিয়ে দেয়। এতে রয়েছে কাঁচা ছানার অকৃত্রিম সুগন্ধ, যা অন্য কোনো মিষ্টিতে পাওয়া যায় না। মধুসূদন পাল তার দোকানে নিয়মিতভাবেই এই মিষ্টি বানাতে থাকেন আর কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি ধীরে ধীরে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মুধুসূদন পালের দোকানে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন মণ ছানার কাঁচাগোল্লা তৈরি হতে লাগলো। সে সময় ঢোল বাজিয়ে কাঁচাগোল্লার প্রচারণা চালানো হতো।
রাণী ভবানীর আমল থেকে তথা ১৭৬০ সাল থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত সুনাম ও সুখ্যাতি ধরে রেখেছে নাটোরের ‘কাঁচাগোল্লা’। এ কাঁচাগোল্লা নাটোর-রাজশাহী অঞ্চল ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় যেত, এমনকি তা ইংল্যান্ডের রাজ পরিবারেও পৌঁছে গিয়েছিল বলে জানা যায়। তৎকালীন রাজশাহী গেজেট পত্রিকাতেও নাটোরের কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতির কথা লেখা হয়েছিল।
কলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতেও সেই সময় কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছিল। কলকাতা এবং নাটোর শহর একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এবং তৎকালেএই দুই শহরের মাঝে সার্বক্ষণিক ঘণিষ্ঠ যোগাযোগ থাকায় নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ভারত, ইংল্যান্ডসহ তৎকালীন বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই কাঁচাগোল্লা পায় আন্তর্জাতিক পরিচিতি। ১৮৪০ সালে দিঘাপতিয়ার রাজা প্রসন্ন নাথ রায় কৃষ্ণ উৎসবে আসা ভক্তদের কাঁচাগোল্লা দিয়েই আপ্যায়িত করেন। তখন প্রতি সের কাঁচাগোল্লার দাম ছিল তিন আনা।
নাটোর শহরের জলযোগ মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্তাধিকারী জয়দেব কুমার ঘোষ জানান, আগে দেশি গরুর দুধের ছানা দিয়ে কাঁচাগোল্লা তৈরি করা হতো। তাতে ননির পরিমাণ থাকতো বেশি। তাই তার স্বাদ এবং সুগন্ধ ছিল অতুলনীয়।
বর্তমানে আর দেশি গাভীর দুধ দিয়ে পোশায় না। অস্ট্রেলিয়ান গাভীর দুধ দিয়ে কাঁচাগোল্লা তৈরি করা হয়। ননি কম থাকায় বিদেশি গাভীর দুধের ছানায় তৈরি কাঁচাগোল্লার স্বাদ এবং গন্ধও তুলনামূলক কম। আর গরুর খাদ্য দ্রব্যের দাম বাড়ার সাথে সাথে চিনি, দুধ, জ্বালানি, কারিগরের বেতন সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় ১ কেজি কাঁচাগোল্লা তৈরি করতে মোটামোটি ৫শ’ টাকার মতো খরচ হয়ে যায়, যার কারণে প্রতি কেজি কাঁচাগোল্লা কমপক্ষে ৫শ’ ২০ টাকা থেকে সাড়ে ৫শ’ টাকা দামে বিক্রি করতে হয়। জয়দেব কুমার ঘোষ আরোও বলেন, তার দোকান থেকে প্রবাসীরা সৌদি আরব, ইতালী, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে যাওয়ার সময় প্রত্যেকে ৫-৮ কেজি পরিমাণ কাঁচাগোল্লা সঙ্গে নিয়ে যায়।
নাটোরের জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভূঞা বলেন, নাটোরের কাঁচাগোল্লাকে জিআই পণ্য হিসেবে গণ্য করা ও স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য নাটোরের জেলা প্রশাসন থেকে চলতি ২০২৩ সালের ২৯ মার্চ শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্যাটেন্ট ডিজাইন অফিসে আবেদন করা হয়েছে।
নাটোরের বিশিষ্ট সমাজসেবী ও সংবাদকর্মী মনজুর সাব্বির মনে করেন, কাঁচাগোল্লা নাটোরের ঐতিহ্য ও প্রসিদ্ধির অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। তাই এর গুণগত মান ঠিক রাখা এবং এর ব্যাপক প্রচারণা ও বিক্রয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকলের আরো বেশি ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।
লেখক: নাটোর জেলা সংবাদদাতা, দৈনিক ইনকিলাব।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
বিষয় : year
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মেরিটাইম সেক্টরে বিদেশীদের বিনিয়োগের আহবান উপদেষ্টার
সাঁতারে আক্ষেপের নাম ‘ইলেক্ট্রোনিক্স স্কোরবোর্ড’!
সাবিনাদের জন্য শনিবার পুরস্কার ঘোষণা করবে বাফুফে
ঈশ্বরদীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত-২ আহত-৩
সর্বনি¤œ হজ প্যাকেজ ৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা ঘোষণা
যশোরে মাদক ব্যবসায়ীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
৭ নভেম্বরের চেতনাকে যারা ধারণ করে না, তারা গণতন্ত্রের শত্রু - ডা.মাজহার
প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার ২ সেকেন্ডের মধ্যেই কার চাকরি খাবেন ট্রাম্প?
ঐতিহাসিক জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস; চব্বিশের প্রেরণা
জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে জাগপার আলোচনা সভা
মানুষের মতোই কথা বলবে, আচরণ করবে এআই!
আখাউড়া প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি গঠন
পরিবহনব্যবস্থা
রমজানের নিত্যপণ্য আমদানিতে ব্যাংকে লাগবে না নগদ অর্থ: গভর্নর
ময়নামতি ও বসুরহাটে ইউসিবির দুই নতুন শাখা উদ্বোধন
অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস : সাফল্য ও ব্যর্থতা
৫ আগস্টের আয়নায় দেখা ৭ নভেম্বর
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন
জাইকার সহযোগিতায় রাজউকের তৃতীয় ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট সেমিনার অনুষ্ঠিত
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তৈলতত্ত্ব ও আমাদের সাহিত্য সমাজ