যুগে যুগে ঈদ
২৭ জুন ২০২৩, ০৮:৪৮ পিএম | আপডেট: ২৭ জুন ২০২৩, ১১:৪২ পিএম
বিশ্বের প্রতিটি জাতি তাদের বিশ্বাস ও মন-মানসিকতা অনুযায়ী আনন্দ-উৎসব পালন করে থাকে। এই আনন্দ-উৎসবে নারী-পুরুষ, শিশু-যুবক সবাই অংশগ্রহণ করে। এর কোন কোনটিকে তারা জাতীয় উৎসব হিসেবে পালন করে থাকে। হিজরতের পর রাসূলেপাক (সা.) দেখতে পেলেন মদিনাবাসীরাও বছরে দুইটি উৎসব পালন করছে। এই উৎসবগুলোতে তারা তাদের পুরনো ঐতিহ্যকেই ধরে রেখেছে। ইসলামী কোনো ভাবধারা এর মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে না। এই জাতীয় উৎসব দুটির নাম ছিল নীরুজ ও মেহেরজান। হযরত আনাস (রা.) বলেন, রাসূলেপাক (সা.) মদিনায় এসে দেখলেন, তারা দুইটি জাতীয় অনুষ্ঠান পালন করছে। এতে তারা খেলাধুলা, কবিতা আবৃত্তি, নাচ-গান ও বিভিন্ন প্রকারের আনন্দদায়ক অনুষ্ঠান করে চলেছে। রাসূলেপাক (সা.) তাদের এই উৎসবের তাৎপর্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তারা বলল, আমরা জাহিলিয়াত যুগে এই দিন দু’টিতে আনন্দ উৎসব করতাম। এখনও তাই করে চলেছি। একথা শুনে রাসূলেপাক (সা.) বললেন, আল্লাহপাক তোমাদেরকে এই দু’টি দিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দু’টি দিন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা দান করেছেন, কাজেই পূর্বেরগুলো বাদ দিয়ে এখন থেকে আল্লাহপাকের দেয়া দিন দু’টিতে তোমরা আনন্দ-উৎসব পালন কর। ঈদুল ফিতর হবে এক মাস রোজা পালন ও কৃচ্ছ্রতাসাধন করার পরের দিন, আর ঈদুল আজহা পবিত্র হজ পালন করে আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায়ের লক্ষ্যে পশু কুরবানি করার দিন।
ইসলামের এই উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীর জন্য সীমাবদ্ধ রাখা হয় নাই। এই উৎসবে নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবক আশরাফ-আতরাফ, গরিব-ধনী সবাই সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করবে। বুকে বুক মিলাবে, কুশল বিনিময় করবে, সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবে। আনন্দ ভাগাভাগি করবে। এটিই হলো ইসলামের শাশ্বত নির্দেশ।
হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর উম্মতের ঈদ
হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর জামানায়ও ঈদ পালন করা হতো। নির্দিষ্ট দিনে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই একটি বিরাট ময়দানে চলে যেত এবং সেখানে তারা আনন্দ-উৎসব পালন করত। আল কুরআনের বর্ণনা মতে আমরা জানতে পারি যে, তাদের ঈদের দিনে তারা এসে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে বলল, চলুন, আমাদের সাথে অমুক মাঠে, সেখানে আমরা উৎসব করব।
আল্লাহপাক বলেন, ‘অতঃপর হযরত ইব্রাহীম (আ.) একবার তারকাদের প্রতি লক্ষ করলেন এবং বললেন, আমি পীড়িত (অসুস্থ), অতঃপর তারা তাঁর প্রতি পিঠ ফিরিয়ে চলে গেল।’ (সূরা আস্ সাফ্ফাত: আয়াত ৮৮-৯০)।
তাদের চলে যাবার পর তিনি গিয়ে ঢুকলেন তাদের দেবমন্দিরে এবং সমস্ত প্রতিমা ভেঙে চুরমার করে বড় প্রতিমাটির কাঁধে কুড়াল রেখে চলে এলেন। পরদিন যখন ঐ সম্প্রদায় ঈদগাহ থেকে ফিরে এসে তাদের প্রতিমাদের এই অসহায় অবস্থা দেখল, তখন তারা হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে গিয়ে জিজ্ঞেস করল যে, এ কাজ কে করেছে? তিনি উত্তর দিলেন, তোমাদের বড় প্রতিমার নিকট জিজ্ঞাসা কর, আমাকে কেন জিজ্ঞাসা করছ? তখন তারা বলল, আমাদের প্রতিমা কি কথা বলতে পারে? তখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) বললেন, যারা কথা বলতে পারে না, এমন কি নিজেদের রক্ষা পর্যন্ত করতে পারে না, তারা তোমাদের কী উপকার করবে? তোমরা কেন তাদের ইবাদত করছ? তোমরা এসব ভ-ামি ছেড়ে এমন এক সত্তার ইবাদত কর, যিনি আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন, যিনি কারও মুখাপেক্ষী নন, যিনি সব কিছুর মালিক, যার নির্দেশে এই পৃথিবীর সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে। যার হাতে আমাদের জীবন-মরণ। একথা শুনে তারা লজ্জিত হলো এবং সেখান থেকে চলে গেল ।
হযরত মুসা (আ.)-এর জামানার ঈদ
হযরত মুসা (আ.)-এর জামানায়ও ঈদ উৎসব হতো। যেমন হযরত মুসা (আ.)কে যখন ফেরাউনের লোকেরা বলল যে, তোমার সাথে আমাদের মুকাবিলা হবে, তুমি বলো, কোনদিন তুমি আমাদের মুকাবিলায় হাজির হবেÑ তখন তিনি বললেন, পবিত্র কুরআনের ভাষায়, ‘তোমাদের ওয়াদার দিন উৎসবের দিন এবং পূর্বাহ্নে লোকজন সমবেত হবে।’ (সূরা তয়াহা, আয়াত ৫৯)। অর্থাৎ তাদের ঈদের দিন মুকাবিলা করার দিন ধার্য হলো। ঐদিনটি নিয়ে কিছু মতভেদ আছে। কেউ বলে নববর্ষের দিন, কেউ বলে আশুরার দিন। ফেরাউন হযরত মুসা (আ.) এর সাথে মোকাবিলা করার জন্য যাদুকরদের জমায়েত করল। হযরত মুসা (আ.) লাখ লাখ মানুষের সামনে তাঁর লাঠির সাহায্যে এমন যাদু প্রদর্শন করলেন, যা যাদুকর দ্বারা সম্ভব নয়। হযরত মুসা (আ.) এর মোজেযা দেখে সামউনের নেতৃত্বে সমস্ত যাদুকর অহদানিয়াতের পতাকাতলে আত্মসমর্পণ করেছিল। আবার এ দিনেই ফেরাউনের সমস্ত দলবলসহ নীলনদে ডুবে মরেছিল। আর এজন্যই হযরত মুসা (আ.) এদিনটিকে তাঁর উম্মতের জন্য ঈদের দিন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
হযরত ঈসা (আ.) এর উম্মতের ঈদ
হযরত ঈসা (আ.) এর বিভিন্ন মুজেযা দেখে তাঁর দলের লোকেরা আরজ করল, আপনার রব যথেষ্ট ক্ষমতাধর, আপনি আসমান থেকে আমাদের জন্য খাদ্যভরা খাঞ্চা এনে দেন। আল্লাহপাক বলেন, ‘তখন ঈসা ইবনে মারিয়াম দোয়া করলেন, হে আমার পরওয়ারদিগার আল্লাহ! আসমান থেকে আমাদের প্রতি খাদ্যভরা খাঞ্চা নাজিল করুন, যেন ঐদিন আমাদের জন্য পূর্বাপর আনন্দের দিন হয়। আর আপনার পক্ষ থেকে তা নিদর্শনস্বরূপ হয়ে থাকে আর আমাদেরকে রিজিক দান করুন এবং আপনি উত্তম রিজিক প্রদানকারী।’ (সূরা মায়েদা, আয়াত: ১১৪ )।
আল্লাহপাক তাঁর দোয়া কবুল করলেন, তখন লাল বর্ণের একটি খাঞ্চা মানুষের সম্মুখেই আসমান থেকে অবতরণ করতে লাগল। এ দৃশ্য দেখে হযরত ঈসা (আ.) কাঁদতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ! আমাকে তোমার শোকর গুজার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত কর। আর আসমান থেকে যা অবতারণ করেছ, তাকে আমাদের জন্য রহমত বানাও, আজাবে পরিণত করো না।
হযরত ঈসা (আ.) বললেন, তোমাদের মধ্যে যে সর্বাধিক নেককার সে যেন বিসমিল্লাহ বলে এর ঢাকনা খোলে। তখন তাদের দলনেতা সামুন সেগার আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এর যোগ্য। তখন হযরত ঈসা (আ.) অজু করে শোকরানা নামাজ আদায় করে বিসমিল্লাহ বলে ঢাকনা খুললেন এবং বললেন, বিসমিল্লাহি খাইরুর রাজিকিন। তিনি এই খাবার এক হাজার তিনশ’ অসুস্থ পঙ্গু বিপদগ্রস্ত নর-নারীসহ তৃপ্তির সাথে গ্রহণ করলেন।
এই খাবার প্রতিদিন সকালে আসমান থেকে আসতো। এটি ৪০ দিন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এই খাঞ্চাভরা খাদ্য লাভ করেও যখন লোকেরা নাফরমানী করতে শুরু করল, তখন আল্লাহপাক খাঞ্চা অবতারণ বন্ধ করে দিলেন এবং হযরত ঈসা (আ.) এর উম্মতের ৩৩৩ জনকে শূকরে পরিণত করে শাস্তি দিলেনÑ যারা আল্লাহপাকের সাথে নাফরমানী করেছিল। এই খাঞ্চা অবতরণের দিনটিতে হযরত ঈসা (আ.) এর উম্মতেরা ঈদ উদযাপন করে থাকে।
উপরোক্ত ঈদের তথ্যগুলো আমরা পবিত্র কুরআন থেকে পেয়েছি, আর এই তথ্যগুলোই প্রমাণ করে যে, শুধুমাত্র উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য ঈদ নয়, ঈদ সমস্ত সম্প্রদায় এবং সকল কওমের মধ্যেই প্রচলিত ছিল।
মুমিন এবং কাফেরের ঈদ
মুমিনের ঈদ হলো আল্লাহপাককে খুশি করার ঈদ। পক্ষান্তরে কাফেরের ঈদ হলো শয়তানকে খুশি করার ঈদ। মুমিন যখন ইদগাহে যেতে থাকে তখন তার মাথায় থাকে হেদায়েতের তাজ। তাদের চাহনিতে থাকে চিন্তা-ভাবনা। তারা তখন হক কথা শোনে, মুখে থাকে আল্লাহপাকের অহদানিয়াতের কথা, অন্তরে থাকে বিশ্বাস এবং আল্লাহপাকের মারেফাতের নূর, গায়ে থাকে আল্লাহপাকের শান্তির চাদর। এই অবস্থায় যখন তারা ঈদগাহে গিয়ে বসে তখন আল্লাহপাক তাদের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেন।
পক্ষান্তরে কাফেররা যখন তাদের উৎসবে যায় তখন তাদের মাথায় থাকে পথভ্রষ্টতার টুপি। তাদের কানে বিবেক শূন্যতার তালা লাগানো থাকে, চোখে থাকে কামোত্তেজনার চিহ্ন। তারা জমায়েত হয় খৃষ্টান এবং নাসারাদের ইবাদত খানায়। তাদের মাবুদ হলো মূর্তি। তারা বেপর্দা নর-নারীর কণ্ঠলগ্ন হয়ে নাচানাচি করে মদপান করে, অশ্লীল-ঘৃণ্য কাজে দিনটিকে অতিবাহিত করে। পরিণামে তাদের জন্য নির্ধারিত হয়ে যায় দোযখ। মুমিনের ঈদের অর্থ শুধুমাত্র এই নয় যে, সুন্দর সুন্দর নতুন কাপড় পরিধান করা, ভালো ভালো সুস্বাদু খাবার খাওয়া। তাদের উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহপাকের দরবারে আনুগত্য প্রদর্শন করা, গোনাহ থেকে তওবা করা, যাতে গোনাহগুলো সওয়াবে পরিণত হয়ে যায়। উচ্চ মর্যাদা লাভ করা যায়, অন্তর থেকে সকল প্রকার বদখেয়ালী দূর হয়ে যায়। (সংকলিত, ঈষৎ সংক্ষেপিত)
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার
ফ্রেন্ডলি ফায়ার দুর্ঘটনায় লোহিত সাগরে মার্কিন যুদ্ধবিমান ধ্বংস
ইরানে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে নিহত ১০
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী কে, জানেন?
বাংলাদেশি রোগী পেতে সীমান্ত পর্যন্ত মেট্রো চালু করবে ভারত
হাত ফসকে আইফোন পড়ে গেল মন্দিরের দানবাক্সে, ফেরত দিতে অস্বীকৃতি
কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫
ঢাকার বায়ুমানে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, বিপজ্জনকের কাছাকাছি
উগ্রবাদী সন্ত্রাসী 'সাদ' পন্থীদের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন
বাংলাদেশ সীমান্তে অত্যাধুনিক ড্রোন মোতায়েন ভারতের
নরসিংদীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছাত্রদলকর্মী নিহত
সিনেটে প্রার্থী হতে সরে দাঁড়ালেন লারা ট্রাম্প
আমাদেরকে আর স্বৈরাচার হতে দিয়েন না : পার্থ
মার্চের মধ্যে রাষ্ট্র-সংস্কার কাজ শেষ হবে : ধর্ম উপদেষ্টা
জামালপুরে দুই ইজিবাইকের চাপায় সাংবাদিক নুরুল হকের মৃত্যু
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইনের সামরিক সদর দফতরের দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি
ব্রাজিলে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩২
নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ সিরিয়ায়
ঘনকুয়াশায় ৩ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু
গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে