কায়কোবাদের মহাশ্মশান অসাম্প্রদায়িক বোধে ভাস্বর
২৭ জুন ২০২৩, ০৮:৪৪ পিএম | আপডেট: ২৭ জুন ২০২৩, ১১:৪২ পিএম
উনিশ শতকীয় বাঙালির অন্যতম মনীষা, আধুনিক বাংলা কাব্যক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের অগ্রবর্তী প্রতিনিধি মহাকবি কায়কোবাদ (কাজেম আল কোরায়শী) ১৮৫৭-১৯৫১। তিনি মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি। স্থানীয় কবিকর্মী হয়েও তিনি অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নানা বিষয়-বৈচিত্র্যে কাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হন। আর সেই অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে তাঁর ‘মহাশ্মশান’ (১৯০৪) মহাকাব্যগ্রন্থে। এ ছাড়াও তাঁর ‘কুসুম কানন’ (১৮৭৩), ‘অশ্রুমালা’ (১৮৯৬), ‘অমিয় ধারা’ (১৯২৩), ‘প্রেমের ফুল’ (১৯৭০) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে কবির স্বতন্ত্রতার অনুরণন বিদ্যমান। এই গ্রন্থসমূহে তাঁর আবগেমথিত চিত্তের পরিচয় মেলে।
কায়কোবাদ তাঁর মহাশ্মশান মহাকাব্যে জাতীয়তাবোধকে জাগিয়ে তুলতে প্রয়াসী ছিলেন। তিনি ইতিহাসের ঘটনাপুঞ্জিকে অঙ্কন করেছেন সত্যনিষ্ঠ দৃষ্টিতে। তাঁর মনন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় নিমগ্ন। এ কারণে তাঁর দৃষ্টিতে মুসলমান যেমন বীর, তেমনি হিন্দুও বীর। এই উভয় সম্প্রদায়ের বীরদের যথার্থ মূল্যায়ন তিনি তাঁর এ কাব্যে তুলে ধরেছেন অত্যন্ত সার্থকতায়।
পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের (১৭৬১ খ্রিস্টাব্দ) ভয়াবহতা ও নির্মমতার প্রেক্ষাপটে রচিত হয় মহাশ্মশান মহাকাব্য। এর কাহিনি ঐতিহাসিক সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। ভারতে হিন্দু রাজ্য প্রতিস্থাপনে সংকল্পবদ্ধ উদীয়মান মারাঠী শক্তির সঙ্গে আফগান অধিপতি আহমদ শাহ আবদালীর সহায়তায় রোহিলার নবাব নজীবদ্দৌলার শক্তি পরীক্ষার সত্য কাহিনি হচ্ছে মহাশ্মশান। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠীরা একেবারেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং মুসলিম শক্তি বিজয় গৌরবে মহিমান্বিত হয়। কবির মতে, এ বিজয় সর্বাংশে মুসলমানদের বিজয় নয়; কারণ, এ যুদ্ধ মুসলমানদের মনোবল চিরদিনের জন্য ভেঙে দেয়। তাদেরকে পরিয়ে দেয় পরাধীনতার শৃঙ্খল। অবশ্য তাঁর এ কাব্য রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের শৌর্য-বীর্য প্রকাশ করা। তিনি তা অকপটে বলেছেন এভাবে, ‘আমি বহুদিন যাবৎ মনে মনে এই আশাটি পোষণ করিতেছিলাম যে, ভারতীয় মুসলমানদের শৌর্য-বীর্য সম্বলিত এমন একটি যুদ্ধকাব্য লিখিয়া যাইব, যাহা পাঠ করিয়া বঙ্গীয় মুসলমানরা স্পর্ধা করিয়া বলিতে পারেন যে, একসময় ভারতীয় মুসলমানগণও অদ্বিতীয় বীর ছিলেন। শৌর্য ও গৌরবে কোনো অংশেই তাহারা জগতের অন্য কোনো জাতি অপেক্ষা হীনবীর্য বা নিকৃষ্ট ছিলেন না।...আমার সে আশা পূর্ণ হইয়াছে।’ (প্রথম সংস্করণের ভূমিকা)।
মুসলমানদের এ শৌর্য-বীর্য প্রকাশার্থে কবি যে প্রেক্ষাপট নির্বাচন করেছেন তাতে একজন মুসলিম কবিকর্মী হিসেবে তিনি তাঁর কাব্যে হিন্দুদের ভিন্নভাবে চিত্রিত করতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। তিনি ভাবতেন, ‘আমার বহু পরিশ্রমের এই গ্রন্থ আমাদের জাতীয় গৌরবের মহাশ্মশান’। ‘একপক্ষে পানিপথ যেমন হিন্দু গৌরবের সমাধীক্ষেত্র, অপরপক্ষে সেরূপ মুসলমান গৌরবেরও মহাশ্মশান।’ (ভূমিকাংশ)।
মহাশ্মশান কাব্যে সংগ্রামে ও ত্যাগে ঋজু, বলিষ্ঠ ও শক্তিমান মারাঠী জাতির রক্তাক্ত, বেদনার্ত ও বিপর্যন্ত বাস্তবতার পাশাপাশি মুসলমানদের বিজয় উৎসব কবির কাছে মনে হয় অযৌক্তিক। তিনি কিছুতেই মুসলমানদের বিজয়কে মনে করতে পারেননি। তাঁর ধারণা ছিলো, ‘মুসলমান যদিও এই যুদ্ধে জয়লাভ করিয়াছিল বটে, তথাপি তাহারা এতো দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিলেন যে, আহমদ শাহ আবদালী কাবুল চলিয়া যাওয়ার অব্যবহিত পরে বহিঃশত্রুর হস্ত হইতে ভারত সা¤্রাজ্য রক্ষা করিবার শক্তি তখন তাহাদের আদৌ ছিলো না।’ (ভূমিকাংশ)।
একই ভূখ-ে দু’ভিন্ন জাতির শক্তির জয় পরাজয়ের নির্মম বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে যেখানে পরিণাম হয়ে ওঠে পরাধীনতার সংকেত সূত্রবাহী, সেখানে কবিচিত্তের সত্য সুন্দর দৃষ্টিবোধ; প্রগাঢ় আবেগানুভূতিতে হৃদয়ের বিচিত্র রঙে রঞ্জিত সুন্দর উজ্জ্বল জীবন্ত চরিত্র হিসেবে আমরা মহাশ্মশানে পাই ইব্রাহিম কার্দি, জোহরা বেগম, আতা খাঁ হিরণ, রতœজি লবঙ্গ, বিশ্ব¦নাথ মৌসুর্দী প্রভৃতি। জাগতিক রক্তক্ষরণের যন্ত্রণা উন্মোচনের মাধ্যমে মূলত যা প্রকাশ করেছেন তা মাত্র একজন মানুষকেই উন্মেলিত করে না, বরং জাতীয় জীবনেও সূচিত করে নিরস্ত্র অন্ধকার। আর তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহযোগে প্রকাশ করেছেন কায়কোবাদ। এ কাব্যে কবির অসাম্প্রদায়িক চেতনা দৃষ্টি উন্মোচনের জন্য আতা খাঁ-হিরণের প্রেম প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য। নিজ সম্প্রদায়ের অমরকে ভালোবাসতে গিয়ে হিরণ একসময় আবিষ্কার করে অমর প্রকৃতপক্ষে একজন মুসলিম সৈনিক আতা খাঁ। এ সত্য আবিষ্কারের পরও হিরণ বিচলিত হয়নি। কারণ, সে হিন্দু অথবা মুসলমানকে নয়; বরং মানুষকেই ভালোবাসে, মানুষই তার আরাধ্য সম্পদ। তাই সে ঋজু ও বলিষ্ঠ চিত্তে বলতে পারে, ‘যে জাতি হওনা তুমি ক্ষতি কি তাহাতে/ আমার এ ভালোবাসা অটুট থাকিবে/ কেননা জাতিকে আমি ভালোত বাসিনি/ আমি যে বেসেছি ভালো অমর তোমারে।...আতা খাঁ অমরে বল আছে কি প্রভেদ/ ইহাতে লৌকিক নাম নশ্বর জগতে।’ (দ্বিতীয় খ-, সপ্তদশ সর্গ)।
হিরণের এ উক্তি থেকে এ কাব্যে কবির অসাম্প্রদায়িক চেতনাদৃষ্টি হয়তো সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয় না। তবু ভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত একজন যুবকের প্রতি হিন্দু নারী হিরণের বক্তব্য নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। হিরণের এ বক্তব্য মূলত কায়কোবাদেরই নিজস্ব। জাতি, ধর্ম ও কৌলিন্যের সীমায়িত গ-ি অতিক্রম করে একটি অসাম্প্রদায়িক কাব্য নির্মাণই ছিলো কবির মূল অভিপ্সা।
মহাশ্মশান কাব্য রচনার মাধ্যমে মুসলমানদের শৌর্য-বীর্য প্রকাশ করা কবির মুখ্য উদ্দেশ্য হলেও এ কাব্য পাঠ করে মুসলমানরা অনেক ক্ষেত্রে হতাশ হয়েছেন। এ কাব্যে গঙ্গান্তর ও কালি মাহাত্ম্য বর্ণনা করায় মুসলমানগণ বিক্ষুব্ধতাড়িত হয়েছে, যা কতটুকু প্রাসঙ্গিক তা না বললেও চলে। নিজ সম্প্রদায়ের স্তুতিবাদে মুখর হয়ে তিনি কখনো ভিন্ন সম্প্রদায়কে তিরস্কার করেননি। যুদ্ধ যখন ঘূর্ণয়মান তখনও তিনি দু’সম্প্রদায়ের বিবেকবান বীর পুরুষদের কণ্ঠ দিয়ে উচ্চারণ করিয়েছেন অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী প্রসঙ্গ। এ প্রসঙ্গে সুজাউদ্দৌলা এবং সদাশিব রাওয়ের উক্তি বিবেচনাযোগ্য। যুদ্ধ প্রস্তুতির সেই গণগণে দমকা হাওয়ায় এবং হিন্দু অথবা মুসলিম নয়, বৃহত্তর ভারতবাসীর মঙ্গল কামনায় অগ্রসর হয়েছেন সন্ধি স্থাপনে। আহমদ শাহ আবদালীর কাছে সুজাউদ্দৌলার বক্তব্য থেকেই তার মানবতান্ত্রিক প্রেমাদর্শ লক্ষ করা যায়: ‘বিশেষত সন্ধি হলে লক্ষ প্রাণী বেঁচে যাবে/যুদ্ধ হলে সমর প্রাঙ্গণে লক্ষাধিক মুসলমান হবে নাকি হত?/ আমি বলি বিনাযুুদ্ধে বিনা রক্তপাতে/ স্বকার্য্য সাধিত হলে প্রভূত মঙ্গল।’ (দ্বিতীয় খ-, পঞ্চদশ সর্গ)।
সদাশিব রাও-ও বৃহত্তর ভারতবাসীর কল্যাণ কামনায় বলে ওঠেন: ‘আমাদেরি কার্য্য দোষে অচিরে জননী হইবে শৃঙ্খলাবদ্ধ/ মহিমাম-িত মাথার মুকুট তার পড়িবে খসিয়া/বিদেশীর পদতলে জনমের মত।...ভারতীয় মোস্লেমের মনে সন্ধিসূত্রে থাকিবে ভাই ভাই মত/একযোগে এ ভারত করিব শাসন।’ (দ্বিতীয় খ-, বিংশ সর্গ)।
এ যুদ্ধের ফলে পরাধীনতার অষ্টাবক্র অন্ধকারের নাগপাশ জড়িয়ে যায় সমগ্র ভারত। পানিপথের এ তৃতীয় যুদ্ধ বৃহত্তর ভারতবাসীর সমস্ত শক্তি ও সম্ভাবনাকে ধুলিস্মাৎ করে দেয়, তাদের করে দেয় হতবিহ্বল ও পঙ্গু।
মহাশ্মশান শব্দটির প্রায়োগিক দিকই এ কাব্যের অসাম্প্রদায়িকতা উন্মোচন করে। এ কাব্যের ইসলামিক পারিভাষিক শব্দ ব্যবহারে হিন্দু অথবা মুসলমান নয়; উভয় জাতির বীরত্বই ছিলো তার কাছে প্রশংসিত। মুসলমানদের পক্ষাবলম্বন করে স্বর্ণকায় এ কাব্য রচনা করলেন। তাঁর মতে, ‘এ কাব্যের সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতা অনেক পরিমাণে হ্রাস পাইত বরং সৌন্দর্য এবং পক্ষপাতিত্বের ঘৃণনীয় কলঙ্ক কালিমায় কলুষিত হইয়া পড়িত।’ (ভূমিকাংশ)।
বস্তুত, কায়কোবাদ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার কথাকোবিদ। মহাশ্মশানের প্রতিটি সর্গে তাঁর এ প্রতিভাচ্ছটা দীপ্ত প্রদীপ্ত। তিনি এ মহাকাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের ক্ষেত্রে সম্পর্ক চিত্রণে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর অসম্প্রদায়িক দৃষ্টিচেতনা দুর্লভ বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা, জি. কে. আইডিয়াল ডিগ্রি কলেজ, মাগুরা।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার
ফ্রেন্ডলি ফায়ার দুর্ঘটনায় লোহিত সাগরে মার্কিন যুদ্ধবিমান ধ্বংস
ইরানে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে নিহত ১০
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী কে, জানেন?
বাংলাদেশি রোগী পেতে সীমান্ত পর্যন্ত মেট্রো চালু করবে ভারত
হাত ফসকে আইফোন পড়ে গেল মন্দিরের দানবাক্সে, ফেরত দিতে অস্বীকৃতি
কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫
ঢাকার বায়ুমানে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, বিপজ্জনকের কাছাকাছি
উগ্রবাদী সন্ত্রাসী 'সাদ' পন্থীদের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন
বাংলাদেশ সীমান্তে অত্যাধুনিক ড্রোন মোতায়েন ভারতের
নরসিংদীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছাত্রদলকর্মী নিহত
সিনেটে প্রার্থী হতে সরে দাঁড়ালেন লারা ট্রাম্প
আমাদেরকে আর স্বৈরাচার হতে দিয়েন না : পার্থ
মার্চের মধ্যে রাষ্ট্র-সংস্কার কাজ শেষ হবে : ধর্ম উপদেষ্টা
জামালপুরে দুই ইজিবাইকের চাপায় সাংবাদিক নুরুল হকের মৃত্যু
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইনের সামরিক সদর দফতরের দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি
ব্রাজিলে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩২
নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ সিরিয়ায়
ঘনকুয়াশায় ৩ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু
গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে